Showing posts with label কোরআনের নিদর্শন (Sign of Quran). Show all posts
Showing posts with label কোরআনের নিদর্শন (Sign of Quran). Show all posts

Tuesday, September 17, 2013

আমাদের রাছুল (সাঃ) -এর কোন মোজেজা স্থায়ী? -আল্লামা সাঈদী, মৌলানা মিজানুর রহমান আজহারী এবং উস্তাদ নোমান আলী খান


সব নবীদের ইন্তেকালের পর তাঁদের মোজেজাও শেষ হয়ে গেলো কিন্তু বিশ্ব নবী (সা) এর ইন্তেকালের পরেও তাঁরমোজেজা শেষ হয়নি, শেষ হবেনা কেয়ামত পর্যন্ত
- আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব

নীচের দু'টি ভিডিও দেখুন এবং শেয়ার করুন প্লীজঃ

আল-কুরআন: চূড়ান্ত মু'জিজা || উস্তাদ নোমান আলী খান

Sunday, September 15, 2013

কুরআন মাজিদে সন্দেহের একটি ছায়া খুঁজে দেখাও?

কুরআন মাজিদে সন্দেহের একটি ছায়া খুঁজে দেখাও?


এই সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুত্তাকিদের (যারা আল্লাহর প্রতি তাদের করণীয়সমূহ সম্পর্কে সচেতন তাদের) জন্য হেদায়াত। (বাকারা, ০২ : ০২) আর আমি আমার বান্দার ওপর (কুরআন মাজিদে) বিভিন্ন সময়ে যা নাজিল করেছি যদি তোমরা সে সম্পকের্ সন্দেহে থাক তবে তোমরা তার মত একটি ‘সুরা’ নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা (তোমাদের সন্দেহের ক্ষেত্রে) সত্যবাদী হও। (বাকারা, ০২ : ২৩) এই কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা (যে ওহি) তার সামনে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলেন রবের পক্ষ থেকে। (ইউনুস, ১০ : ৩৭) এ কিতাব সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এতে কোনো সন্দেহ নাই। (সাজদাহ, ৩২ : ০২) লক্ষণীয় বিষয় হল, এই আয়াতগুলি কাফিরদেরকে কুরআন মাজিদের ভুলত্রুটি, অসঙ্গতি কিংবা অনৈক্য খুঁজে বের করতে বলে না, বরং কুরআন মাজিদে একটি সাধারণ সন্দেহের ছায়া খুঁজে বের করতে বলে। মানব ইতিহাসে এমন কোনো বইয়ের নজির নেই যার লেখক এই দাবি করতে পেরেছেন। কুরআন মাজিদই একমাত্র গ্রন্থ যা এই দাবি করেছে। এখন আমরা সেসব বিবিধ সন্দেহের বিশ্লেষণ করি যা কোনো বই সম্পর্কে একজন মানুষের হতে পারে। তা এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রচিত বা প্রচারিত হতে পারে, যিনি মানব সমাজে অপরিচিত কিংবা তা এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রচিত বা প্রচারিত হতে পারে, যার চরিত্র, আচরণ কিংবা ন্যায়পরায়নতা সন্দেহপূর্ণ।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন ইতিহাসের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, তাঁর জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত সংরক্ষিত, লিখিত এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়ে এসেছে। বস্তুত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই মানব ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যার জীবন বৃত্তান্ত বিগত চৌদ্দশ বছরের প্রত্যেক যুগের মুসলমানরাই লিপিবদ্ধ করেছে। অধিকন্তু এ সকল বিবরণ এতই ব্যাপক যে, তারা কেবল তার জীবন-বৃত্তান্ত লিখেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক, আদান-প্রদান, কথা বলার ধরণ, হাঁটা-চলা, নিদ্রা যাওয়া, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং তাঁর দেহাবয়বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের ওপরও আলোকপাত করেছে। যেমন- তাঁর দাড়িতে শুভ্র চুলের পরিমাণ কত ইত্যাদি। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ ও ন্যায়পরায়নতা সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মক্কায় তাঁর ঘোর শত্রুরাও তাঁকে ‘সিদ্দিক’ (সত্যবাদী) এবং ‘আল-আমিন’ (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জীবন-ইতিহাস, চারিত্রিক ন্যায়পরায়নতা ওআচার- আচরণ সম্পর্কিত বাস্তব ঘটনাবলি এমন নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের পর সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো সংশয় থাকতে পারে না যিনি মানব জাতির কাছে কুরআনের বাণী প্রচার করেছেন। তিনি ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বই নন, বরং একজন প্রখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ সত্যের প্রচারক। অতএব এ থেকে বুঝা যায়, কুরআন মাজিদের উৎসের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের সন্দেহের অবকাশ নেই। দ্বিতীয় প্রকার সন্দেহ, যা একটি গ্রন্থে সৃষ্টি হতে পারে তা, তার অন্তর্নিহিত সঙ্গতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যদি একটি গ্রন্থের কিছু বর্ণনা অন্য বর্ণনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা একটি গ্রন্থের অন্তর্নিহিত সঙ্গতি কিংবা সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। পুরো কুরআন মাজিদে ৬,২৩৬টি আয়াত এবং ৮৬,৪৩২টি শব্দ রয়েছে। তথাপি কুরআন মাজিদের একটি সাধারণ আয়াত, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা কিংবা শব্দ অন্য অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। পক্ষান্তরে প্রত্যেকটি আয়াত ও শব্দ সমগ্র কুরআন মাজিদের টেক্সটের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাঠক এই বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন, যদি বর্তমান বাইবেল সম্পর্কে কেবল দু’টি উদ্ধৃতি দেয়া হয়। প্রটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের বাইবেলের কপিতে বই সংখ্যা ৬৬টি, যার মধ্যে ৩৯টি বই পুরাতন সমাচার থেকে এবং ২৭টি বই নতুন সমাচার থেকে। অপরপক্ষে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের বাইবেলের কপিতে বই সংখ্যা ৭৩টি; ৬৬টি বই প্রটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের কপি থেকে এবং ৬টি অতিরিক্ত বই যেগুলি Apocrypha (অ্যাপোক্রাইফা) নামে পরিচিত। বাইবেলের এই দুই ধরনের ভার্সনের অস্তিত্ব থাকার কারণে পুরো বাইবেলের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর সুস্পষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন জাগে গ্রন্থটির কোন ভার্সনটি গ্রহণ করা যাবে, প্রটেস্টেন্ট ভার্সন না ক্যাথলিক ভার্সন? বাইবেলের একটি বিস্ময়কর অসঙ্গতি হল, এটি যীশু খ্রিস্টের (ঈসা আলাইহিস সালাম-এর) দু’টি ভিন্ন ভিন্ন বংশ তালিকা প্রদান করে। বাইবেল অনুসারে, তার একজন পূর্বপুরুষের নাম হল যোসেফ। মেথিউ ১ : ১-৭ অনুসারে যোসেফের পিতার নাম জ্যাকব। পক্ষান্তরে লূক ৩ : ২৩ অনুসারে যোসেফের পিতার নাম হেলি।

