Showing posts with label Sign of Rasulullah. Show all posts
Showing posts with label Sign of Rasulullah. Show all posts

Sunday, October 20, 2013

জর্দানের বিস্ময়কর ইসলামিক নিদর্শন সাহাবী গাছ (ভিডিও সহ)

জর্দানের বিস্ময়কর ইসলামিক নিদর্শন সাহাবী গাছ



আজো বেঁচে আছে বিস্ময়কর ১৫০০ বছর আগের রাসুল (সঃ) এর সাক্ষাৎপ্রাপ্ত বেচে থাকা একমাত্র সাহাবী গাছ। ইংরেজিতে এ গাছকে বলা হয় The Blessed Tree. শুনতে অবাক লাগলেও কিন্তু বেঁচে আছে গাছটি।
পৃথিবীতে এত পুরনো কোনো গাছ এখনো বেঁচে আছে তা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও কিন্তু সত্যি। সাহাবি গাছ এমনই একটি গাছ যে গাছটি অবিশ্বাস্যভাবে শত বর্গ কিলোমিটারজুড়ে মরুভূমিতে গত ১৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে খুবই সুন্দর গাছটি।
মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশের কারণে জন্ম থেকেই গাছটি ছিল পাতাহীন শুকনো কিন্তু একসময় আল্লাহর হুকুমে গাছটি সবুজ পাতায় ভরে উঠে এবং আজ পর্যন্ত গাছটি সবুজ শ্যামল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
অবিশ্বাস্য এই গাছটি জর্ডানের মরুভূমির অভ্যন্তরে সাফাঈ এলাকায় দণ্ডায়মান। জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ সর্বপ্রথম এই স্থানটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা দেন।
৫৮২ খ্রিস্টাব্দে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বয়স তখন ১২ বছর, তিনি তার চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বাণিজ্য উপলক্ষে মক্কা থেকে তৎকালীন শাম বা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
যাত্রাপথে তারা সিরিয়ার অদূরে জর্ডানে এসে উপস্থিত হন। জর্ডানের সেই এলাকাটি ছিল শত শত মাইলব্যাপী বিস্তৃত উত্তপ্ত বালুকাময় এক মরুভূমি। মোহাম্মদ (সা.) এবং তার চাচা আবু তালিব মরুভূমি পাড়ি দেয়ার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
তখন তারা একটু বিশ্রামের জায়গা খুঁজছিলেন। কিন্তু আশপাশে তারা কোনো বসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। চারদিকে যত দূর চোখ যায় কোনো বৃক্ষরাজির সন্ধান পাচ্ছিলেন না।
কিন্তু দূরে একটি মৃতপ্রায় গাছ দেখতে পেলেন তারা। উত্তপ্ত মরুভূমির মাঝে গাছটি ছিল লতাপাতাহীন শীর্ণ ও মৃতপ্রায়। উপায় না পেয়ে তারা মরুভূমির উত্তাপে শীর্ণ পাতাহীন সেই গাছটির তলায় বিশ্রাম নিতে বসেন।
উল্লেখ্য, রাসূল মোহাম্মদ (সা.) যখন পথ চলতেন তখন আল্লাহর নির্দেশে মেঘমালা তাকে ছায়া দিত এবং বৃক্ষরাজি তার দিকে হেলে পড়ে ছায়া দিত।


মোহাম্মদ (সা.) তার চাচাকে নিয়ে যখন গাছের তলায় বসেছিলেন তখন তাদের ছায়া দিতে আল্লাহর নির্দেশে মৃতপ্রায় গাছটি সজীব হয়ে উঠে এবং গাছটির সমস্ত ডালপালা সবুজ পাতায় ভরে যায়।
সেই গাছটিই বর্তমানে সাহাবি গাছ নামে পরিচিত। এ ঘটনা দূরে দাঁড়িয়ে জারজিস ওরফে বুহাইরা নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রি সবকিছু দেখছিলেন।


আবু তালিব মোহাম্মদকে (সা.) নিয়ে পাদ্রীর কাছে গেলে তিনি বলেন, আমি কোনোদিন এই গাছের নিচে কাউকে বসতে দেখিনি।
পাদ্রী বলেন, গাছটিও ছিল পাতাহীন কিন্তু আজ গাছটি পাতায় পরিপূর্ণ। এই ছেলেটির নাম কি? চাচা আবু তালিব উত্তর দিলেন মোহাম্মদ! পাদ্রী আবার জিজ্ঞাসা করলেন, বাবার নাম কি? আব্দুল্লাহ!, মাতার নাম? আমিনা!
বালক মোহাম্মাদকে (সা.) দেখে এবং তার পরিচয় শুনে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পাদ্রীর চিনতে আর বাকি রইল না যে, এই সেই বহু প্রতীক্ষিত শেষ নবী মোহাম্মদ। চাচা আবু তালিবকে ডেকে পাদ্রী বললেন, তোমার সঙ্গে বসা বালকটি সারা জগতের সর্দার, সারা বিশ্বের নেতা এবং এই জগতের শেষ নবী।
তিনি বলেন, আমি তার সম্পর্কে বাইবেলে পড়েছি এবং আমি ঘোষণা দিচ্ছি, এই বালকটিই শেষ নবী।
চাচা আবু তালিব ও মহানবী (সা.) যেই গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন সেই গাছটি ১৫০০ বছর আগ যে অবস্থায় ছিল আজো সেই অবস্থায় জর্ডানের মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে।
গাছটি সবুজ লতা-পাতায় ভরা এবং সতেজ ও সবুজ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গাছটি যেখানে অবস্থিত তেমন মরুদ্যানে কোনো গাছ বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। গাছটির আশপাশের কয়েকশ’ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে আর কোনো গাছ নেই।
গাছটির চারিদিকে দিগন্ত জোড়া শুধুই মরুভূমি আর মরুভূমি। উত্তপ্ত বালুকাময় মরুভূমির মাঝে গাছটি দাঁড়িয়ে থেকে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে মহানবী রাসূল মোহাম্মদের (সা.) স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে, যা আল্লাহ তা’য়ালার কুদরতি ক্ষমতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

Watch This Video:


Thursday, September 19, 2013

প্রথম ভারতীয় সাহাবী হযরত তাজউদ্দীন চেরামান পেরুমল (রাঃ) - রাছুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজার ইন্ডিয়ান সাক্ষী



ভারতীয় সাহাবী তাজউদ্দীন রা: এর কবর

চেরামান পেরুমল উপমহাদেশের সর্বপ্রথম নাগরিক যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পবিত্র সাহচর্য লাভ করে সাহাবী হবার গৌরব অর্জন করেন। উনার নিবাস ছিল ভারতের বর্তমান কেরালা প্রদেশের মালাবার অঞ্চলের ’Kodungaloor ‘কোডুঙ্গোলর’ এলাকায়। উনি উক্ত অঞ্চলের সম্রাট ছিলেন। একাধারে ২৬টি বৎসর তিনি রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পুরো দক্ষীণ ভারতের ২৫০০ মাইলেরও বেশী এলাকা জুড়ে উপকুলীয় এ রাজ্যের সীমানা ছিল বিশাল। অনেক ঐতিহাসিক উনার ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রাচীন বইয়ের মধ্যে এম. হামিদুল্লাহ রচিত “মুহাম্মাদ রসূলুল্লহ” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 
‘চক্রবতী ফারমাস’ যা চেরামান পেরুমল এর অন্য একটি উপাধি; নিজ অঞ্চলে থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা বা অলৌকিক ঘটনা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেণ।  পবিত্র কোর’আনের সূরা-ক্বমার এ এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজার কথা উল্লেখ আছে। তাফসিরে মা’আরিফুল কোর’আনে উক্ত সূরার ব্যাখ্যায় এই পূন্যাত্মা সাহাবীর ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কথা উল্লেখ আছে। ওখানে আরো বলা আছে যে, মালাবারের এই মহারাজা ডায়েরী লিখতেন। যেদিন এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা সংগঠিত সেই, উনি সেইদিনের ঘটনা সবিস্তারে তারিখ সহ লিখে গেছেন। উনার রচিত সেই ডায়েরী এখনও সংরক্ষিত আছে।
মক্কার কাফেরদের দাবীর মুখে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা হাতের ইশারায় চাঁদকে দিখন্ডিত করে দেখান। চাঁদের একটা অংশ আকাশের পূর্বাংশে আর অপরাংশ পশ্চিম দিকে সরে যায় কিছুক্ষণের জন্য। উপস্থিত অনেকেই সে রাতে এ দৃশ্য দেখেছিল। কাফেরদের কেউ কেউ এটা বিশ্বাস করলেও নিজের চোখে দেখা সত্তেও কেউ কেউ তা যাদু হিসেবে অভিহিত করে।

জোৎস্নারাতে রাজা চেরুমল রাজপ্রসাদের ছাদে বসে ছিলেন রাণী সাথে করে। হঠাৎ চাঁদকে দ্বিখন্ডিত হতে দেখে রাণীসহ তিনি ও তার সভাসদরা যারপরনাই বিষ্মত হন। এ বিষয়ে তিনি রাজজ্যোতিষীদের কাছে জানতে চান। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই মালাবার উপকুলে আগত আরব বণীকদের মাধ্যমে স্থানীয় আরব বণীক ও তাদের ভারতীয় দোসররা জানতে পারেন যে, আরবে এক নবী আত্বপ্রকাশ করেছেন, তিনি একত্ববাদ প্রচার করেন, তিনিই নিজ হাতের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন। এ কথা শুনে অভিভূত রাজা চেরামান পেরুমল আরবের সেই নবীর সাথে স্বাক্ষাতের জন্য মরীয়া হয়ে উঠেন, শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন একদল আরব বণীকদের সাথে।

হিজরতের পূর্বে সম্ভবত ৬১৯-৬২০ খৃষ্টাব্দে, ২৭ শে শাওয়াল সকাল নয়টার দিকে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর সাথে তাঁর দেখা হয়। সেখানেই তিনি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা: এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বক্কর রা: সহ আরও কয়েকজন সাহাবীর উপস্থিতিতে স্বয়ং আল্লাহর হাবীব সা: তার নাম রাখে তাজউদ্দীন। রাজা চেরামান পেরুমল রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য উপঢৌকন হিসেবে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত আচার নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় এক বাদশাহ কর্তৃক আদার সংমিশ্রণে তৈরী সেই আচার সংক্রান্ত একটা হাদিসও আমরা দেখতে পাই, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাইদ খুদরী রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে হাদিসটি। 
হাদীস সঙ্কলনকারী হাকিম (রঃ) তার ‘মুস্তাদরাক’ নামক কিতাবে হাদীসটি সঙ্কলন করেছেন। হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ), চেরামান পেরুমল (রাঃ) কে ‘মালিকুল হিন্দ’ তথা ‘ভারতীয় মহারাজ’ বলে সম্বোধন করেন।
عن ابى سعيد الخدرى (رضى لله عنه) قال اهدى ملك الهند الى النبى (صلى الله عليه وسلم) جرة فيها زنجبيل فاطعم اصحابه قطعة قطعة واطعمنى منها قطعة
[رواه المستدرك حاكم]
হযরত আবু সাঈদ সা’দ বিন মালিক বিন সিনান আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘ভারতীয় মহারাজ নবীজী (সাঃ) এর জন্য এক বয়াম আচার নিয়ে আসলেন যার মধ্যে আদার টুকরা ছিল। নবীজী (সাঃ) সেই টুকরাগুলা তার সাহাবীদের ভাগ করে দিলেন। আমিও খাবার জন্য একটি টুকরা ভাগে পেয়েছিলাম’।
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মালিক ইবনে দীনারের বোন রাজিয়া’র সাথে রাজা পেরুমল তথা সাহাবী তাজউদ্দীন রা: এর বিয়ে হয়। তিনি সেখানে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ বৎসর অবস্থান করে রাসুলুল্লাহ সা: এর নির্দেশে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার সাথে মালিক ইবনে দীনারসহ আরও ক’জন সাহাবী ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে দক্ষিণপূর্ব আরবের এক বন্দরে (বর্তমান ওমানের সালালা শহর) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। আজও তার কবর রয়েছে ওমানের সালালা শহরে, মর্যাদাবান এক সাহাবী হিসেবে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সেটি এক অনবদ্য আকর্ষণ।

ওদিকে মালিক ইবনে দিনার রা: এবং তার বোন রাজিয়া রা:সহ অন্যান্য মুসলমানগণ ঠিকই কেরালাতে আসেন, মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে চেরুমান পেরুমল তথা তাজউদ্দীন রা: তার আত্বীয়স্বজনদের কাছে চিঠি লিখে পাঠান সাহাবী মালিক ইবনে দিনারের হাতে।

সাহাবী মালিক ইবনে দিনার, তার বোন রাজিয়া দলবল সহ কেরালায় আসেন এবং এখানেই তারা বসতী স্থাপন করেন। এর আগে থেকেই সেখানে এক বিরাট আরব বণীকদের বসতী গড়ে উঠেছিল। সাহাবী মালিক ইবনে দিনার সেখানে ভারতের প্রথম মসজিদ স্থাপন করেন। সেখানেই এই মহান সাহাবী ও তার বোন হযরত রাজিয়া রা: এর কবল আজও বিদ্যমান রয়েছে।

Source: http://www.postpoems.org  and http://www.bdtomorrow.net

Watch this Video: 
Hazrath Tajuddin (R) The first Muslim & Sahabi Rasool (S) from INDIAN Region. 

