-মাহমুদ ইউসুফ
প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর (অবসরপ্রাপ্ত) ডঃ কাজী দীন মুহাম্মদ বলেছেন, ‘আজ সাড়ে সাত হাজার বছর আগে হযরত নুহু (আঃ) এর সময়ে সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদে বিশ্বাসী তাঁর প্রপৌত্র বঙ এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এরপর যে জনগোষ্ঠি গড়ে ওঠে তা-ই বঙ্গ জনগোষ্ঠি নামে অভিহিত হয়। কালের বিবর্তনে উক্ত বঙ থেকেই বঙ্গ দেশের নামকরণ হয়েছে’ (বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ ১ম খন্ড, ইফাবা, ২য় সংস্করণ, জুন-২০০৮, পৃ-১৬৭)। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)। তিনিই এ পৃথিবীতে মানব সভ্যতার জয়যাত্রা শুরু করেন। ইসলাম, ইহুদী ও খৃস্টান ধর্মমতে এটাই চরম সত্য। কুরআন, বাইবেল, তাওরাতে এ সত্যেরই প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ)কে আল্লাহ রাববুল আলামীন এ ভারতবর্ষেই প্রেরণ করেন। তদানীন্তন সরন্দীপ (আজকের শ্রীলঙ্কা) আর হিন্দুস্তান একই ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হযরত আদম (আঃ) এর পুত্র দ্বিতীয় নবী হযরত শীষ (আঃ)ও এই ভারতবর্ষেরই নাগরিক ছিলেন। এখানেই তিনি বসতি স্থাপন করেন। আর এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে হযরত নুহু (আঃ) এর উত্তরপুরুষেরা ভারতবর্ষ আবাদ করেন। তাই দেখা যায়, মুসলিমদের কাছে শুধু আরবভূমিই নয় এই ভারতীয় উপমহাদেশও অতি আপনভূমি। কেননা মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মুসলমানরা এই ভূখন্ডে বসবাস করে আসছে। নেগ্রিটো, অস্ট্রল্যান্ড, অস্ট্রো এশিয়াটিক, মঙ্গোলয়েড, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, বৌদ্ধ, আর্য জাতির বিকাশ আরও পরের ঘটনা।পার্বত্য উপজাতির আগমন তো সেদিনের ঘটনা। সর্বোচ্চ তিনশ বছর।
খৃস্টপূর্ব সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে একমহাপ্লাবন সংঘটিত হয়! অনেকের মতে খৃস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে এটি সৃষ্টি হয়েছিল। এ মহাপ্লাবন মিসর থেকে হিন্দুস্তান, ককেশাস থেকে আরব সাগর পর্যন্ত ছড়িয়েছিল। এটি ছিল মূলতঃ আল্লাহর গজব। হযরত নুহু (আঃ) দীর্ঘ সাড়ে নয়শ বছর ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু গুটিকয়েকজন নাগরিক ছাড়া আর কোনো নাগরিক আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন নাই। এই অমুসলিম তথা মুশরিক কাফিরদের শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যেই মহান রব গজব নাজিল করেন। এ মহাপ্লাবনে মাত্র ৮৫ জন মানুষ, যারা নূহ (আঃ) এর কিস্তিতে আরোহণ করেছিলেন তারাই জীবিত থাকে। বাকি সমগ্র মানবজাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পানিবন্যা পরবর্তী সময়ে হযরত নুহ (আঃ) এর সন্তানেরা বিভিন্ন দেশে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর দৌহিত্র হিন্দ ভারতবর্ষ আবাদ করেন। বঙের বংশধরদের আবাসস্থলই আজকের বাংলাদেশ। বং থেকে কালক্রমে বঙ্গ, বাঙালাহ, বেঙ্গল, বাংলা ইত্যাদি নামের উদ্ভব ঘটে।