আল হামদুলিল্লাহ। কুরআন মাজিদের কেবল একটি ভার্সনই সদা বিদ্যমান থেকেছে এবং এর টেক্সটও সবধরনের অসঙ্গতিরহিত। সেহেতু সন্দেহের দ্বিতীয় রূপ অর্থাৎ গ্রন্থের আভ্যন্তরীণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য অনুসারেও কুরআন মাজিদে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই। একটি গ্রন্থে তৃতীয় প্রকার যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় তা তার বাহ্যিক সঙ্গতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার অর্থ, গ্রন্থটিতে এমন কোনো বর্ণনা থাকবে না, যা গ্রন্থটির বাইরের জগতের স্বতঃসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। বিগত পৃষ্ঠাগুলি তার কিছু নমুনা প্রদান করে যে, কুরআন মাজিদের বর্ণনা শরীরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভ্রূণবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ব্যবচ্ছেদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়সহ কোনো মানবজ্ঞান জগতের সঙ্গেই অসঙ্গতি রাখে না। অধিকন্তু কুরআন মজিদ মানব জ্ঞানের সকল স্তর থেকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রাখে, চাই তা প্রাচীন, সাম্প্রতিক কিংবা অতি সাম্প্রতিকই হোক না কেন। এভাবে কুরআন মজিদ বাহ্যিক সঙ্গতির পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ। কোনো মানুষই এমন কোনো গ্রন্থ রচনা করতে পারে নি যা চিরকাল বাহ্যিক সঙ্গতির বিষয়টি রক্ষা করতে পেরেছে। প্রত্যেক বই-ই সময়ের সঙ্গে একটি ধাপ পেরিয়ে গেলে সেকেলে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। কুরআন মাজিদই একমাত্র গ্রন্থ যা সফলতার সঙ্গে বিগত চৌদ্দশ বছর যাবৎ বাহ্যিক সঙ্গতির চ্যালেঞ্জ মুকাবেলা করেছে। মহাজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ তাআলাই এমন একটি গ্রন্থ অবতীর্ণ করতে পারেন, যা এমন সর্বব্যাপী জ্ঞান ধারণ করে যা সকল যুগের মানুষের জ্ঞানকে পরিব্যাপ্ত করে এবং সকল জ্ঞান জগতের ওপর নিরংকুশ শ্রেষ্ঠত্ব রাখে।


মূলঃআল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য[পৃষ্ঠাঃ ১৯৬-১৯৯]

ড. মাজহার কাজি
ভাষান্তর: মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ মুজহিরী
সম্পাদনা: এম মুসলেহ উদ্দিন, মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
অন্যথা পাবলিকেশন


আল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য বইটির সম্পূর্ণ পিডিফ ভার্সন পাওয়ার জন্য এই লিংকে ব্রাউজ করুন: আল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য


Same Label's Other Link:


Wednesday, August 14, 2013

কোরানের আয়াত পাঠ করে যেভাবে রোগী সুস্থ করা হয় (ভিডিও সহ)

সম্মানিত ভাই ও বোনেরা আসসালামু আলাইকুম,আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম আল্লাহ তায়ালার একটি নিদর্শন। দেখুন শুধু মাত্র কোরানের আয়াত পাঠ করে যেকোন রোগী  সুস্থ করা যায় । অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটি বাস্তব ঘটনা। আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন মাত্র।শুধুমাত্র কোরানের আয়াত পাঠ করে যেভাবে রোগী সুস্থ করা হয় তার একটি ভিডিও দিলাম। আশা করছি ভালো লাগবে।
মালা আলী,ইরাকের কুর্দিস্তানের বাসিন্দা। তার নিজেরএকটি হসপিটাল রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র কুরআনের আয়াত পাঠ করে অনেক কঠিন রোগেরও মুক্তি দিয়ে থাকেন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকেও সকল ধরনের সাহায্য সহযোগীতা পেয়ে আসছেন বহু দিন ধরে। শুধু মাত্র আল্লাহর ক্ষমতা বলে ই তিনি মানুষের চিকিৎসা করে থাকেন বিনিময়ে দোয়া ছাড়া আর কিছুই নেন না। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যে কেউ আসতে পারে এই হসপিটালে।