For more information browse this website: http://www.mohdiqbal.webs.com/ 


 ``Sign of Rasulullah" Label's Other Link:


Monday, September 16, 2013

এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য

এক অসাধারণ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি:
ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য 
সংকলনে: শাহাদাতুর রহমান সোহেল


দরূদ পাঠ মুসলিম সমাজের একটি নিদর্শন, রাছুলুল্লা­াহ (সাঃ)- এর প্রতি ভালবাসার অন্যতম নিদর্শন, গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী আমল। আর আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি অসাধারণ না’তসহ দরূদ হল- বালাগাল উলা বি-কামালিহি ......।

       বালাগাল উলা বি-কামালিহি,/কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি,/হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি,/সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।।  - আমাদের দেশে দরূদ হিসেবে প্রচলিত এই ছন্দোবদ্ধ আরবী চতুস্পদীটি বলতে হবে, অসম্ভব জনপ্রিয় সর্বমহলে। জ্ঞানী-গুণী পীর-মাশায়েখদের কাছে যেমন, তেমনি নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বসাধারণ মানুষের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত। মীলাদ মাহফিলে ওয়ায়েজ যখন সুর দিয়ে দরূদটি পড়েন, তখন উপস্থিত ছোট-বড় সবাই তাঁর সঙ্গীত মাধুরিতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসায় বিমোহিত হন। তাঁরাও সমস্বরে পাঠ করেন রাসূল প্রেমের আরশি, অমৃত সুধার আধার এই চতুস্পদী। অর্থ না বুঝেই যে আবেগ তৈরী করে অর্থ-তাৎপর্য, ইতিহাস ইত্যাদি জানলে এই দরূদের দ্বারা অনেক বেশী আবেগ-চেতনা তৈরী হত এবং নিঃসন্দেহে বেশী সওয়াবেরও কারণ হত। আসুন নাত- সহকারে এই অসাধারণ দরূদটি আমরা শুনি:            

            অন্য দরূদের সাথে এর পার্থক্য হল এটি না’তসহকারে দরূদ এবং এই না’তটির মধ্যেও আছে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর ব্যঞ্জনা।  না’ত মানে প্রশংসা। রাসূলে পাকের প্রশংসাকে বলা হয় না’ত। এটি আমাদের ধর্মীয় পরিভাষা। মানুষ যখন আল্লাহ পাকের প্রশংসা করে, তাকে বলা হয় ‘হামদ’। আর রাসূলে পাকের ক্ষেত্রে হলে না’ত। আমাদের দেশে ধর্মীয় মাহফিলের শুরুতে তেলাওয়াতে কুরআনের পরপর হামদ ও না’ত এর প্রচলন এখনও পুরোদমে বিদ্যমান। আমাদের আলোচ্য না’ত সহ দরূদটি আরবি ভাষায় লেখা। তবে এর রচয়িতা একজন ফারসি কবি। বিশ্ব বিখ্যাত সাধক কবি শেখ সা’দী (রা.)। আসল  নাম  মুশাররফ উদ্দীন মুসলেহ ইবনে আব্দুল্লাহ শিরাজী বর্তমান ইরানের ফার্স প্রদেশ বা প্রাচীন পারস্যের রাজধানী শিরাজ নগরীতে তাঁর জন্ম এবং সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত। তার জন্মসাল নির্দিষ্ট নয়, তবে মৃত্যু ৬৯১ ও ৬৯৫ হিজরির মধ্যবর্তী সময়ে। বর্তমানে ১৪৩৩ হিজরী চলছে । অর্থাৎ এখন থেকে অন্তত: সাড়ে আটশ বছর আগে। উচ্চ শিক্ষার জন্য শেখ সা’দী (রহঃ) সে সময়কার বিশ্ব সাহিত্যের পাদপীঠ হাজারো সাহাবীর পদধন্য বাগদাদে চলে আসেন এবং জমানার মুজাদ্দিদ গাউসুল আজম হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহির নিকট এলেমি শিক্ষা লাভ করেন | মহান হজ্বব্রত পালন শেষে তিনি বিশ্ব ভ্রমনে বেড়িয়ে পড়লেন | বলা হয় ইবনে বতুতার পর প্রাচ্যে তিনিই সবচেয়ে বড় পরিব্রাজক | ইতিহাস ঘেটে দেখে গেছে যে তিনি একজন বীর মুজাহিদ ও বটে | জেরুজালেমের পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দেস (আল আকসা) নিয়ে খৃষ্টানদের সাথে ঐতিহাসিক যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহন ছিল | জেরুজালেমের পথে প্রান্তরে দিবানিশি শেখ সাদীর কবিতা হামদ রচনা মুসলীম মুজাহিদগন আবৃত্তি করে একে অপরকে উত্সাহ জোগাতেন | অতএব দেখা যাচ্ছে, সেই জিহাদে শেখ সাদী(রহঃ)-এর অংশগ্রহণ ছিল নেতৃস্থানীয় এবং প্রভাবশালী। সম্মিলিত ইউরোপের ক্রুসেডের বিরুদ্ধে সেই জিহাদে মুসলমানরা বিজয় অর্জন করে। ফলে শেখ সাদী(রহঃ) হন গাজী। বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সৃষ্টি তাঁর দুটি মহাগ্রন্থ গুলিস্তা এবং বোস্তা | জন্মের সাড়ে ৮০০ বছর পরও এ মহাকবি আজও অমর তাঁর কালজয়ী সাহিত্য কর্মের সুবাদে | তিনি ফারসি গদ্য ও পদ্য সাহিত্যে সবার শিরোমণি। আবার আরবিতে তাঁর পান্ডিত্য কত উঁচু মানের তা প্রমাণের জন্য এ চারটি চরণই যথেষ্ট। আল্লাহ পাকের হাম্দের পর রাসূলের পাকের (সা.) প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি অবতারণা করেছেন একটি চতুস্পদির। প্রায় সাড়ে আটশ বছর পরেও সেই চারটি লাইন হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশে আমরা ভক্তিভরে পাঠ করি, রাসূলের মহববতের সুধা পান করি। আমাদের মজলিস- মাহফিল তখন মদীনার প্রেমে গুলে গুলজার হয়। মদীনার বাগানের সমীরণ আমাদের মনপ্রাণ ছুঁয়ে যায়। আমরা জেগে উঠি, দুলতে থাকি ভক্তিতে, শ্রদ্ধায়, সালামে মদীনার সবুজ গম্বুজকে চেতনার মিনারায় দেখে দেখে- বালাগাল উলা  বেকামালিহী …      …                          …                      … অর্থ বুঝি না, অনেকেই বুঝে না। কিন্তু ছন্দ, দোল, ঝংকার, সুর ও ব্যঞ্জনা দোল দেয় মনে। রাসূল প্রেমের শিহরণ আনে প্রাণে। শেখ সাদীর লেখা এই না‘ত কিংবা দরূদ এ দেশের প্রতিটি মু’মিনের প্রাণপ্রিয় সংগীত, ভক্তকুলের গলার মালা। কিন্তু কী আছে এই চারটি লাইনে? এমন জনপ্রিয়তার রহস্য কোথায়?
          আলোচ্য দরূদ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল- শেখ সাদী (রহঃ) এই চতুষ্পদীর প্রথম তিন লাইন লেখার পর চতুর্থ লাইন মেলাতে পারছিলেন না। অনেক দিন-মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায়। শেখ সাদী (রহঃ) এখানে একটি সন্তোষজনক লাইন পেতে ব্যর্থ হন। এসময় তিনি রাছুলুল্লা­হ (সাঃ)কে স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে রাছুলুল্লা­হ (সাঃ) তাঁকে এই চতুর্থ লাইনে লিখে দিতে বলেন - সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি। ‘সাল্লু ’ মানে তোমরা দরূদ পাঠাও। আর ‘দরূদ’ অর্থ কারও জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করা। ‘আলাইহি’ তার প্রতি। ‘ওয়া’ মানে এবং, ও ‘আলিহী’ অর্থ তাঁর বংশধর। শেখ সা’দী স্বপ্নযোগে এ আদেশ পেলেন স্বয়ং হযরতের কাছ থেকে। একজন কবির জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে? এর চাইতে বড় গৌভাগ্য কী কল্পনা করা যায়! স্বয়ং নবীজির সাক্ষাৎ পাওয়া। যাঁর প্রশংসায় কবি তিনটি চরণ লিখছেন, স্বয়ং তিনি এসে চতুর্থ লাইন মিলিয়ে দেয়া। এভাবে রচিত হয় এই অসাধারণ না’তসহ দরূদটি। এভাবে এই চতুষ্পদীটি তৈরীতে সহায়তা করায় এটা বুঝা যায় যে, এটি রাছুলুল্লা­হ (সাঃ) -এর পছন্দনীয়।  এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে, যে কোন লোক স্বপ্নযোগে এভাবে কিছু পাওয়ার দাবী করলে তা সব সময় গ্রহণযোগ্য হয় না । কিন্তু শেখ সাদী (রহঃ) -এর মত একজন বিশ্ব বিখ্যাত আল্লা­হ্’র ওলী জানানোতে তা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সম্ভবত: এখানেই ‘বালাগাল উলার…’ জনপ্রিয়তার রহস্য নিহিত। নচেত এটি চার লাইনের একটি চতুস্পদী। সরল সহজ ভাষায় বর্ণনা। কবিত্বের অলংকার নাই, তত্ত্ব-দর্শনের মারপ্যাঁচ নেই। এত সহজ প্রকাশের এত বড় পাওয়া নিশ্চয়ই অকল্পনীয়। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এর বিশ্বজনীন স্বীকৃতি, সমাদর। সারা দুনিয়ার মুসলিমরা গায় এই বালাগাল উলা। নবীপ্রেমের সুধা পান করে এর সুরের ব্যঞ্জনায়। এই চতুস্পদীর অন্তরালে মহা নেয়ামত নহর  কাওসার, আবে হায়াত যমযম লুকিয়ে না থাকলে শত শত বছর ধরে এই না’তসহ দরূদ নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-কিশোর সবার গলার মালা হয়ে গীত হত না পরম ভক্তিতে- মসজিদে, মাহফিলে, দুনিয়ার সর্বত্র। সত্যিই নবী প্রেমের আরশি ‘বালাগাল উলা বি কামালিহী’।
          এই পর্যায়ে আমরা আলোচ্য দরূদটির অর্থ ও তাৎপর্য জেনে নেই। অনেকে অনুবাদ করেছেন, অনুবাদ করতে চেয়েছেন এই চতুস্পদী ফারসিতে, উর্দুতে বা বাংলায়। কিন্তু সার্থক অনুবাদ কোনটিই হয়নি। আমরা জানি, কবিতার অনুবাদ হয় না। আরও পরিষ্কারভাবে বলা যায়, কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তা অন্য ভাষায় হুবহু অনুবাদ করা যায় না। অনুবাদ করলেও দাবি করা যাবে না যে, কবি যা বলতে চেয়েছেন- বুঝিয়েছেন, তার সবটুকুই ভাষান্তর করতে পেরেছি। এ তো গেল ভাষা, ভাব ও অর্থের কথা। ছন্দ, ঝংকার ও ব্যঞ্জনা- যা কবিতার প্রাণ, তার রূপান্তর মোটেও সম্ভব নয়। তথাপি আমরা এখানে কিছু অনুবাদ উল্লে­খ করছি।  বালাগাল উলা বি-কামালিহি,/কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি,/হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি,/সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।। -এর মোটামুটি সরল অর্থ হলোঃ ১) পূর্ণতায় তিনি সুউচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন, ২) বিদুরিত হয়েছে সকল অন্ধকার তাঁর সৌন্দর্যের ছটায়, ৩) সম্মিলন ঘটেছে তাঁর মাঝে সকল উন্নত চরিত্রের, ৪) পেশ করুন তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি দরুদ ও সালাম |”  এর অনুবাদ . মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী করেন এভাবে: সুউচ্চ শিখরে সমাসীন  তিনি নিজ মহিমায় / তিমির-তমসা কাটিল  তার রূপের প্রভায়, / সুন্দর আর সুন্দর তার স্বভাব চরিত্র  তামাম / জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের ‘পরে দরূদ-সালাম।”  প্রখ্যাত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর “সকল প্রশংসা তাঁর” কাব্যগ্রন্থে এর রূপান্তর করেন এভাবে: তাবৎ পূর্ণতা নিয়ে শীর্ষে হয়েছেন উপনীত, / অপার সৌন্দর্যে তিনি আলো করেছেন তমসাকে, / আশ্চর্য চারিত্র তাঁর অতুলন সৌন্দর্যে মন্ডিত, / রাহমাতুল্লিল আ’লামীন-হাজার সালাম তাঁকে।।” অন্য একজন কবির রূপান্তর হলোঃ  অতি উচ্চতা মহিমা মহান পূর্ণগুণজ্ঞানে হে নবী / তব মাধুরীত অমর আঁধার বিদূরিত আজিরে সবি / অতীব সুন্দর অতীব সুন্দর তোমার সকল আচার ব্যবহারই /সহস্র সালাম উপরে তোমার হে নবী রাসূলে আরবি। (এই অনুবাদের কবির নাম জানা নাই। কেউ জানলে অনুগ্রহপূর্বক এই ই-মেইল এড্রেসে জানালে ভালো হয়: sohelict@gmail.com)

ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী  উক্ত চতুষ্পদীর অর্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরেন এভাবে: “আরবিতে ‘বালাগা’ অর্থ পৌঁছে গেছেন। ‘উলা’ মানে উচ্চতা। তাতে ‘বালাগাল উলা’ মানে তিনি পৌঁছে গেছেন উচ্চতার শীর্ষে, শিখরে। ‘বিকামালিহী’ এখানে বি অক্ষরটি হর্ফ বা অব্যয়। অর্থ হল সঙ্গ, সহ দ্বারা, দিয়া। ‘কামাল’ এর সঙ্গে ‘হী’ অক্ষরটি সর্বনাম। মানে ‘তার’। এখন দেখা যাক ‘কামাল’ অর্থ কী ? ‘কামাল’ আরবি শব্দ। আমরা ‘কামালিয়াত’ বলে একটি পরিভাষার সাথে পরিচিত। ‘কামাল’ ও কামালিয়াত এর অর্থ ‘পূর্ণতা’। এখান থেকেই কামেল- পূর্ণতাপ্রাপ্ত। যেমন বলা হয় লোকটি  কামেল। ‘কামাল’ এর আভিধানিক অর্থ পূর্ণতা। এই পূর্ণতা মানবীয় চরিত্রের, মানবিক গুণাবলির। মানুষ হিসেবে আমরা জীব। তবে অন্যান্য জীবজন্তু থেকে আমরা আলাদা। কারণ, আমাদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুণ আছে, যেগুলো অন্যান্য জীবের নেই। সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, পরোপকার, ত্যাগ, ধৈর্য প্রভৃতি মানুষের অনেক গুণ আছে যেগুলো অন্য প্রাণীর নেই। আবার এসব গুণ যে মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ বিদ্যমান, তিনি তত বড় মাপের মানুষ।

আমরা সাধারণত বলি ‘তিনি বড় লোক’। সাধারণভাবে তখন বুঝি, লোকটি বড় পয়সাওয়ালা অথবা অনেক ক্ষমতাধর। কিন্তু এই গুরুত্ব যতদিন ক্ষমতায় থাকে বা পয়সার মালিক থাকেন, ততদিন। ক্ষমতা হারালে, পয়সা ফুরালে ফুটো বেলুনের মত চুপসে যান। কিন্তু যারা মানবীয় গুণাবলিতে পূর্ণতার অধিকারী তাঁরা সর্বদা আমাদের কাছে স্মরণীয়-বরণীয়। আর সত্যিকার ‘বড় লোক’ হওয়ার মাপকাঠিও হচ্ছে এসব গুণে গুণবান হওয়া। এই গুণ যখন পূর্ণতায় পৌঁছে তখন তাকে কামাল বা কামালিয়াত বলা হয়। আর লোকটিকে বলা হয় কামেল। এমনও হতে পারে যে, কারও মধ্যে দু’একটি গুণ পূর্ণতায় পৌঁছে। যেমন দানশীল হিসেবে আমরা হাতেম তাঈ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিনের কথা বলতে পারি। বীরত্বের বিচারে হযরত আলী (রা.), খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) প্রমুখের উদাহরণ আনতে পারি। আধ্যাত্মিকতায় বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রা.) বা খাজা আজমিরী (রা.)-এর প্রসঙ্গ আসতে পারে। কিন্তু সকল মানবীয় গুণের চূড়ামত্ম পর্যায়ের গুণান্বিত একজন মাত্র মানুষকেই পাওয়া যাবে পৃথিবীর ইতিহাসে। তিনি হচ্ছেন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। শেখ সা’দী সে কথাই বলছেন প্রথম চরণে- ‘বালাগাল উলা বি কামালিহী’- সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন তিনি নিজ কামালিয়াতে, মানবীয় গুণাবলির পূর্ণতায় তিনি উচ্চতার স্বর্ণ শিখরে উপনীত, সুউচ্চ শিখরে সমাসীন  তিনি আপন মহিমায়।
পরের চরণটিতে বলেছেন, ‘কাশাফাদ দুজা বি জামালিহী’। ‘কাশাফা’-এর মূল ধাতু ‘কাশ্ফ্’ অর্থ খোলা, প্রসারিত হওয়া। ‘দুজা’ অর্থ ঘন-অন্ধকার, দিনের শেষে রাত নামলে পৃথিবী অাঁধারে ছেয়ে যায়। তবুও আকাশে চাঁদ আর তারারা ভাসলে মিটিমিটি আবছা আলোর রেখা আঁচ করা যায়। কিন্তু যদি রাতটি হয় অাঁধিয়ারার, অমাবশ্যার রাত, মুষলধারে বৃষ্টি, চারদিকে ঘোর অমানিশা, তখন নিজের হাতটিও দেখা সম্ভব নয়।। ‘দুজা’ বলতে সেই অমানিশা ও ঘন-অন্ধকারকেই বুঝানো হয়। বি অব্যয় মানে দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক। ‘জামাল’ এর পরে ‘হী’ হল সর্বনাম। ‘জামাল’ শব্দটিও ‘কামাল’-এর সমার্থক। অর্থ: রূপ, সৌন্দর্য। তবে দৈহিক সৌন্দর্যের সাথে চরিত্রের সৌন্দর্য মিলিত হয়ে যে অপরূপ কামিত্ম ফুটে ওঠে তাকেই বলা হয় কামাল, মহিমা। তাহলে দাঁড়ায় ‘অাঁধার দূরিভূত হল তার সৌন্দর্য মহিমায়। অাঁধিয়ারা অমানিশা তিরোহিত হল তার রূপের আভায়, তিমির-তমসা কাটিল  তার সৌন্দর্যের প্রভায় ।
‘জামাল’ (সৌন্দর্য) বুঝতে হলেও বিষয়টি একটু খোলাসা করা দরকার। মানুষের সৌন্দর্য বুঝার একটি লক্ষণ তার গায়ের রং। তবে শুধু গায়ের রং ফর্সা, চেহারা হলুদাভ, চাঁদের বরণ টুকটুকে হলেই সুন্দর বলা যাবে না। দেহের গড়ন, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিমিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া অনিবার্য শর্ত। তার পরে চেহারায় মমতার আবরণ, ব্যক্তিত্বের আভা, গাম্ভীর্যের ছাপ, কথা-বার্তার ওজন সবকিছু মিলিয়ে ঠিক করা হবে কোন্ মানুষ কতখানি সুন্দর। কাজেই আসল সুন্দর মানুষের রঙ, রূপ, দৈহিক গঠনে, গড়নে নয়; বরং চরিত্রে। এই চরিত্রই চাঁদ সূরুজের মত আলোকোজ্জ্বল করে লোকটিকে। তখন তার চরিত্র মাধুর্য আলো বিকিরণ করে চারদিকে। সমাজ থেকে দূর করে সকল অসুন্দর-অমঙ্গল।
ধরুন, রাতের আকাশে চাঁদ নেই, দিনের বেলা সূর্যও নেই। তখন মানব সমাজ হবে ভুতুড়ে জনপদ। আমরা এখন যন্ত্র সভ্যতার যাঁতাকলে বিদ্যুৎ নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত। মনে করুন, বিশাল ঢাকা মহানগরীতে কোন দুর্ঘটনায় একটানা কয়েক দিন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। জেনারেটরগুলোও দিন দুয়েক ঝনঝন করে পরে থেমে গেছে। রাত নেমেছে। ঘোর অন্ধকার চারদিকে, চোর ডাকাতের তান্ডব। রাস্তায় বের হওয়া দায়। প্রাণ নিয়ে উৎকণ্ঠা। বর্তমানে তো আলো বিদ্যুৎ থাকা অবস্থায়ও প্রাণের বা সম্পদের নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে। তার ওপর যদি বিদ্যুৎ  একেবারে না থাকে, তাহলে দুর্যোগের ভয়াবহতা কি অনুমান করা যায়? দেখা গেল ঘোর অমানিশা, অরাজক হাহাকারের মধ্যে একদিন নিশিরাতে হঠাৎ বিদ্যুৎ এসে গেল, বাতি জ্বলল। এসি, ফিরুজ চালু হল, যানবাহন রাস্তায় নামল, তখন চারদিকে আনন্দের কোলাহল দেখা দেবে নিশ্চয়। হযরতের আগমনও এই বিদ্যুতের ঝলকানীর মত, মধ্য আকাশে চন্দ্র বা সূর্যের আলোর বন্যার ন্যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
‘ক্বাদ জাআকুম মিনাল্লাহি নূরুন ওয়া কিতাবুন মুবীন’
‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে এসে গেছে আল্লাহর পক্ষ হতে মহান নূর এবং একটি উজ্জ্বল কিতাব।’’
এই আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত হয়েছে মুসলিম সমাজ, গোটা বিশ্ব মানবতা। ইতিহাসে হযরতের আগমন-পূর্ব যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বলা হয়। অজ্ঞতার যুগ, অন্ধকার যুগ। কেন অন্ধকার যুগ বলা হবে? তখন কি আকাশে দিনের বেলায় সূর্য, রাতে চাঁদ-তারারা ছিল না? অজ্ঞতার যুগ বলা হবে কোন্ যুক্তিতে? সাহিত্যে-কবিতায়, সঙ্গীতে আরবরাই তো দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল, এখনও শ্রেষ্ঠ। এজন্যই তো তারা অনারবদের বলতে পারত আজমী- বোবা। তাহলে আসল কারণটি কেথায়? এই অন্ধকার ও অজ্ঞতা ছিল মানব চরিত্রের চরম অধঃপতনের। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানীকে তখন মনে করা হত অর্থ উপার্জনের বৈধ পন্থা। এখন যেমন চোরাকারবার ও শেয়ার বাজার লুট করা ধনী হওয়ার বৈধ (?) ব্যবস্থা বলে স্বীকৃত। তখন মদ, জুয়া বেশ্যাবৃত্তির ছাড়াছড়ি ছিল সর্বত্র। অবশ্য মেয়েরা তখনও মাথায় কাপড় দিত। বর্তমানের ন্যায় উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ ছিল না। নারীর মর্যাদার অবনতি কতখানি হয়েছিল তার একটি প্রমাণ, কারও ঘরে মেয়ে শিশু জন্ম নিলে অপমানের ভয়ে পিতা নিজে গিয়ে জীবিত শিশুটিকে করব দিয়ে আসত। সেই অন্ধকার যুগে হযরত এসে সৌন্দর্য বিতরণ করলেন, আলো ছড়ালেন। হানাহানি, রক্তপাতের পরিবর্তে মুসলমানরা ভাই ভাই শিক্ষা দিলেন, মেয়ে সমত্মান বেহেশতের সারথি- এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করলেন। মায়ের পায়ের তলায় বেহেশত- এই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হল মুসলমান। প্রেম মমতা, ত্যাগ, পরোপকার, যাকাত প্রভৃতির মাধ্যমে মায়া-মমতার একটি বেহেশতী সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর এই শিক্ষা ও চরিত্রের সৌন্দর্যের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে ভারতবর্ষেও আমাদের পূর্ব-পুরুষরা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল সেই সৌন্দর্য মহিমায় মুগ্ধ হয়ে।
একজন গবেষক বলেছেন : দুনিয়ার বুকে মানব সমাজে যেখানে যতটুকু নৈতিক শিক্ষা বা মানবীয় চরিত্রের সৌন্দর্য বিদ্যমান তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হযরতের শিক্ষার কাছে ঋণী। কারণ, অন্য কোন মহাপুরুষের নৈতিক শিক্ষা জগতে অত অবিকৃতভাবে বিদ্যমান নেই। তাই অন্য জাতির মাঝে ন্যায়বোধ, সততা, মানবপ্রেম, স্বার্থ ত্যাগের যেসব শিক্ষা বিদ্যমান তা তারা ইসলামের নবীর কাছ থেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ পাক নিজে হযরতের এই অনুপম চরিত্রের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন:
‘‘আপনি মহান চরিত্র আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’’
মহানবী (সা.) নিজেই বলেছেন
‘‘আমি সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’’
বস্ত্তত শেখ সা’দী ‘জামাল’ বলতে হযরতের এই চরিত্র সুষমাকেই বুঝিয়েছেন। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে তিনি গেয়েছেন : ‘কাশাফাদ দুজা বে জামালিহী’- তার রূপে অপসারিত মানব সমাজের ঘন অমানিশা। ‘তিমির-তমসা কাটিল  তার সৌন্দর্যের প্রভায়’।
তৃতীয় পঙ্ক্তিতে তিনি উপসংহার টেনে বলছেন, আসলে হযরতের প্রশংসা-তারিফ কীভাবে করব? তাঁর চারিত্রের, শিক্ষার, ব্যক্তিত্বের কোন্ দিকটি নিয়ে বলব ? মাওলানা সুলাইমান নদভী সাহেবের একটি বক্তৃতা সংকলন পড়েছিলাম, ‘পয়গামে মুহম্মাদী’ নামে ।  সেখানে মাওলানা সুলাইমান নদভী হযরতের চরিত্র মাধুর্য বিশেষণ করতে গিয়ে বলেছেন : হযরত (সা.) ছিলেন সর্বযুগের সব মানুষের সুন্দরতম আদর্শ। কেউ যদি আদর্শ স্বামী হতে চায়, তাহলে হযরত খাদিজা ও আয়েশা (রা.)-এর আদর্শ স্বামী মুহাম্মাদুর রাসূলুলাহ তার জন্য আদর্শ। কেউ যদি রাষ্ট্রনায়ক হয় তার জন্য আদর্শ হচ্ছেন মদীনার রাষ্ট্রনায়ক মহানবী (সা.)। সেনাপতি ও যোদ্ধার জন্য মহান আদর্শ হলেন বদর-উহুদের মহান সেনাপতি। দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য আদর্শ, মা হালিমার কোলের শিশু মুহাম্মদ। এভাবে মানব জাতির প্রতিটি অংশের জন্য সুন্দর চরিত্র ও উদাহরণ রয়েছে মহানবীর জীবনে। কুরআন মাজীদে তাই বলা হয়েছে :
তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে সুন্দরতম আদর্শ রয়েছে।
হযরতের জীবনের এসব দিক, গুণ-বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যে শেখ সা’দী আত্মহারা। তিনি সে কথাই ব্যক্ত করেছেন প্রেম-ভালবাসার ডালা সাজিয়ে- হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহী- ‘তার সকল স্বভাব আচরণই সুন্দর, সুন্দর আর সুন্দর তার স্বভাব চরিত্র  তামাম।’
‘হাসুনাত’ মানে সুন্দরে পরিপূর্ণ, সুন্দর আর সুন্দর। ‘জামীয়ু’ অর্থ সকল, যাবতীয়। ‘খিসাল’ হচ্ছে ‘খাসলত’ এর বহুবচন। খাসলত শব্দের মূল অর্থ স্বভাব, আচার-ব্যবহার বা চরিত্র। ‘হী’ অক্ষরটি সর্বনাম। অর্থাৎ হযরতের সকল চরিত্রই সুন্দর আর সুন্দর। এই তিনটি চরণে শেখ সা’দী হযরতের পুরো জীবনের একটি স্কেচ এঁকেছেন। একবার একজন বড় শিল্পী এক পত্রিকা অফিসে এসে কলমের অাঁচড় কেটে নজরুলের একটি স্কেচ অাঁকেন। সেটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। দেখলাম, দু’তিনটি ছোট্ট রেখা। শিল্পীকে মোটেও বেগ পেতে হয়নি এটি আঁকতে। অথচ রাছুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্দর অবয়বের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাতে। পূর্ণ ছবি না হলেও এই দু’তিনটি রেখাতেই পুরো রাছুলুল্লাহ (সাঃ)-এর যেন হাসছেন। দক্ষ হাতের কারিশমা এখানেই। শেখ সা’দীর রচনায়ও হযরতের পূর্ণাঙ্গ তারিফ হয়নি, কারও পক্ষে সম্ভবও নয়; কিন্তু স্কেচের মত তিনটি চরণে যেন আমাদের মনের পর্দায়, চোখের সামনে ভেসে ওঠে হয়রতের অপূর্ব অনুপম চরিত্র মাধুরী। তাই ভক্তিতে, আসক্তিতে আপ্লুত হৃদয়ে শেখ সা’দীর কণ্ঠে কণ্ঠ রেখে আমরা গেয়ে পরম তৃপ্তি পাই-‘বালাগাল উলা… ’
                   বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আলোচ্য চতুষ্পদীটি অবলম্বনে একটা না’ত রচনা করেছেন। না’তটি হলঃ
কুল মখলুক গাহে হযরত
বালাগাল উলা বেকামালিহী।
অাঁধার ধরায় এলে আফতাব
কাশাফাদ দুজা  বেজমালিহী \