বঙ্গ নামের উৎপত্তির সঙ্গে অনেক লেখক, গবেষক ও ঐতিহাসিক ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে, বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি ভারতীয় আর্যদের আমলে, যারা খৃস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর পূর্বে মধ্য এশিয়া থেকে এসে সিন্ধু নদীর তীরে দ্রাবিড়দের উৎখাত করে বসতি স্থাপন করে। প্রমাণস্বরূপ তারা উল্লেখ করেছেন, ঋগবেদের ঐতরেয় আরণ্যক এ বঙ্গ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত, পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ‘আর্য রমণীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত, দুশ্চরিত্র অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমা গঙ্গার জলে ভেসে আসাকালীন নিঃসন্তান ‘‘অনার্য’ বলিরাজ তাঁকে তুলে নিয়ে যান এবং স্বীয় পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে পুত্র উৎপাদনের জন্য তাঁকে নিয়োগ করেন। সুদেষ্ণার গর্ভে উক্ত ঋষির ঔরসে পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। এই ক্ষেত্রজ পুত্র সন্তানদের নাম রাখা হয় ১) অঙ্গ, ২) বঙ্গ, ৩) কলিঙ্গ ৪) পুন্ড্রু এবং ৫) সূক্ষ্ম। তাদেরকে পাঁচটি রাজ্য দেয়া হয় এবং তাদের নামানুসারে পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ করা হয়’। যারা এই তথ্যকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চায়, তাদের নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য পেশ করা হলো। এক- কোনো যুক্তিবাদী ও বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ কী উপরোক্ত তথ্য বিশ্বাস করতে পারেন?
দুই- বলিরাজ বা ধর্মপাল অষ্টম শতকে বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন মহান, ন্যায়পরায়ণ, জনদরদী, সজ্জন এবং পন্ডিতপ্রবর শাসক ছিলেন? তাঁর স্ত্রী সুদেষ্ণাও একজন মহিয়সী নারী ছিলেন। এই মহৎ শাসক তাঁর স্ত্রীর গর্ভে দুশ্চরিত্র দীর্ঘতমার জারজ সন্তান ধারণ করার অনুমতি দেবেন অথবা একজন সতী নারী একজন লম্পটের ভ্রূণ গ্রহণ করবেন এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? তিন-ভারতে আর্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে এ অঞ্চলের নাম কী ছিলো সে বিষয়ে তারা কিছু ধারণা দেননি কেন? চার-ঋগবেদ, পুরাণ, মহাভারতে এ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে কেন অত্যন্ত হেয় ও ঘৃণ্যবলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে? পাঁচ- কোনো মানুষকে কী দস্যু, অসুর, দেও দানব, রাক্ষস, পক্ষী, অনার্য আখ্যা দেয়া যায় কিনা বা উচিত কিনা? ছয়-বাংলা ভাষাকে আর্যরা আসুরিক ও ম্লেচ্ছদের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কেন? সাত- সেনবর্মনরা কেন বাংলা ভাষা নিধনে মেতে ওঠেছিল? আট-রিয়াজ-উস-সালাতিন গ্রন্থে বর্ণিত বাংলা নামকরণ সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্য হিন্দু ঐতিহাসিকরা খন্ডন করেননি বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেননি। থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবার ভয়ে কী? নতুন কোনো তথ্য বা যুক্তি উপস্থাপন করতে হলে অবশ্যই অতীতের বক্তব্য খন্ডন করতে হবে। এটাই ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়ম। নয়-বলিরাজ বা ধর্মপাল নিজেই বঙ্গের শাসক ছিলেন। তাই জারজ সন্তান সৃষ্টি করে তার নামে বঙ্গের নামকরণের যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। বলিরাজের অনেক পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলের নাম বঙ্গ হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্রু, সূক্ষ্ম নামে তাঁর কোনো সন্তান ছিলো না। ধর্মপালের পূর্বে এদেশ শাসন করে তার পিতা গোপাল, ধর্মপালের মৃত্যুর পর পুত্র দেবপাল, তারপর বিগ্রহপাল মসনদে বসেন। দশ-প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি পরাক্রমশালী একটি জাতি। যেসব ঐতিহাসিক স্বজাতিকে জারজ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চায় তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা অতীব জরুরী।
ডঃ এম এ আজিজ ও ডঃ আহমদ আনিসুর রহমান বলেছেন, ‘আর্যদের আগমনের বহুপূর্বেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে উপমহাদেশের এ অঞ্চলে ‘বঙ্গ’ নামে জনপদ বিদ্যমান ছিল। আর্যদের পৌরাণিক কাহিনী থেকে যে ‘বঙ্গ’ শব্দের উৎপত্তি নয় তা-ও সুস্পষ্ট। কাজেই ‘বঙ্গ’ শব্দের উৎপত্তি ভারতীয় আর্য হিন্দু আমলে হয়েছে বলে গ্রহণযোগ্য নয় (বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ ১ম খন্ড, ইফাবা, ২য় সংস্করণ, জুন-২০০৮, পৃ-৪)। রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘আর্য জাতির সংস্পর্শে আসিবার পূর্বেই বর্তমান বাঙালী জাতির সংস্পর্শে বাঙালি জাতির উদ্ভব হইয়াছিল এবং তাহারা একটি উচ্চাঙ্গ ও বিশিষ্ট সভ্যতার অধিকারী ছিল’ (বাংলাদেশের ইতিহাস)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘(বাংলাদেশের) প্রাচীন লিপিতে দীনার ও রূপক এই দুই প্রকার নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত স্বর্ণমুদ্রার নাম ছিল দীনার ও রৌপ্য মুদ্রার নাম ছিল রূপক। ১১৬ রূপক এক দীনারের সমান ছিল’। দীনার শব্দটি সেমিটিক পরিভাষার সাথে সম্পর্কিত। প্রখ্যাত গবেষক ও লেখক সিরাজ উদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘বাঙাল জনগোষ্ঠীর নামকরণ বাঙ, কৌম বা গোত্র থেকে হয়েছে। ভাগিরথীর পূর্বদিকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙ জনগোষ্ঠী বাস করত। ….প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙ জাতি এ অঞ্চলে বাস করত এবং তাদের নামানুসারে বঙ্গ জনপদের নামকরণ’ (পৃ-৫১, বরিশালের ইতিহাস প্রথম খন্ড, ভাস্কর প্রকাশনী, জুলাই-২০০৩)। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বাঙালী জাতির প্রধান আদি বাসস্থান। সুদূর প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙ জাতি এ অঞ্চলে বাস করত। বাঙালী শঙ্কর জাতি। নরতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করলে বাঙালী জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়’ (পৃ-৪৯, পূর্বোক্ত)। এই বাঙ নামকরণ হযরত নুহর প্রপৌত্র বঙ থেকেই উদ্ভূত। আর্য হিন্দু প্রভাবিত ইতিহাসবিদ, লেখক, গবেষকরা এ তথ্যকে গোপন বা অস্বীকার করলেও এটিই প্রকৃত ও সত্য ইতিহাস।
সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ বাংলাদেশি মুসলমানদের শেকড়শূন্য ও বহিরাগত হিসেবে প্রতিপন্ন করতে সঙ্কল্পবদ্ধ। পার্বত্য উপজাতিরা ওই অঞ্চলে সর্বোচ্চ তিনশ বছর পূর্বে এ অঞ্চলে আগমন করে। আর মুসলমানরা সভ্যতার শুরু থেকেই বাংলাদেশের বাসিন্দা। তাই বাংলাদেশি মুসলমানরাই বাংলাদেশের আদিবাসী ও প্রাচীন অধিবাসী। মুসলমানরাই ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন জাতিগোষ্ঠী।
No comments:
Post a Comment
https://isignbd.blogspot.com/2013/10/blog-post.html