তার চিকিৎসার ধরন হলো, কুরআনের আয়াত লেখা, মোনাজাত করা ও রোগিকে উচ্চারন করতে বলা।আল্লাহ তায়ালার ঈষারায় মুক্তি মেলে অনেক কঠিন রোগেরও।

ভিডিও দেখুন: (একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

                    Please see Mala Ali's YouTube channels: Mala Ali kurdi

Thursday, August 8, 2013

কোরআনে শব্দ ও আয়াতের পুনরাবৃত্তি রহস্য

 কোরআনে শব্দ ও আয়াতের পুনরাবৃত্তি রহস্য


কোরআন শরীফে সুরা “আল ফজর” এর ৭ নম্বর আয়াতে “ইরাম” নামক একটি গোত্র কিংবা শহরের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু “ইরাম” এর নাম কোন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তাই কোরআন শরীফের তাফসীরকারকরাও সুস্পষ্টভাবে এ শব্দটির অর্থ বলতে সক্ষম হননি। ১৯৭৩ সালে সিরিয়ার “এরলূস” নামক একটি পুরনো শহরে খনন কার্যের সময় কিছু পুরনো লিখন পাওয়া যায়। এ সমস্ত লিখন পরীক্ষা করে সেখানে চার হাজার বছরের একটি পুরনো সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ লিখনগুলোর ভেতর “ইরাম” শহরের উল্লেখ আছে। একসময় এরলুস অঞ্চলের লোকজন “ইরাম” শহরের লোকজনের সংগে ব্যবসা-বানিজ্য করতো। এ সত্যটা আবিষ্কৃত হলো মাত্র সেদিন অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেড় হাজার বছর আগে নাযিল করা কোরআন শরীফে এই শহরের নাম এলো কি করে? আসলে কোরআন শরীফ হচ্ছে আল্লাহর বাণী, আর আল্লাহ তাআলা এখানে “ইরাম” শহরের উদাহরণ দিয়েছেন। কোরআন শরীফে হযরত মোহাম্মদ (স.) এর একজন দুশমনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সে হচ্ছে আবু লাহাব। ওহী নাযিল হওয়ার পর যদি আবু লাহাব ইসলাম কবুল করতো তাহলে কোরআন শরীফের আয়াতটি মিথ্যা প্রমানিত হতো, কিন্তু আবু লাহাব ইসলাম কবুল করেনি এবং কোরআন শরীফের বাণী চিরকালের জন্য সত্য হয়েই রয়েছে। কোরআন শরীফে সুরা “আর রোম” –এ পারস্য সম্রাজ্য ধ্বংসের ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে এবং যে সময় এই ওহী নাযিল হয় তখন মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা অকল্পনীয় ছিল যে, রোমকদের যারা পরাজিত করলো তারা অচিরেই তাদের হাতে ধ্বংস হতে পারে , কিন্তু কোরআন শরীফ এ বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছে এবং এ আয়াত নাযিল হবার ৭ বছর সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ৬২৭ খ্রীস্টাব্দে এসে সত্য প্রমানিত হয়েছে। এ আয়াতে “ফি আদনাল আরদ” বলে আল্লাহ তায়ালা গোটা ভূ-মণ্ডলের যে স্থানটিকে “সর্বনিম্ন অঞ্চল” বলেছেন তা ছিলো সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জর্দানের পতিত “ডেড সী” এলাকা। এ ভূখন্ডতেই ৬২৭ খ্রীস্টাব্দে রোমানরা ইরানীদের পরাজিত করে। মাত্র কিছুদিন আগে আবিস্কৃত ভূ-জরিপ অনুযায়ী এটা প্রমানিত হয়েছে যে, এই এলাকাটা সারা দুনিয়ার মধ্যে আসলেই নিম্নতম ভূমি। “সী লেভেল” থেকে ৩৯৫ মিটার নীচে। এ জায়গাটা যে গোটা ভূ-খন্ডের সবচেয়ে নিচু জায়গা এটা ১৪ শ বছর আগের মানুষেরা কি করে জানবে। বিশেষ করে এমন একজন মানুষ যিনি ভূ-তত্ব প্রাণীতত্ত্ব ইত্যাদী কোন তত্ত্বেরই ছাত্র ছিলেন না। কোরআনের আরেকটি বিষ্ময়কর বিষয় হচ্ছে লোহা ধাতুর বিবরণ। কোরআনের সুরা “আল হাদীদ” এ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আমি লোহা নাযিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রচুর শক্তি ও মানুষদের জন্যে প্রভূত কল্যাণ ।” লোহা নাযিলের বিষয়টি তাফসীরকারকরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন; কিন্তু যেখানে আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট “নাযিল” শব্দটি রয়েছে সেখানে এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের দিকে না গিয়ে আমরা যদি কোরআনের আক্ষরিক অর্থের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভাবনীও ঠিক একথাটাই বলছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, লোহা উৎপাদনের জন্য যে ১৫ লক্ষ সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন তার কোনো উপকরণ আমাদের পৃথিবীতে নেই। এটা একমাত্র নক্ষত্রের তাপমাত্রা দ্বারাই সম্ভব। লক্ষ লক্ষ বছর আগে মহাশূণ্যে কোন নক্ষত্রে সুপার নোভা প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলে লোহা নামের এ ধাতু মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তা পৃথিবীতে “নাযিল” হয়। লোহা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কৃত তথ্য ঠিক একথাটাই প্রমাণ করেছে। দেড় হাজার বছর আগের আরব বেদুইনরা বিজ্ঞানের এই জটিল তথ্য জানবে কি করে? এই সুরার আরেকটি অংকগত মোজেযাও রয়েছে। ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী “সুরা আল হাদীদ” কোরআনের ৫৭ তম সুরা। আরবীতে “সুরা আল হাদীদ” –এর সংখ্যাগত মান হচ্ছে ৫৭ । শুধু “আল হাদীদ” শব্দের অংকগত মান হচ্ছে ২৬, আর লোহার আনবিক সংখ্যা মানও হচ্ছে ২৬ । কোরআনে অনেক জায়গায়ই একের সংগে অন্যের তুলনা উপস্থিত করা হয়েছে। এই তুলনা উপস্থিত করার ব্যাপারে একটি অবিশ্বাস্য মিল অবলম্বন করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে, সে দুটি নাম বা বস্তুকে সমান সংখ্যাতেই আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন, কোরআন শরীফের সুরা “আল-ইমরান” এর ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আল্লাহ তাআলার কাছে ঈসার তুলনা হচ্ছে আদমের মতো” । এটা যে সত্য আমরা বুঝতে পারি। কারণ মানবজন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এদের কারোরই জন্ম হয়নি। এই তুলনাটি যে কতো সত্য তার প্রমান পাওয়া যায় যখন আমরা কোরআন শরীফে এ দুটি নামের মোট সংখ্যা অনুসন্ধান করি। দেখা যাচ্ছে , কোরআন শরীফে ঈসা (আ.) নামটি যেমন ২৫ বার এসেছে, তেমনি আদম (আ.) নামটিও এসেছে ২৫ বার। কোরআনের বাণীগুলো যে মানুষের নয় তা বোঝা যায় এ দুটি নামের সংখ্যার সমতা দেখে। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু বলেছেন এ দুটো একই রকম। তাই সেগুলোর সংখ্যা গণনাও ঠিক একই রকম রাখা হয়েছে। এই তুলনার ক্ষেত্রে আরেকটি অলৌকিক বিষয় হলো, যেখানে তুলনাটি অসম সেখানে সংখ্যা দুটিকেও অসম বলা হয়েছে। যেমন, কোরআনে বলা হয়েছে, “সুদ” এবং বাণিজ্য এক নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটি কোরআনে এসেছে ছয়বার অন্যটি এসেছে সাতবার। বলা হয়েছে, “জান্নাতের অধিবাসী, জাহান্নামের অধিবাসী সমান নয়”। জান্নাতের সংখ্যা হচ্ছে আট আর জাহান্নামের সংখ্যা হচ্ছে সাত। সূরা “আরাফ” -এ এক আয়াতে আছে “যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে কুকুরের মতো ”। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় যখন আমরা দেখি, ““যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতকে অস্বীকার করে” এই বাক্যটি কোরআনে সর্বমোট ৫ বার এসেছে। যেহেতু তাদের উদাহরণ দেয়া হয়েছে কুকুরের সাথে, তাই সমগ্র কোরআনে “আল কালব” তথা কুকুর শব্দটাও এসেছে ৫ বার। “সাবয়া সামাওয়াত” কথাটির অর্থ হলো “সাত আসমান”। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোরআনে এই “সাত আসমান” কথাটা ঠিক সাত বারই এসেছে। “খালকুস সামাওয়াত” আসমানসমূহের সৃষ্টি কথাটাও ৭ বার এসেছে, সম্ভবত আসমান ৭ টি তাই। “সাবয়াতু আইয়াম” মানে ৭ দিন। একথাটাও কোরআনে ৭ বার এসেছে। অংকগত মোজেযা এখানেই শেষ নয়। “দুনিয়া ও আখেরাত” এ দুটো কথাও কোরআনে সমান সংখ্যায় এসেছে, অর্থাৎ সর্বমোট ১১৫ বার করে। “ঈমান ও কুফর” শব্দদুটো সমপরিমানে বলা হয়েছে, অর্থাৎ ২৫ বার করে। “গরম” ও “ঠান্ডা” যেহেতু দুটো বিপরীতমুখী ঋতু, তাই এ শব্দ দুটো সমান সংখ্যায় এসেছে ১১৫ বার করে। আরবী ভাষায় “কুল” মানে বলো, তার জবাবে বলা হয় “কালু” মানে তারা বললো। সমগ্র কোরআনে এ দুটো শব্দও সমান সংখ্যকবার এসেছে, অর্থাৎ ৩৩২ বাড় করে। “মালাকুন” কিংবা “মালায়েকা” মানে ফেরেশতা কিংবা ফেরেশতারা। কোরআনে এ শব্দটি এসেছে ৮৮ বাড়, একইভাবে ফেরেশতার চির শত্রু “শয়তান কিংবা “শায়াতীন” এ শব্দটিও এসেছে ৮৮ বার। “আল খাবিস” মানে অপবিত্র, “আত তাইয়েব” মানে পবিত্র। সমগ্র কোরআনে এ দুটি শব্দ মোট ৭ বার করে, অর্থাৎ একই সংখ্যায় নাযিল হয়েছে। প্রশ্ন জাগতে পারে ভালোর চাইতে মন্দই তো বেশী, তাহলে এ দুটো শব্দকে সমান রাখা হলো কিভাবে। এ কথার জবাবের জন্য সুরা আনফালের ৩৭ নং আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করা যাক। এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “অপবিত্রকে পবিত্র থেকে আলাদা করার জন্যে তিনি অপবিত্রকে একটার ওপর আরেকটা রেখে পুঞ্জীভূত করেন এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে ফেলে দেন”। এতে বুঝা যায় যদিও “পাপ পূন্য” সমান সংখ্যায় এসেছে, কিন্তু “পুঞ্জীভূত” করা দিয়ে তার পরিমান যে বেশী তা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। “ইয়াওমুন” মানে দিন। সমগ্র কোরআনে এ শব্দটি ৩৬৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। বছরে যে ৩৬৫ দিন এটা কে না জানে। ইয়াওমুন শব্দের বহুবচন “আইয়াম” মানে দিনসমূহ, এ শব্দটি এসেছে ৩০ বার। আরবী ভাষায় “চাঁদ” হচ্ছে মাসের সূত্র সূচক, গড়ে বছরের প্রতি মাসে ৩০ দিন, এটাই হচ্ছে চান্দ্রবছরের নিয়ম। হতবাক হতে হয় যখন দেখি চাঁদের আরবী প্রতিশব্দ “কামার” শব্দটি কোরআনে মোট ৩০ বারই এসেছে। “শাহরুন” মানে মাস, কোরআন মাজীদে এ শব্দটি এসেছে মোট ১২ বার। “সানাতুন” মানে বছর, কোরআনে এ শব্দটি এসেছে ১৯ বার। কারণ হিসেবে আমরা সম্প্রতি আবিস্কৃত গ্রীক পন্ডিত মেতনের “মেতনীয় বৃত্তের” কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনিই প্রথম এ তত্ত্বটি আবিস্কার করেন যে, প্রতি ১৯ বছর পর সূর্য ও পৃথিবী একই বৃত্তে অবস্থান করে। কোরআনে “ফুজ্জার” (পাপী) শব্দটি যতবার এসেছে, “আবরার” (পূণ্যবান) শব্দটি তার দ্বিগুন এসেছে। অর্থাৎ “ফুজ্জার” ৩ আর “আবরার” ৬ বার। এর কারণ হচ্ছে, শাস্তির তুলনায় পুরস্কারের পরিমান আল্লাহ তাআলা সব সময় দ্বিগুন করে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। কোরআনের সুরা সাবা’র ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন “এ ধরনের লোকদের জন্যই (কেয়ামতে) দ্বিগুন পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। এটা হচ্ছে বিনিময় সে কাজের যা তারা দুনিয়ায় করে এসেছে”। এ কারণেই দেখা যায়, গোটা কোরআনে “পাপী” ও “পূন্যবাণ” শব্দের মতো “আযাব” শব্দটি যতবার এসেছে, “সওয়াব” শব্দটি তার দ্বিগুন এসেছে। অর্থাৎ আযাব ১১৭ বার, সওয়াব ২৩৪ বার। কোরআনে একাধিক জায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করলে তিনি তার বিনিময় বাড়িয়ে দেবেন। সম্ভবত এ কারণেই কোরআনে “গরীবী” শব্দটি এসেছে ১৩ বার, আর বিপরীতে “প্রাচুর্য” শব্দটি এসেছে ২৬ বার। কোরআনে কারীমের বিভিন্ন জায়গায় এভাবে গাণিতিক সংখ্যার অদ্ভুত মিল দেখে কোরআনের যে কোন পাঠকই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবতে থাকে, এটা নিঃসন্দেহে কোন মানুষের কথা নয়। কোন একটি কাজ করলে তার যে অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়াবে তার উভয়টিকেই আশ্চর্যজনকভাবে সমান সংখ্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। “গাছের চারা উৎপাদন” করলে গাছ হয়। তাই এই দুটো শব্দই এসেছে ২৬ বার করে। কোন মানুষ “হেদায়াত” পেলে তার প্রতি রহমত বর্ষিত হয়, তাই এ দুটো শব্দ কোরআনে এসেছে ৭৯ বার করে। “হায়াত” এর অপরিহার্য পরিণাম হচ্ছে “মওত”। এ শব্দদুটোও এসেছে ১৬ বার করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন “যাকাত” দিলে “বরকত” আসে, তাই কোরআনে দুটো শব্দই এসেছে ৩২ বার করে। “আবদ” মানে গোলামী, আর আবীদ মানে গোলাম। গোলামের কাজ গোলামী করা, তাই কোরআনে এই উভয় শব্দই এসেছে ১৫২ বার করে। “মানুষ সৃষ্টি” কথাটা এসেছে ১৬ বার, আর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে “এবাদত”; সুতরাং তাও এসেছে ১৬ বার। “নেশা” করলে “মাতাল” হয়, তাই এ দুটো শব্দও এসেছে ৬ বার করে। কোরআনে ইনসান শব্দটি এসেছে ৬৫ বার। এবার ইনসান বানাবার উপকরণগুলোকে বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগ করে মিলিয়ে দেখা যাক: প্রথম উপাদানঃ “তোরাব” (মাটি) এসেছে – ১৫ বার দ্বিতীয় উপাদানঃ “নুতফা” (জীবণকণা) এসেছে – ১২ বার তৃতীয় উপাদানঃ “আলাক” (রক্তপিন্ড) এসেছে -৬ বার চতুর্থ উপাদানঃ “মোদগা” (মাংসপিন্ড) এসেছে – ৩ বার পঞ্চম উপাদানঃ “এযাম” (হাড়) এসেছে – ১৫ বার সর্বশেষ উপাদানঃ “লাহম” (গোশত) এসেছে – ১২ বার । উপাদানগুলো যোগ করলে যোগফল হবে ঠিক ৬৫ । আর এসব উপাদান দিয়ে যে “ইনসান” বানানো হয়েছে তাও ঠিক ৬৫ বারই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কোরআনের সুরা “আল ক্বামার” –এর প্রথম যে আয়াতটিতে চাঁদ বিদীর্ণ হওয়ার সাথে কেয়ামতের আগমন অত্যাসন্ন কথাটি বলেছেন, আরবী বর্ণমালার আক্ষরিক মান হিসাব করলে তার যোগফল হয় ১৩৯০, আর এই ১৩৯০ হিজরী (১৯৬৯ খৃষ্টাব্দ) সালেই মানুষ সর্বপ্রথম চাঁদে অবতরন করে, জানিনা এটা কোরআনের কোন মোজেযা, না তা এমনিই এক ঘটনাচক্র, কিন্তু আল্লাহ তাআলার এই মহান সৃষ্টিতে তো ঘটনাচক্র বলে কিছু নেই। এ কারণেই হয়তো মানুষের চাঁদে অবতরনের সাথে কোরআনের আলোচ্য আয়াতটির সংখ্যামানের এই বিস্ময়কর মিল আমরা দেখতে পাচ্ছি। 
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ মূল লেখাটা আল কোরআন একাডেমী, লন্ডন থেকে প্রকাশিত হাফেজ মুনীর উদ্দীন আহমদ এর “কোরআনের সহজ সরল বাংলা অনুবাদ” থেকে নেওয়া। কারও কোথাও কোন জিজ্ঞাসা থাকলে বা কিছু জানানোর থাকলে info@alquranacademylondon.co.uk তে মেইল করার অনুরোধ রইলো। - জিয়া চৌধুরী