রৌশনীতে আজো ধরা মশগুল
তাইতো ওফাতে করি না কবুল,
হাসনাতে আজো উজালা জাহান
হাসুনাত জমিউ খেসালিহী \

নাস্তিরে করি’ নিতি নাজেহাল
জাগে তাওহীদ দ্বীন-ই কামাল
খুশবুতে খুশী দুনিয়া বেহেশত
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী \

কাজী নজরুল ইসলামের না’তটি সম্পর্কে ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী বলেনঃ ‘‘নজরুল যা করেছেন তাকে অনুবাদ না বলে নতুন নির্মাণ, নব সৃষ্টি বললেই সুন্দর হবে। অর্থাৎ তিনি নিজেই বাংলায় বালাগাল উলা রচনা করেছেন। যার মধ্যে শেখ সা’দীর বর্ণনার আবহ আছে। বাংলা ভাষার গাথুনীতে ফারসি-আরবি শব্দের মুক্তমালা গ্রথিত হয়েছে। সব মিলে ভাব, ভাষা, ছন্দ, ঝংকারে অসামান্য অনুবাদ, কিংবা বলব নব নির্মিত বাংলা বালাগাল উলা। নজরুল গেয়েছেন-
কুল মখলুক গাহে হযরত
বালাগাল উলা বেকমালিহী
প্রথম লাইনের চারটি শব্দের তিনটিই আরবি ও ফারসি। অথচ একটি বাংলা শব্দ দিয়ে তিনটি শব্দই বাঙময় হয়েছে। সারা সৃষ্টি জগৎ হযরতের প্রশংসা গীতি গায়। শেখ সা’দীর কণ্ঠে যেন গোটা বিশ্ব বলে:
অাঁধার ধরায় এলে আফতাব
কাশাফাদ দুজা  বেজমালিহী
শেষের লাইনের আমরা অর্থ করেছি ঘন অমানিশা দূরিভূত হয়েছে তার সৌন্দর্য মহিমায়, ‘তিমির-তমসা কাটিল  তার সৌন্দর্যের প্রভায় ।’ নজরুলের নব নির্মাণে দেখুন ব্যঞ্জনাটি কী রকম! আপনি আফতাব- দেদীপ্যমান সূর্য। অাঁধার পৃথিবীতে আপনি এসেছেন। সূর্যের সাথে নবীজিকে তুলনা করে বুঝিয়েছেন, সূর্য উদিত হলে যেমন সব অন্ধকার দূরীভূত হয়ে জগৎ আলোর বন্যায় ভাসে তেমনি আপনার আগমনেও সকল তমসার অবসান হয়ে আজ জগৎ উজালা হয়েছে।
রৌশনীতে আজো ধরা মশগুল
তাই তো ওফাতে করি না কবুল।
আপনার রৌশনী, আলো, ঔজ্জল্য-দীপ্তি এখনও ফুরায়নি। গোটা পৃথিবী, এই ধরাধাম আপনার রৌশনীতে, আলোতে মশগুল, বিভোর, সমাহিত। জগতে যত মায়া-দয়া-মনুষত্ব আছে, সব আপনার অবদান। তাই আপনার ওফাত আমি কবুল করি না। অপনি আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন, অমত্মর্ধান হয়েছে, একথা আমি মানি না।
হাসনাতে আজো উজালা জাহান
হাসুনাত জমিউ  খেসালিহী
‘হাসনাতে’ সৌন্দর্য সুষমায় এখনও জগৎ উজালা। আপনার সকল স্বভাব-চরিত্র সুন্দর, অনুপম, উজ্জ্বল। আপনার আনীত শিক্ষা ও আদর্শের মূল পাঠ কোন্টি, সেখানে চলে গেছে এখন নজরুলের সন্ধানী মন। বলেছেন-
নাস্তিরে করি’ নিতি নাজেহাল
জাগে তাওহীদ দ্বীন-ই কামাল
কালেমার দু’টি অংশ তাওহীদ ও রেসালাত। তাওহীদের দু’টি অংশ। একটি শির্ককে অস্বীকার করা, তারপর আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা। নজরুল বলেন, হযরতের আনীত শিক্ষায় নাস্তি, নাস্তিকতা নিত্য নাজেহাল হয়ে চলেছে। নাস্তিকতার অস্তিত্ব বিশ্বে  বিপন্ন। এর পক্ষে শক্ত কোন যুক্তি পৃথিবীতে এখন আর নেই। সর্বত্র জেগে উঠছে তাওহীদ- একত্ববাদ, একেশ্বরবাদ; এটিই পূর্ণাঙ্গ দ্বীন- দ্বীন-ই কামাল। কামালিয়াত লাভের ধর্ম এটিই। মানবীয় গুণাবলির বিকাশ চাইলে, মানব জীবনে পূর্ণতা পেতে হলে এই দ্বীনের কোন বিকল্প নাই। সেই দ্বীনের ডঙ্কা আজ দুনিয়ার দিকে দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত।
খুশবুতে খুশী দুনিয়া বেহেশত
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।
হযরতের আনীত আদর্শ, চরিত্রের সৌন্দর্য সুষমা, মানুষত্বের শিক্ষার খুশবুতে সারা দুনিয়া আজ মাতোয়ারা। সকল ভাবুক, মহাপুরুষ তাঁর উদ্দেশ্যে ভক্তি অর্ঘ নিবেদন করে। মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত আযানে, নামাযে তাঁরই মহিমা ঘোষণা করে। তাঁর প্রতি সালাম জানায়, দরূদ পাঠায়। দুনিয়া সেই খুশবুতে আনন্দে মাতোয়ারা, নজরুলের চেতনায় দুনিয়াটাই বেহেশতে পরিণত হয়েছে। কাজেই যাঁর আগমনে, যাঁর অবদানে মানব জাতি, গোটা সৃষ্টি এমন সৌভাগ্যবান তাঁর প্রতি ও তাঁর বংশের প্রতি হাজারো দরূদ ও সালাম।’’ কাজী নজরুল ইসলামের না’তটি সম্পর্কে মোস্তফা জামান আব্বাসী বলেনঃ ‘‘ধারণা করি, শেখ সাদি রচিত আকাশউচ্চ বচন ‘বালাগাল উলা’-এর পর নজরুল যে স্তবক তিনটি উপহার দিয়েছেন, সাদির রচনার সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক মূল্যের চেয়েও তা কোনো অংশে কম নয়।’’ 
  