Wednesday, August 7, 2013

আল-কোরআনের লোহা সংক্রান্ত মিরাকল


আল-কোরআনের লোহা সংক্রান্ত মিরাকল


কোরআনের একটি বিষ্ময়কর বিষয় হচ্ছে লোহা ধাতুর বিবরণ। কোরআনের সুরা “আল হাদীদ” এ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আমি লোহা নাযিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রচুর শক্তি ও মানুষদের জন্যে প্রভূত কল্যাণ ।” লোহা নাযিলের বিষয়টি তাফসীরকারকরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন; কিন্তু যেখানে আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট “নাযিল” শব্দটি রয়েছে সেখানে এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের দিকে না গিয়ে আমরা যদি কোরআনের আক্ষরিক অর্থের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভাবনীও ঠিক একথাটাই বলছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, লোহা উৎপাদনের জন্য যে ১৫ লক্ষ সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন তার কোনো উপকরণ আমাদের পৃথিবীতে নেই। এটা একমাত্র নক্ষত্রের তাপমাত্রা দ্বারাই সম্ভব। লক্ষ লক্ষ বছর আগে মহাশূণ্যে কোন নক্ষত্রে সুপার নোভা প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলে লোহা নামের এ ধাতু মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তা পৃথিবীতে “নাযিল” হয়। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানের বক্তব্য জানার জন্য এই লিংকটি ব্রাউজ করি - 10-Billion-Year-Old Exploding Stars Were a Source of Earth's Iron

এখন দেখা যাক লোহা সম্পর্কে আল্লাহ কি বলছেন-
আল-হাদীদের ২৫ নং আয়াতে বলা হচ্ছে--


আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী। [সুরা হাদীদ: ২৫]
(57:25) Indeed We sent Our Messengers with Clear Signs, and sent down with them the Book and the Balance that people may uphold justice.And We sent down iron, wherein there is awesome power and many benefits for people, so that Allah may know who, without even having seen Him, helps Him and His Messengers. Surely Allah is Most Strong, Most Mighty.

লক্ষ করুন এখানে স্পস্ট বলা হচ্ছে লোহাকে "নাযিল"( sent down )করা হয়েছে।
আরবিতে وَأَنزَلْنَا ("anzalna,")-আনযালনা মানে পাঠান বা প্রেরন করা বা নাযিল করা। 
বিস্ময়করভাবে কোরআন বলছে লোহাকে পৃথিবীতে পাঠান হয়েছে(sent down), যে তথ্যটি একদম সঠিক। শেষে দেয়া লিংকের মাধ্যমে ভিডিও দেখলে বিষয়টি পূর্ণরূপে অনুধাবন করা যাবে।
এবার আসুন আমরা দেখি লোহার গঠন প্রকৃতি--