                  এ পর্যায়ে এর বিরোধিতার জবাব দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে কিছূ উগ্রপন্থী বলছে, এই না’তসহ দরূদটি পড়লে গুনাহ হবে। কোন কোন সৌদি আলেম বলেছেন- এখানে কামাল(পূর্ণতা)-এর কথা বলা হয়েছে। কামাল আল্লাহ্’র জন্য। এজন্য এতে শিরকের গন্ধ পাওয়া যায়। এর জবাব হল- শিরকের বিষয়ে সতর্কতা ভালো, তবে যা শিরক নয় তাকে শিরক বলাও অপরাধ। এটা বড় ধরণের মিথ্যা অপবাদ এবং দ্বীনের বিকৃতিসাধনও অবশ্যই।  এখানে রাছুলুল্লাহ (সাঃ) ক্ষেত্রে পূর্ণতা হলো - মানবীয় চরিত্র ও আদর্শের পূর্ণতা, আধ্যাত্মিক উন্নতির পূর্ণতা, আল্লাহ্’র নৈকট্যের পূর্ণতা ইত্যাদি আল্লাহ্’র রাছুল হিসাবে পূর্ণতার যতদিক আছে তার সবকিছুতে রাছুলুল্লাহ (সাঃ) সুউচ্চ পর্যায়ে আরোহন করেছেন। এখানে শিরকের গন্ধ পাওয়া আশ্চর্জজনক এবং দুঃখজনকও। এখানে উপরে উক্ত পূর্ণতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহঃ)-এর ‘পয়গামে মুহাম্মদী’ গ্রন্থে এই পূর্ণতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। (বিশ্বখ্যাত ‘পয়গামে মুহম্মাদী’ গ্রন্থটি বর্তমানে আবদুল মান্নান তালিবের অনুবাদে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশনা বিভাগের দ্বারা প্রকাশিতঃ ফোন নং-৮৩৫৮৯৮৭, ৯৩৩১২৩৯ -ঢাকা।) আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) বলেন,“ইসলামী ইতিহাসের দৃশ্যপটে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান এবং উন্নত ব্যক্তিত্ব এতটা সমুজ্জ্বল পরিদৃষ্ট হয় যে, শুরু থেকে আজ অব্দি বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যাদেরকে বিশ্ব জাহানের নায়ক (Heroes) হিসেবে গণ্য করা হয় সকলেই তাঁর মোকাবিলায় তুচ্ছ বলে প্রতীয়মান হয়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তিও নেই যার পূর্ণতার দ্বীপ্তি মানব জীবনের দুএকটি বিভাগ থেকে সম্মুখে অগ্রসর হতে পেরেছে। কেউ দর্শনের সম্রাট কিন্তু বাস্তব কর্মক্ষমতা বর্জিত। কেউ আমলের প্রতিভু কিন্তু চিন্তা শক্তিতে দুর্বল। কারো পূর্ণতা রাজনৈতিক কলাকৌশল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ সামরিক প্রতিভার আধার। কারো দৃষ্টি সামাজিক জীবনের এতটা গভীরে নিবদ্ধ যে অন্যান্য দিকগুলো দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। কেউ আবার নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। মোটকথা ইতিহাসের সর্বত্রই কেবল একরোখা নায়কই পরিদৃষ হবে। কিন্তু মহানবী (সা.) এমন এক ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে সমস্ত পূর্ণতার গুণাবলী পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। তিনি নিজেই একজন দার্শনিক, একজন বিজ্ঞানী যিনি স্বীয় দর্শনকে তাঁর নিজের কর্মজীবনে বাস্তবায়নকারী, একজন রাজনৈতিক কৌশলী, সমর নায়ক, আইন প্রণেতা, নৈতিকতা বিনির্মাণকারী। তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা (Civilization) সৃষ্টি করে দেখিয়ে দেন। জীবনের সকল দিক বিভাগের মধ্যে এমন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন যাতে অতিরঞ্জনের কোন নাম নিশানা পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয় না” (http://www.weeklysonarbangla.net, ১৮ মার্চ ২০১১) অন্যদিকে বিচার করলে উক্ত শিরকের গন্ধের অভিযোগ হাস্যস্পদও। হৃদয়ঙ্গম করতে সুবিধার জন্য একটা দৃষ্টান্ত দেয়া হচ্ছে- কোন একটা বিদ্যালয়ে একজন পরিদর্শক আসলো। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরিদর্শককে একটি ছাত্রকে দেখিয়ে বললেন- এ ছেলেটি সর্বশ্রেষ্ঠ। তখন পরিদর্শক প্রধান শিক্ষককে বললেন - আপনি কেন এ ছেলেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বললেন? সর্বশ্রেষ্ঠ তো আল্লাহ। এখানে শিরকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এখানে পরিদর্শকের কথা যেমন হাস্যস্কর ঠিক তেমনি কামাল শব্দের মধ্যে শিরকের গন্ধ পাওয়াও হাস্যষ্পদ। এসব শব্দতো নিতান্তই আপেক্ষি। মাওলানা কামালউদ্দিন জাফরীকে উক্ত শিরকের গন্ধ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি সৌদি আলেমদের সমমনা হলেও এ বিষয়ে বললেন- আমি এটা শিরক মনে করি না। এটা আপেক্ষি কেউ “বালাগাল উলা বি-কামালিহি” লিখে ইউটিউবে সার্চ দিলে মাওলানা কামালউদ্দিন জাফরীর সম্পূর্ণ বক্তব্য জানতে পারবেন। এখানে ভিডিওটি দেয়া হলঃ 
ইসলামী ইতিহাসের দৃশ্যপটে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান এবং উন্নত ব্যক্তিত্ব এতটা সমুজ্জ্বল পরিদৃষ্ট হয় যে, শুরু থেকে আজ অব্দি বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যাদেরকে বিশ্ব জাহানের নায়ক (Heroes) হিসেবে গণ্য করা হয় সকলেই তাঁর মোকাবিলায় তুচ্ছ বলে প্রতীয়মান হয়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তিও নেই যার পূর্ণতার দ্বীপ্তি মানব জীবনের দু’একটি বিভাগ থেকে সম্মুখে অগ্রসর হতে পেরেছে। কেউ দর্শনের সম্রাট কিন্তু বাস্তব কর্মক্ষমতা বর্জিত। কেউ আমলের প্রতিভু কিন্তু চিন্তা শক্তিতে দুর্বল। কারো পূর্ণতা রাজনৈতিক কলাকৌশল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ সামরিক প্রতিভার আধার। কারো দৃষ্টি সামাজিক জীবনের এতটা গভীরে নিবদ্ধ যে অন্যান্য দিকগুলো দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। কেউ আবার নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। মোটকথা ইতিহাসের সর্বত্রই কেবল একরোখা নায়কই পরিদৃষ্ট হবে। কিন্তু মহানবী (সা.)ই এমন এক ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে সমস্ত পূর্ণতার গুণাবলী পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। তিনি নিজেই একজন দার্শনিক, একজন বিজ্ঞানী যিনি স্বীয় দর্শনকে তাঁর নিজের কর্মজীবনে বাস্তবায়নকারী, একজন রাজনৈতিক কৌশলী, সমর নায়ক, আইন প্রণেতা, নৈতিকতা বিনির্মাণকারী। তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা (Civilization) সৃষ্টি করে দেখিয়ে দেন। জীবনের সকল দিক বিভাগের মধ্যে এমন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন যাতে অতিরঞ্জনের কোন নাম নিশানা পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয় না। - See more at: http://www.weeklysonarbangla.net/news_details.php?newsid=879#sthash.9vHvaagf.dpufঅন্যদিকে এটি হাস্যস্পদও। হৃদয়ঙ্গম করতে সুবিধার জন্য একটা দৃষ্টান্ত দেয়া হচ্ছে-
 
ইসলামী ইতিহাসের দৃশ্যপটে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান এবং উন্নত ব্যক্তিত্ব এতটা সমুজ্জ্বল পরিদৃষ্ট হয় যে, শুরু থেকে আজ অব্দি বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যাদেরকে বিশ্ব জাহানের নায়ক (Heroes) হিসেবে গণ্য করা হয় সকলেই তাঁর মোকাবিলায় তুচ্ছ বলে প্রতীয়মান হয়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তিও নেই যার পূর্ণতার দ্বীপ্তি মানব জীবনের দু’একটি বিভাগ থেকে সম্মুখে অগ্রসর হতে পেরেছে। কেউ দর্শনের সম্রাট কিন্তু বাস্তব কর্মক্ষমতা বর্জিত। কেউ আমলের প্রতিভু কিন্তু চিন্তা শক্তিতে দুর্বল। কারো পূর্ণতা রাজনৈতিক কলাকৌশল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ সামরিক প্রতিভার আধার। কারো দৃষ্টি সামাজিক জীবনের এতটা গভীরে নিবদ্ধ যে অন্যান্য দিকগুলো দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। কেউ আবার নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। মোটকথা ইতিহাসের সর্বত্রই কেবল একরোখা নায়কই পরিদৃষ্ট হবে। কিন্তু মহানবী (সা.)ই এমন এক ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে সমস্ত পূর্ণতার গুণাবলী পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। তিনি নিজেই একজন দার্শনিক, একজন বিজ্ঞানী যিনি স্বীয় দর্শনকে তাঁর নিজের কর্মজীবনে বাস্তবায়নকারী, একজন রাজনৈতিক কৌশলী, সমর নায়ক, আইন প্রণেতা, নৈতিকতা বিনির্মাণকারী। তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা (Civilization) সৃষ্টি করে দেখিয়ে দেন। জীবনের সকল দিক বিভাগের মধ্যে এমন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন যাতে অতিরঞ্জনের কোন নাম নিশানা পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয় না। - See more at: http://www.weeklysonarbangla.net/news_details.php?newsid=879#sthash.9vHvaagf.dpuf  
 
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

আগের বর্ণনায় জেনেছি এবং এখন এখানে ভিডিওতে জানলাম যে, রাছুলুল্লাহ (সাঃ) উক্ত চতুষ্পদীটি রচনায় শেখ সাদীকে স্বপ্নযোগে সাহায্য করেছেন। বুঝা যায়, উক্ত চতুষ্পদীর প্রথম তিন লাইন রাছুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পছন্দ হওয়াতে তিনি স্বপ্নযোগে চতুর্থ লাইন রচনায় সাহায্য করেছেন -এতে সম্পূর্ণ চতুষ্পদীটি মহান গৌরব অর্জন করে। এটা বিস্ময়ের বিষয় হলো,  রাছুলুল্লাহ (সাঃ) পছন্দ ও সাহায্যধন্য সেই চতুষ্পদীতে কিছু ব্যক্তি শিরকের গন্ধ খুঁজে পেলেন! েক্ষাভের সাথেই বলতে হয়, তারা কি রাছুলুল্লাহ (সাঃ)-এর চেয়েও বেশী তৌহিদ-শিরক বুঝেন? তারা নিঃসন্দেহে ভুল করেছেন এবং উপরে দেখিয়েছি, সেটা হাস্যস্পদ ভুল। বরং এর বিপরীতে রাছুলুল্লাহ (সাঃ) -এর ‘কামালিয়াত’ (পূর্ণতা)-’র ধারণা দ্বীন ইসলামের একটি চুড়ান্ত সত্য এবং ঈমানের অনিবার্য দাবী। কলেমা তাইয়্যেবা অনুসারে একমাত্র আল্লাহ্’র গোলাম ও রাছুলুল্লাহ(সাঃ) -এর উম্মত (অনুসারী) হওয়ার অনিবার্য দাবী হলো রাছুলুল্লাহ(সাঃ) প্রদর্শিত জীবনাদর্শ  পরিপূর্ণ হওয়া। এর অস্বীকৃতি বড় ধরণের শিরক এবং কুফর। আল্লাহ্ প্রদত্ত এবং  রাছুলুল্লাহ(সাঃ) প্রদর্শিত পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠাই মু’মিন জীবনের চরম লক্ষ্য।  বর্তমান মুসলিম সমাজের প্রাথমিক এবং প্রধান সমস্যা হলো রাছুলুল্লাহ(সাঃ) প্রদর্শিত জীবনাদর্শকে  পরিপূর্ণ হিসাবে না মানা।  আল্লাহ্ প্রদত্ত এবং  রাছুলুল্লাহ(সাঃ) প্রদর্শিত জীবনাদর্শকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের দালাল রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ইত্যাদির চরম দুশমন।  সম্মিলিত ইউরোপের ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জেহাদে বিজয়ী বীর মুজাহিদ শেখ সাদী (রহঃ) এই আলোচ্য চতুষ্পদীতে রাছুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কামালিয়াতের (পূর্ণতার) কথা বলে বিশ্ব-মুসলিম এবং বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের পরমপ্রিয় সত্যকেই প্রকাশ করেছেন। বিরোধিতার কারণে রাছুলুল্লাহ (সাঃ) পছন্দ ও সাহায্যধন্য আলোচ্য চতুষ্পদীর জনপ্রিয়তাই বৃদ্ধি পাবে, ইনশাল্লাহ॥ এ চতুষ্পদীর বিষয়ে অগভীর চিন্তা ও বিদ্বেষ প্রসূত  তাদের আরো অভিযোগ আছে। আলোচ্য চতুষ্পদী সম্পর্কে ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর উপরের আলোচনায় তার জবাব আছে।  তাই এখানে আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম।  আল্লাহ্ সবাইকে হেদায়াত করুন। যাদের অধিক জবাব জানার প্রয়োজন তারা এই লিংকটি ব্রাউজ করুন:  'বালাগাল 'উলা বি কামালিহী' দো'আটি পাঠ করা যাবে কি? জবাব দানে: :  


                   প্রসঙ্গক্রমে দরূদের গুরুত্ব সম্পর্কে ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী বলেনঃ ..........এ আদেশ তো নবী (সা.)-এর নয়; স্বয়ং আল্লাহর। এ কারণে দরূদ শরীফ আল্লাহর নিখাদ ইবাদাত রূপে গণ্য। আমরা দরূদ পড়ছি আল্লাহর নবীর প্রতি; অথচ গণ্য-গৃহীত হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত হিসেবে। বিষয়টি খুবই চমৎকার। এ আদেশও কত তাৎপর্যপূর্ণ, একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই বোধগম্য হবে। তাফসীরে কাশফুল আসরারের গ্রন্থকার বলেন, কুরআন মাজীদে দু’টি বিষয়কে আল্লাহ তা’আলা নিজে করেন, ফেরেশতারা করেন ও মুমিন মুসলমানরা করেন আর করণীয় বলে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত বা অন্য কোন আমলের ক্ষেত্রে এমন নিয়মের কথা উলেখ নাই। এর একটি হল আল্লাহর তাওহীদের সাক্ষ্য, অপরটি রাসূলে পাকের প্রতি দরূদ। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন :
আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ (উপাস্য ও প্রভু) নেই। আর ফেরেশতারাও একই সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
আল্লাহর তাওহীদকে স্বীকার করেই আমরা মুসলমান। সেই তাওহীদের সাক্ষ্যের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ ও ফেরেশতাকুল শামিল থাকা নিশ্চয়ই এর অতুলনীয় গুরুত্বের পরিচায়ক। অনুরূপ নবীজির প্রতি সালাত ও সালামের বেলায় কুরআন মাজীদের ভাষ্য :
নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাকুল সালাত পাঠায় নবীর ওপর। কাজেই হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার ওপর যথাযোগ্য মর্যাদায় সালাত পাঠাও, আর সালাম জানাও।
এই নির্দেশের প্রতিটি অক্ষর ও বর্ণনাশৈলী নিয়ে চিন্তা করলে অবাক হতে হয়। আল্লাহর নবী এসেছেন, তাঁকে দেখে দেখে যেন মানুষ অনুসরণ করে। জীবন সুন্দর হয় ও পরকালীন জীবনে সাফল্য আসে। এখানে দরূদ.তারিফ বা মহববতের এত তাগাদা কেন-প্রশ্ন আসতে পারে। আসলে সেই আনুগত্য ও অনুসরণের অনুভূতি তাৎপর্যময় হওয়ার জন্যই প্রয়োজন তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসা পোষণ করা, তাঁর তারিফ করা ও সকাল-সন্ধ্যা বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়া। আয়াতের শেষে ‘তাসলীমা’ শব্দটি তাগিদ বুঝানোর জন্য মাফউলে মুতলাক। তার মানে যথাযোগ্য সম্মান সহকারে। কেন এই নির্দেশ? ইবনে আববাস (র) এর মতে, আল্লাহর পক্ষ হতে সালাত মানে, আল্লাহ পাক নবীজির প্রতি অহরহ রহমত নাযিল করেন ও নবীজির প্রশংসা করেন। আর ফেরেশতাদের দরূদ মানে, আল্লাহর দরবারে তারা দোয়া করেন ও মাগফিরাত কামনা করেন। মনীষী আবুল আলিয়া আরো পরিষ্কার করে বলেন, আল্লাহর দরূদ মানে ফেরেশতাদের মাঝে নবীজির প্রশংসা করা আর ফেরেশতাদের দরূদ মানে হযরতের জন্য আল্লাহর  দরবারে তাদের দোয়া। মু’মিনদের প্রতি সালাত পাঠানোর নির্দেশের তাৎপর্য হচ্ছে, তোমরা আল্লাহর  রসূলের প্রতি অফুরান রহমত নাযিলের জন্য দোয়া কর আর সালাম জানাও মানে ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী নবীজির প্রতি শ্রদ্ধাভরে সালাম পাঠাও।
কাসীদায়ে বোর্দা রাসূলে পাক (সা.)-এর শানে আরবিতে আরেকটি না‘তের অনবদ্য সৃষ্টি। এ সম্পর্কিত আলোচনার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় চাই। এই কবিতার শত শত ব্যাখ্যা ও তরজমা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমার কাছে ফারসি কবিতা ও পদ্যে অনুবাদের একটি কপি আছে কুর্দিস্থান নিবাসী তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন প্রফেসরের লেখা। এর ভূমিকায় তিনি কিছু মূল্যবান কথা বলেছেন। তন্মধ্যে একটি কথা হচ্ছে, মুসলমানদের প্রতি তথা গোটা বিশ্ববাসীর প্রতি হযরতের অনুগ্রহ, দয়া ও অবদান অপরিসীম। তাঁর উসিলাতে আমরা আল্লাহকে চিনেছি। সত্যের পথ পেয়েছি। পশুত্বের জীবন থেকে মনুষ্যত্বের জীবনের সন্ধান পেয়েছি। বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছি। দোযখ থেকে বাঁচার পথ ও তাগিদ পেয়েছি। তার বিনিময়ে আমরা হযরতকে কী দিতে পারি, কী দেয়া উচিত? তিনি বলেন : উম্মতের পক্ষে যেটুকু দেয়া সম্ভব ও উচিত তা হল, অহরহ সালাত ও সালাম। শেখ সা’দীর লেখা ঐ বয়েতটিতেও সেই তাগাদার অনুরনণ হয়েছে। তাঁর বংশধরের প্রতি দরূদ পাঠের যুক্তি বুঝতে হলে আমরা যে নামাযের শেষ  বৈঠকে  ‘ওয়াআলা আলে মুহাম্মদ’ (মুহাম্মদের বংশধরের উপর দরূদ) পড়ি তার তাৎপর্য বুঝতে হবে।” (www.mashikdeendunia.com)
                আলোচ্য চতুষ্পদীটির প্রথম চার লাইনের পরে আরো কিছু লাইন একসূত্রে পাওয়া যায়, সেগুলো হল: “বালাগাল উলা বে-কামালিহী / কাশাফাদ- দোজা বে-জামালিহি / হাসুনাত জামিউ খেসালিহী / সাল্লু আলাইহে ওয়ালিহি। / খাসাফাল কামারু লে-জামালিহি /  মুলিয়াল খালাউ বে-খবরিহি। / নাত্বাকাল হাজারু বে-জালালিহি / মাসাগা জা'কাল লে-গাইরিহি / নুসিখাল মিলালু বে-জুহুরিহী / মাসাবাশ-শিবাহু বে-কায়ানিহি” (http://www.chandpur-kantho.com) এর আরো লাইন আছে কিনা জানিনা, কেউ জানলে এই ই-মেইল এড্রেসে ই-মেইল করে জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো: sohelict@gmail.com
                      শেখ সাদী (রহঃ)-এর আলোচ্য চতুষ্পদী অবলম্বনে সারা পৃথিবীতে নানা ভাষায় অনেক না'তে রাছুল রচিত হয়েছে। বাংলাদেশেও হয়েছে। এর একটি হল:  বালাগাল উলা বি কামালিহি / কাশাফুদ্দুজা বি জামালিহি / হাসুনাত জামিউ খিসলিহি / সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।। //// তুমি এলে তাই মরুর বুকে ফুটলো যে ফুল, / উঠলো গেয়ে বাগে বুলবুল। / খেজুর বিথিকায় পিউপাপিয়া / থেমে থেমে উঠলো ডাকি।। //// পুরানো রবি আর উঠলোনা সেদিন লজ্জা পেয়ে, / তোমার আলোয় ধরা গেল গো ছেয়ে। / গ্রহ চাঁদ সিতারা উথলে উঠে / তব পায়ে পড়ল লুটি।কথা ও সুরঃ আব্দুস শাকুর তুহিন এরূপ একটি সুন্দর না'তে রাছুলের ভিডিও দেখি এখানেঃ
                    আল্লাহ আমাদের আলোচ্য দরূদসহ অন্যান্য দরূদের মাধ্যমে সার্বিক কল্যাণলাভের এবং রাছুলুল্লাহ (সাঃ) প্রদর্শিত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের অনুসরণ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠার তৌফিক দান করুন, আমীন।

..................................................................................................................