১/লোহার ৪ টি স্টেবল আইসটোপ আছে- 54Fe, 56Fe,57Fe, 58Fe

অর্থাৎ ৫৪, ৫৬, ৫৭, ৫৮ এই ৪ টি আইসটোপ ।

২/ লোহার এটমিক নাম্বার ২৬

৩/ লোহার স্টেবল আইসটোপগুলো নিউট্রন সংখ্যা ২৮, ৩০, ৩১, ৩২

কোরআনে এই তথ্যগুলো কোড করা হয়েছে এভাবে--

১/ কোরআনের ৫৭ নং সুরার নাম লোহা বা আল-হাদীদ, এই সুরার আগে ৫৬ টি ও পরে ৫৭ টি সুরা আছে (মোট ১১৪ টি সুরা), এই সংখ্যাগুলো লোহার আইসটোপের সাথে সামন্জস্যপুর্ন


২/ ২৫ নং আয়াতে সর্বপ্রথম "হাদীদ বা লোহা" শব্দটি এসেছে। এই আয়াত পর্যন্ত ২৬ বার আল্লাহ নামটি এসেছে। ২৬ লোহার এটমিক নাম্বার।

আল্লাহ শব্দটি এসেছে-- আয়াত নং ১, ৪, ৫, ৭, ৮, ৯, ১০(৪বার),১১, ১৪(২বার), ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১(৩ বার), ২২, ২৩, ২৪, ২৫(২বার)। মোম
মোট ২৬ বার।

৩/ এই সুরায় আয়াত আছে ২৯টি, আর "লোহা বা হাদীদ" শব্দটি এসেছে ২৫ নং আয়াতে , ২৯-২৫= ৪। আর লোহার স্টেবল আইসটোপ সংখ্যা হল ৪ টি।

৪/ পুরা হাদীদ সুরায় আল্লাহর নাম এসেছে ৩২ বার যা একটি স্টেবল আইসটোপের নিউট্রন সংখ্যার সমান।


আমরা যদি সংখেপে দেখি তাহলে পাব--
--- আল্লাহ বলেছেন লোহাকে নাযিল ( sent down) করা হয়েছে , যা একদম সঠিক
--- কোরআনের ৫৭ নং সুরার নাম লোহা বা আল-হাদীদ, লোহার একটি স্টেবল আইসটোপের মান ৫৭।
--- লোহার এটমিক নাম্বার ২৬ , আর আল্লাহর নাম এসেছে ২৬ বার ( ২৫ নং আয়াত পর্যন্ত , যে আয়াতে লোহা শব্দটি আছে।
---পুরা হাদীদ সুরায় আল্লাহর নাম এসেছে ৩২ বার যা একটি স্টেবল আইসটোপের নিউট্রন সংখ্যার সমান
অর্থাৎ স্পস্টতই কোরআনে লোহা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সন্নিবেশীত হয়েছে অত্যন্ত
বিস্ময়করভাবে
এ বিষয়টি আল-কোরআন যে কোন মানবরচিত গ্রন্থ নয় তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ।
Source: www.amarblog.com and others

Watch, download and save this video please

Quran The mystery in Iron Discovery channel 

 

Thursday, July 18, 2013

Quran the Ultimate Miracle (7 parts english video documentary)

Lecture by Ahmed Deedat - Al-Quran: A miracle of Miracles - Abu Dhabi 5th July 1987

আল-কোরআনের মিরাকল: সমুদ্রের পানির মাঝখানে অদৃশ্য দেয়ালের অস্তিত্ব

আল-কোরআনের মিরাকল: সমুদ্রের পানির মাঝখানে অদৃশ্য দেয়ালের অস্তিত্ব
- শাহরিয়ার আজম



কুরআন কি বর্ণনা করেছে এ ক্ষেত্রে? 
কুরআন কারিম সর্বকালের সর্ব যুগের মানুষের জন্য এক আলোকবর্তিকা ও বৈজ্ঞানিক সাংকেতিক সংক্ষিপ্ত বার্তা। পৃথিবীর মাঝে একমাত্র আল-কোরআন ও তার নিয়মাবলী মানুষকে শান্তির ধারায় আনয়ন করতে পারে। কুরআনের এ telegraphic message নাস্তিকতা ও বহুঈশ্বরবাদ হতে হতে মানুষকে হটিয়ে এক আল্লাহর দিকে আহবান করে। আসুন দেখি কি scientific message লুকিয়ে আছে কুরআনের এই আয়াতে যা ১৩৫০ বছর আগে মানুষ ভাবতে পারেনি বা সেভাবে চিন্তা করার যোগ্যতা বা সামর্থ অর্জন করতে সক্ষম হয়নি-
027.061 أَمَّنْ جَعَلَ الأرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لا يَعْلَمُونَ
কে পৃথিবীকে করেছে আবাসযোগ্য এবং তার মধ্যে প্রবাহিত করেছেন নদী-নালা। আর তাতে স্থাপন করেছেন সৃদৃঢ় পর্বতমাল এবং দুই সাগরের মাঝখানে সৃষ্টি করেছেন অন্তরায়। আল্লাহর সঙ্গে কি অন্য কোনো ইলাহ আছে? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না। (নামাল, ২৭ : ৬১)
055.019 مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ
055.020 بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لا يَبْغِيَانِ
055.021 فَبِأَيِّ آلاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন, যারা পরস্পর মিলিত হয়। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক আড়াল, যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। অতএব (হে মানব ও দানব) তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোনো নিয়ামতকে অস্বীকার করবে? (রহমান, ৫৫ : ১৯- ২১)