এথানে এসম্পর্কে আরো ভিডিও দেখুন প্লীজ:

বালাগাল উলা বিকামালিহী - আপত্তির জবাব

Sunday, September 15, 2013

শেষ সময়ের নিদর্শন নিয়ে হাদীসের বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী


Please see this video (double click):

সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী: স্বপ্নযোগে রাছুলুল্লাহ(সাঃ)-এর নির্দেশলাভ ও এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা

সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী: স্বপ্নযোগে রাছুলুল্লাহ(সাঃ)-এর নির্দেশলাভ 
ও এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা

অনেকদিন আগের কথা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী তখন মিশর ও সিরিয়ার শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী একজন শাসক।
একদিন শেষ রাতে
সুলতান এক অভিনব স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নীল বর্ণের চোখবিশিষ্ট দুই লোককে দেখিয়ে বললেন, ‘নুরুদ্দীন! এই দুষ্ট লোকদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাকে রক্ষা কর।'
এই স্বপ্ন দেখে সুলতানের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অজু করে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। বিছানা ছেড়ে অজু করে নামায পড়লেন তিনি। এরপর দরুদ শরীফ পড়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর একই স্বপ্ন দেখলেন সুলতান। এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলেন তিনি। বিছাড়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। উজীর জামালুদ্দীনকে ডেকে পাঠালেন। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে ছুটে এলেন জামালুদ্দীন। ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতানের দিকে।
সুলতান এবার তার স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। সব শুনে উজির বললেন, ‘জাঁহাপনা! মোটেও দেরি করবেন না। আপনার এক্ষুনি মদীনা শরীফ যাওয়া উচিত। নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাই নবীজী আপনাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিন। আর এই স্বপ্নের কথা কাউকে বলবেন না।'
সেই রাতেই সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে নিলেন উজীর জামালুদ্দীন আর কুড়িজন সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী। একটানা ষোল দিন পথ চলার পর তারা মদীনায় পৌছলেন। উজীর জামালুদ্দীন ঘোষণা করে দিলেন যে, সুলতান নুরুদ্দীন রাসূলের রওজা শরীফ জিয়ারত করতে এসেছেন। তিনি মদীনার জনগণের সঙ্গে দেখা করবেন এবং সবাইকে উপহার দেবেন।
দাওয়াত পেয়ে সবাই এল সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে। সুলতান সবার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং উপহার দিলেন। উপহার দেয়ার সময় সুলতান সেই নীল চোখওয়ালা লোক দু'টিকে খুঁজছিলেন। কিন্তু যারা সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাদের মধ্যে সেই নীল চোখের লোক দু'টি নেই!
সুলতান জানতে চাইলেন, ‘এমন কেউ কি বাকি আছে যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি?' লোকেরা বলল, ‘মদীনার সকলেই আপনার কাছে এসেছে, কেউ বাদ পড়েনি। তবে দু'জন বিদেশী দরবেশ আছেন। তারা মসজিদ ছেড়ে কোথায় যান না। কারও কাছ থেকে কোনো দান-খয়রাতও নেন না। বরং তারাই অভাবি মানুষদেরকে মুক্ত হস্তে দান করেন। ওই দুই বুজুর্গ ব্যক্তিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি।'
এ কথা শুনে সুলতান মনে মনে চমকে উঠলেন। তার চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি নির্দেশ দিলেন সেই দুই বিদেশীকেও হাজির করতে। সুলতানের নির্দেশে সেই দুই দরবেশকেও হাজির করা হলো। তাদের দেখেই সুলতান চমকে উঠলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন-এরাই তো স্বপ্নে দেখা নীল চোখের মানুষ। এরাই রাসূলকে কষ্ট দিচ্ছে।
লোক দুটোকে দেখে সুলতান মনে মনে খুব রেগে গেলেন । কিন্তু তা কাউকে বুঝতে দিলেন না। ধীরকণ্ঠে তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তাদের একজন নম্রভাবে জানালো- আমরা পশ্চিম দেশীয় মুসলমান। হজ্ব করতে এসেছিলাম। হজ্বের পর মদীনায় এসেছি হুজুরের রওজা জিয়ারত করতে।
সুলতান বললেন, শুনলাম তোমরা অনেকদিন থেকেই মদীনা অবস্থান করছো? ভণ্ড দরবেশদের অপরজন বলল- আপনি ঠিকই শুনেছেন। আসলে জিয়ারতে এসে রওজাপাকের মহব্বতে আটকা পড়ে গেছি। তাই প্রিয় নবীর পাশে থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।
এ সময় সুলতান ওদের বাসস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। জানা গেল-রওজা শরীফের কাছেই একটি মুসাফিরখানা। ওখানেই নিরিবিলি একটি কক্ষে বাসা করে ওরা।
সব জানার পর সুলতান হঠাৎ ওদের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সুলতানের কথা শুনে কেমন যেন ভড়কে গেল লোক দুটি। তাদের নীল চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠল। তারা হেসে বলল, জাঁহাপনা কি আমাদের ওপর রাগ করেছেন দাওয়াতে আসিনি বলে? যদি তাই হয় তাহলে আমরা ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এ রকম ভুল আর জীবনে হবে না।
সুলতান ওদের কথায় কান দিলেন না। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সোজা মুসাফিরখানার সেই কক্ষে এসে হাজির হলেন তিনি।
ঘরে ঢুকে সন্দেহ করার মত কিছুই চোখে পড়ল না সুলতানের। দু'একটা সাধারণ আসবাবপত্র ছাড়া আর বই-পুস্তক ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে।
বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন সুলতান। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তার মন বলছে এই ঘরেই কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। মহানবীর দেখানো স্বপ্ন তো আর মিথ্যা হতে পারে না ! এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুলতানের নজর গেল ঘরের এক কোণে যেখানে একটি মাদুরের ওপর সুন্দর করে বিছানো আছে একটি জায়নামাজ। সুলতান সেখানে গিয়ে টান দিয়ে মাদুরটা উঠিয়ে ফেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাদুরের নিচেই একটি মসৃণ পাথর।
পাথরটি সরিয়ে ফেলতেই একটি গভীর সুড়ঙ্গ পথ দেখা গেল। মাটি খুঁড়ে খুব নিপুণভাবে এই সুড়ঙ্গ পথটি তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল-সুড়ঙ্গটিা পবিত্র রওজা শরীফের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছে।
সবার কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেল ভণ্ড দরবেশদের ষড়যন্ত্রের কথা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী ভয়ংকর স্বরে গর্জন দিয়ে বললেন, বল্‌- কেন তোরা এই জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছিস? তোদের পরিচয় কি?
দুই শয়তান কাঁপতে কাঁপতে বলল- আমরা ইউরোপের বাসিন্দা। জাতে খ্রিস্টান। আমাদের রাজা এবং পাদ্রীদের নির্দেশে আমরা এখানে এসেছি।
একটু দম নিয়ে তারা আবার বললে লাগল- "আমাদের এক মহা পরিকল্পনা রয়েছে। চারদিকে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ইসলামী জাগরণ দেখে আমাদের হিংসা হয়। মুসলমানদের কীভাবে অপমান করা যায় সেটাই আমাদের একমাত্র চিন্তা। আমাদের বিশ্বাস মদীনাতে নবীর কবর থাকাতে মুসলমানরা চারদিকেড বিজয় অর্জন করছে। তাই আমরা এসেছি মদীনা থেকে নবীর মরদেহ সরিয়ে ফেলতে অথবা ধ্বংস করে দিতে। এই কাজ করার জন্য আমাদেরকে অনেকদিন ধরে ট্রেনিং দেয়া হয়। এখানে এসে আমরা দরবেশের ছম্মদেব ধারণ করি। প্রচুর দানখয়রাত করে মানুষের মনও জয় করি। তারপর শুরু করি আসল কাজ।"
ওই পাপিষ্ঠদের জবানবন্দিতে আরও জানা গেল, প্রতিদিন গভীর রাতে ওরা খনন কাজ শুরু করত। খনন করা মাটি পানির মশকে ভরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসত। এভাবে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ওরা মহানবীর করবের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
ওই দুই শয়তানের জবানবন্দী শুনে মদীনার লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এভাবে দরবেশের রূপ ধরে তাদেরকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে জানতে পেরে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে গেল। জনগণ দাবি জানাল দুই শয়তানকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হোক। কিন্তু সুলতান তাদেরকে জনগণের হাতে তুলে দিলেন না। তিনি আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। দু'জনের মস্তক বিচ্ছিন্ন করার পর তাদের দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল।
এরপর রওজা শরীফ সুরক্ষার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন সুলতান। কবরের চারপাশে গভীর গর্ত করে সেই গর্তে সীসা, তামা ও লোহা গলিয়ে মজবুত দেয়াল তৈরি করা হল। এভাবে সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা করলেন। 
Source: http://bangla.irib.ir

আল-কুরআন: রাসূলুল্লাহর জীবন্ত মু‘জিযা

আল-কুরআন: রাসূলুল্লাহর জীবন্ত মু‘জিযা

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের 
প্রকাশনায়: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: আল-কুরআন - রাসূলুল্লাহর জীবন্ত মু‘জিযা : এ নিবন্ধে পবিত্র কুরআন ও যুক্তির কষ্টিপাথরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন্ত মু‘জিযা আল-কুরআনের প্রামাণ্যতা ও অকাট্যতা প্রমাণের প্রয়াস চালানো হয়েছে। এটি যে সুরক্ষিত, অবিকৃত ও অপরিবর্তনীয় তাও সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আরবী মু‘জিযা শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘মিরাকল'। একে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যেমন : তা এমন একটি কাজ যাকে প্রকৃতির নিয়মে সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যা করা যায় না। কিংবা তা এমন একটি বিষয় যা মানুষের ক্ষমতা ও সাধ্যের ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ তা এমন একটি ঘটনা যা মানবিক কার্যকারণ ও যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যাত নয়। সুতরাং মু‘জিযা যেহেতু মানুষের ক্ষমতা ও যোগ্যতার আয়ত্বাধীন নয়, তাই তা অবশ্যই সরাসরি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার কর্ম বলেই বিবেচ্য।
একটি মু‘জিযা – আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যক্ষ কাজ হিসেবে- আল্লাহ তা‘আলার সার্বভৌম ক্ষমতা ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রতিফলন ঘটায়। মু‘জিযা মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি একটি উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ। এটি প্রমাণিত ও অনস্বীকার্য সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ব-জাহানের একমাত্র প্রভু। তাই তিনি তাঁর সকল সৃষ্টিকে তাঁরই আনুগত্যের নির্দেশ দেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সাফল্য ও মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যখন কোনো সম্প্রদায়ের কাছে কোনো নবী প্রেরিত হতেন তখন তারা তাঁর কাছে এই দাবি করত, যেন তিনি তাদেরকে মু‘জিযা দেখান। তারা নবী কিংবা রাসূলের আখলাক ও আচরণের প্রতি আগ্রহী ছিল না; সেই বাণীর প্রতিও নয় যা তিনি তাদের জন্য নিয়ে এসেছেন। বিপরীতে তারা অধিক উদগ্রীব ছিল, যাতে তিনি পারলে তাদেরকে কোনো অতি প্রাকৃতিক ব্যাপার দেখিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেন। আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রাসূলই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।
উম্মতের প্রতি সকল নবী-রাসূলের জবাব ছিল একটিই-

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ (188)
‘বল, আমি আমার নিজের কোনো উপকার বা ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা এমন কওমের জন্য, যারা বিশ্বাস করে।‘[সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত : ১৮৮। ]
অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,

قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آَتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا (30) وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ ‎وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا (31)
‘সে বলল, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আর যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও যাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন।‘[সূরা মারইয়াম, আয়াত : ৩০। ]
আরেক স্থানে ইরশাদ হয়েছে,

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ
‘বল, ‘আমি নিজের ক্ষতি বা উপকারের অধিকার রাখি না, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন।‘ [সূরা ইউনুস, আয়াত : ৪৯। ]
যা হোক, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অপরিসীম দয়ায় প্রত্যেক নবী-রাসূলকে বহু মু‘জিযা দান করেন। এভাবে তিনি সব ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের উর্ধ্বে তাঁর নবী-রাসূলগণের বিশ্বাসযোগ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। একদল লোক এসব মু‘জিযাকে জাদু ও ভেলকিবাজি বলে একেবারে উড়িয়ে দিত, আরেকদল লোক যারা তাদের বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি ও সাধারণ বোধের যোগ্যতা কাজে লাগাতেন, তারা নবী-রাসূলের এই অতিপ্রাকৃতিক কর্মসমূহকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মু‘জিযা হিসেবে গ্রহণ করতেন। তারা অনুসরণ করতেন নিজেদের সম্মানিত নবী-রাসূলের বাণীর।
ইতিহাসও আমাদের এ কথা বলে, প্রত্যেক নবী-রাসূল যে সম্প্রদায় বা যে স্থানে প্রেরিত হয়েছিলেন সে সম্প্রদায় ও স্থানের জন্যে তাদেরকে বহু মু‘জিযা প্রদান করা হয়েছিল। একইভাবে এ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রেও সত্য। তিনি অগণিত মু‘জিযা দেখান, যা তার সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রত্যক্ষ করেছিল এবং ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থে তা যথাযথভাবে লিখিত রয়েছে। তাছাড়া তিনি বহু ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যার সবকটিই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত নবী-রাসূলদের মধ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্য নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন কোনো বিশেষ স্থান ও সময়ের জন্য। আর আল্লাহ তা‘আলা এসব নবী-রাসূলকে কিছু বিশেষ মু‘জিযা দান করেছিলেন একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত স্বজাতিকে তা দেখানোর জন্য। এসব মু‘জিযা সময় ও স্থানের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল। মানব ইতিহাসের অংশ হিসেবে আজ কেবল এসব মু‘জিযার গল্প বিদ্যমান। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন সর্বশেষ রাসূল হিসেবে। পুরো মানব জাতির জন্যে এবং আগত পুরো সময়ের জন্যে। যার দাবি, তাঁর থাকবে এমন একটি সার্বজনীন মু‘জিযা যা স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে। মানব ইতিহাসের প্রতিটি যুগের প্রত্যেক ব্যক্তি চাই সে পৃথিবীর যে অংশেই বসবাস করুক না কেন যথার্থই বলতে পারে, যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমানে আমার নবী হন, তাহলে আমি একথা পছন্দ করি যে, আমার জন্য বর্তমানে একটি মু‘জিযা থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির সর্বশেষ রাসূল হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে তাকে যে সার্বজনীন মু‘জিযা দান করেছেন তা-ই আল-কুরআন। পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা আল-কুরআনের বিস্ময়কর প্রকৃতির বিবরণ দিয়ে অসংখ্য পৃষ্ঠা রচনা করেছেন। বস্তুত বিগত চৌদ্দশ বছর ধরে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক প্রজন্মই আল-কুরআনের নতুন নতুন বিস্ময় ও মু‘জিযা আবিষ্কার করেছে। এই অশেষ মু‘জিযা এ কথার শাশ্বত ও স্থায়ী প্রমাণ যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার রাসূল এবং আল-কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরো মানবজাতির জন্যে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত গ্রন্থ।
আল-কুরআনের বিস্ময়কর প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে হলে আমাদেরকে সে স্থান ও কালের দিকে ফিরে দেখতে হবে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৫৭১ ঈসায়ী সনে। তৎকালে মানবিক জ্ঞানের স্তর এতই অধপতিত ছিল যে, ঐতিহাসিকরা একে মানবেতিহাসের ‘আইয়ামে জাহিলিয়া বা বর্বরতার যুগ‘বলে আখ্যায়িত করেন। সেসময় মানুষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ন্যূনতম জ্ঞানও ছিল না। সাধারণ মানুষ জানত না লেখা-পড়া। না আবিষ্কৃত হয়েছিল মুদ্রণের কলা-কৌশল। ফলে যদি কোনো ব্যক্তি একটি নিশ্চিত মানের জ্ঞান অর্জন করত তবে সে একটি মনোনীত দলের লোক বলে গণ্য হত। সেই জ্ঞান প্রচারের কোনো উপায় বা মাধ্যম ছিল না তৎকালে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের মক্কা নামক একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় আরব উপদ্বীপের জীবন ব্যবস্থা ছিল খুব সেকেলে। দেশটি ছিল কান্তার মরু আর অথৈ বালিয়াড়িময়। ছিল না কোনো রাস্তা-ঘাট। না ছিল কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা কৃষিব্যবস্থা। আরব উপদ্বীপের আবহাওয়া এমনকি বর্তমানেও এত উষ্ণ যে, ছায়ার মধ্যেও তাপমাত্রা প্রায়ই ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে। এমন রূঢ় আবহাওয়া এবং দারিদ্রের কারণে আরব উপদ্বীপ বিদেশি বণিক কিংবা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে নি। দেশটি ছিল গোটা বিশ্ব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। ফলে প্রতিবেশি দেশ সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও রোমে যে সামান্য জ্ঞানের চর্চা ছিল তাও আরব উপদ্বীপ অবধি পৌঁছাতে পারে নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাতে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, লোকেরা সেখানে যাযাবরের মত বসবাস করত। তারা তাদের গবাদিপশু ও পরিবারের জন্য বৃষ্টি ও চারণভূমির তালাশে নিয়মিত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হত। সেখানে ছিল না কোনো সরকার কাঠামো। না ছিল কোনো নাগরিক সুবিধা। কোনো সুসংহত নগর-আইনও ছিল না। লোকেরা গোত্রে গোত্রে বসবাস করত। গোত্রের শক্তি ও প্রতিপত্তিই একজন ব্যক্তির ক্ষমতা ও অধিকার হিসেবে বিবেচিত হত। ‘জোর যার মুল্লুক তার‘কেবল এ নীতিই সে ভূখণ্ডে কার্যকর ছিল। অপেক্ষাকৃত শক্তিধর গোত্রগুলি দুর্বল গোত্রদের ওপর প্রায় লুটতরাজ ও লুণ্ঠন চালাত। এটিই ছিল তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। পরন্তু গোত্রের শক্তি-সামর্থ্য নির্ভর করত পুরুষদের সংখ্যার ওপর। আপদ ও বোঝা জ্ঞান করা হত নারীদের। প্রায় অভিভাবই চাইত না এ বোঝা বহন করতে। সেহেতু তারা আত্মজ কন্যাকে হত্যা করত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মকালীন পরিবেশ-প্রতিবেশ ও তৎকালীন অবস্থার উল্লেখ করার পর তাঁর শৈশবকালীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও উল্লেখ করা সমীচীন ভাবছি। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা মারা যান। মাকেও হারান ছয় বছর বয়সে। তারপর তাঁর দেখাশুনার ভার নেন দাদা। কিন্তু তিনিও পরপারে পাড়ি জমান যখন তাঁর বয়স আট হয়। তিনি তখন আপন চাচার ঘরে স্থানান্তরিত হন। এই চাচা কেবল তাঁকে আশ্রয় দান করেছিলেন। তিনি তাঁর জ্ঞান অর্জনে সাহায্য কিংবা জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণে সক্ষম ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাই গবাদি পশু চরিয়ে চাচাকে সহযোগিতা করতেন। যে কেউ দেখতে পাবেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাল্য-জীবন আর দশ জনের মতো ছিল না। পিতা, মাতা কিংবা পিতৃব্যের ভালোবাসা ও আদর-যত্ন বলতে যা বুঝায়, তিনি তা পান নি। ছিল না তাঁর কোনো স্থায়ী কোনো নিবাস। এক অভিভাবক থেকে আরেক অভিভাবকের কাছে হাত বদল হন। এই বিরূপ ও রূঢ় পরিস্থিতির কারণে ন্যূনতম জ্ঞান কিংবা শিক্ষা যা তখন মক্কায় প্রচলিত ছিল- তাও অর্জন করার সুযোগ তাঁর ছিল না।
ঐতিহাসিকরা লিখেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না লিখতে জানতেন, না পড়তে। এমন কি তিনি নিজের নামটি পর্যন্ত স্বাক্ষর করতে জানতেন না। পরন্তু তাঁর জীবনের এমনতরো রূঢ় ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তাঁকে সেসব হাতে গোনা গুটিকয়েক শিক্ষিত লোকদের সাহচর্যে বসারও সুযোগ দেয় নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে মাত্র দু‘বার দীর্ঘ সফর করেছেন। প্রথম সফর ছিল তাঁর আট বছর বয়সে। দ্বিতীয়বার সফর করেন যখন তাঁর বয়স পঁচিশ বছর। উভয়টি ছিল সিরিয়ায় এবং খুব সংক্ষিপ্ত। তাও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। কখনো কোনো ঐতিহাসিক একথা লিখেন নি যে, এই সফরগুলি তাঁকে এমন কিছু জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছিল যা তিনি পরবর্তীতে আল-কুরআনে সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি একজন সাধারণ আরব বেদুঈনের মত খুব সহজ সরল ও সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। একজন জনসমাবেশের বক্তা হিসেবে তিনি না পরিচিত ছিলেন, না একজন কাব্য রচয়িতা হিসেবে। আর না অন্য এমন কোনো কাজ করেছিলেন যা তাঁর প্রতি অন্যান্যদের দৃষ্টি কাড়ে।
তিনি কোনো ধরনের বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ কিংবা যুদ্ধে জড়াতেন না। বলাবাহুল্য, মক্কার লোকেরা মূর্তিপূজা করত এবং যখন তারা কা‘বায় প্রবেশ করত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই বস্ত্র ত্যাগ করত। এ ছিল তাদের প্রার্থনা-রীতির অংশ। এ রকম পরিস্থিতিতে তিনি বেড়ে উঠেন। একটি মাত্র বিষয় যা ঐতিহাসিকরা তার বাল্য জীবন সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছেন তা হল, তিনি তাঁর সততা এবং সদাচারের জন্য সুপরিচিত এবং সবার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার পাত্র ছিলেন। এ জন্যই মক্কার লোকেরা তাঁকে ‘আল-আমীন‘ বা বিশ্বাসী এবং ‘আস-সাদিক‘ বা সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করেন, আল্লাহ তাঁকে পুরো মানব জাতির জন্য সর্বশেষ রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব তখন সহসাই পাল্টে যায়। অচিরেই তাঁকে দেখা যায় নানা সফল ভূমিকায়। ধর্মপ্রচারক, রাষ্ট্রনায়ক, বক্তা, সৈনিক, সেনানায়ক, নেতা, আইন প্রণেতা, বিচারক, চুক্তিসম্পাদনকারী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, স্বামী, পিতা- হেন কোনো ভূমিকা নেই যাতে তিনি ব্যর্থ। সফলতার এমন বহুমুখিতা দেখেই একজন ইয়াহূদী ঐতিহাসিক মাইকেল এইচ হার্ট তার বিখ্যাত ‘দি হান্ড্রেড’ নামক মানবজাতির একশ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনীতে তাঁকে সবার শীর্ষে উল্লেখ করেন।
এই আল-কুরআনই মানবতার প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। মানব জাতির ইতিহাসে যার কোনো তুলনা নেই। অন্যান্য নবী-রাসূলের মু‘জিযা তাদের জীবনকাল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কুরআন মাজিদ কিয়ামত পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন্ত মু‘জিযা হিসেবে অক্ষত থাকবে। আল-কুরআন এমন অসংখ্য তথ্যধারণ করে যা তা অবতীর্ণ হওয়ার সময় মানুষের জানা ছিল না। এসব তথ্যসূত্রের অনেকগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বর্তমানে নিশ্চিত সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বস্তুত প্রত্যেক যুগে মানুষ আল-কুরআনে নতুন নতুন ‘মিরাকল‘বা মু‘জিযা আবিষ্কার করেছে। মানুষের জ্ঞানের পরিধি যতই প্রসারিত হচ্ছে, ততই তা আল-কুরআনের মু‘জিযার তালিকাকে দীর্ঘ করছে।

وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلَا تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ إِذًا لَارْتَابَ الْمُبْطِلُونَ (48)
‘আর তুমি তো এর পূর্বে কোন কিতাব তিলাওয়াত করনি এবং তোমার নিজের হাতে তা লিখনি যে, বাতিলপন্থীরা এতে সন্দেহ পোষণ করবে।‘[সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত : ৮৮। ]

وَمَا كَانَ هَذَا الْقُرْآَنُ أَنْ يُفْتَرَى مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لَا رَيْبَ فِيهِ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (37) أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (38)
‘এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোন সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে। নাকি তারা বলে, ‘সে তা বানিয়েছে’? বল, ‘তবে তোমরা তার মত একটি সূরা (বানিয়ে) নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’[ সূরা ইউনুস, আয়াত : ৩৭-৩৮।]
.......................................................................................................


আল কোরআনের মোজেজা সংক্রান্ত এ ব্লগের আরো ৯টি পোষ্টের জন্য এ লিংকে ব্রাউজ করুন: কোরআনের নিদর্শন (Sign of Quran)


 

এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য