সামুদ্রিক বিজ্ঞানিদের আবিষ্কার-
গত ১৩৫০ বছরে এই আয়াতগুলি ব্যাখ্যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে ছিল এক অজানা রহস্য। কিন্তু বর্তমানে Marine Science বা Oceanologist সামুদ্রিক বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ভিত্তিতে আমরা এখন এই আয়াতগুলির ব্যাখ্যা দিতে পারি বলা যায় পানির মতো পরিষ্কার কুরআনিক তথ্য।। উষ্ণ পানির স্রোতধারা বিশ্বের শীতল সাগরগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সাগরসমূহে এ ধরনের স্রোতের প্রবাহ পরিলক্ষিত হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য যারা মনে করেন রাসুল (সাঃ) আরব সাগরের কাছে গিয়ে হটাৎ করে এ তত্ব আবিষ্কার করেছেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই এ ধরনের স্রোত কেবল শুধু আরব উপদ্বীপের চারপাশেই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, বরং ভূমধ্যসাগরীয় ও ভারতীয় অঞ্চলসমূহেও এ স্রোতের দেখা পাওয়া যায়না। সর্বপথম এ প্রকারের স্রোতধারা আবিষ্কৃত্র হয় ১৯৪২ সালে। বর্তমানে সেগুলিকে অত্যন্ত জটিল গানিতিক ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে ও কৃত্রিম satellite- এর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আরো বিশ্লেষন-
কুরআন মাজিদের এটিও অতুলনীয় আলৌকিকতা যে, তা এমন একটি রহস্যের দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা তৎকালে তথাকার কোনো আরব প্রত্যক্ষ করাতো দুরের কথা ভাবেওনি, যেখানে বা যে সময়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন। পূর্বে বর্ণিত কুরআন কারিমের আয়াত দুটি বোঝায়,
‘আল্লাহ তাআলা দু’টি সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন এবং সেখানে দুই সাগরের মাঝখানে রয়েছে একটি অদৃশ্য দেয়াল বা আড়াল।’
অতিসম্প্রতি Oceanologist scientist-গন আবিষ্কার করেছেন, পানির এই দুই স্রোতধারা তিনটি মৌল নিয়ম অনুসরনের ফলে পানির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে তা হলো-

১) ঘনত্ব
২) লবণাক্ততা
৩)ও উচ্চতার
তারা এও আবিষ্কার করেছেন, যখন পানির বাইরের স্রোতধারা ভেতরের স্রোতধারার দিকে প্রবাহিত হয় কিংবা তার বিপরীত অবস্থা ঘটে, তখন অন্য স্রোতের পানি তা তৎক্ষণাৎ তার অবস্থা বদলে ফেলে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে আমরা দেখি সেখানে দুই ধরনের পানি স্বাধীনভাবে মিশে যায়, তথাপি উভয় প্রকৃতির পানি তাদের স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ পরিষ্কারভাবে সংক্ষিপ্তাকারে বললে বলতে হয় – পানির স্ব গুনাগুন বজায় থাকে যা অন্য পনির সাথে মিশ্রিত হয়না।কুরআন কারিম এমন একটি জটিল রহস্য বর্ননা করেছে, বিজ্ঞানীরা তা আবিষ্কার করার বহু শতাব্দী পূর্বে।
যেমন রোম সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর পানি একটি অপরটির সাথে মিশতে পারে না, কারণ সেখানে রয়েছে অন্তরায়। অথচ যে যুগে এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর কোন যন্ত্র পাতি ছিল না। এমন যুগে কুরআন বলে দিচ্ছে:
مرج البحرين يلتقيان بينهما برزخ لا يبغيان
তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করে না। (সূরা রাহমান ১৯-২০)
বিভিন্ন তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে যে, দুই সমুদ্র বলতে মিঠা ও লোনা সমূদ্র বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে উভয় প্রকার সাগর ও নদী সৃষ্টি করেছেন। কিছু কিছু স্থানে দু’দরিয়া এক সাথে মিলিত হয়ে যায়, যার উদাহরন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু যে স্থানে মিষ্টি ও লোনা দুপ্রকার নদী বা সাগর মুখোমুখি বা পাশাপাশি প্রবাহিত হয় সেখানে বেশ দুর পর্যন্ত উভয়ের পানি আলাদা ও স্বতন্ত্র থাকে। একদিকে থাকে মিষ্টি পানি ও অপরদিকে থাকে লোনা পানি। কোথাও কোথাও এই মিষ্টি ও লোনা পানি উপরে নীচেও প্রবাহিত হয় (ঘনত্ব, লবণাক্ততা ও উচ্চতার কারনে )। পানি তরল ও সূক্ষ্ম পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরে মিশ্রিত হয় না।


Jack V Costa-র আবিষ্কার-
ফ্রান্সের বিজ্ঞানী জাক ভি. কোষ্টা, যিনি সমুদ্রের ভিতর পানি রিসার্চ বিষয়ে প্রসিদ্ধ, তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রোম সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগর রাসায়নিক মিশ্রনের গুনাবলী ও মাত্রার দিক থেকে একটি অন্যটির চেয়ে ভিন্ন রকম। তিনি এ বাস্তব সত্যটি হাতেনাতে প্রমানের উদ্দেশ্যে জিব্রাল্টারের দুই সমুদ্রের মিলন কেন্দ্রের কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশে গবেষণা চালালেন, সেখান থেকে তথ্য পেলেন যে জিব্রাল্টারের উত্তর তীর [মারুকেশ] আর দক্ষিণ তীর [স্পেন] থেকে আশাতীতভাবে একটি মিষ্টি পানির ঝর্ণা উথলে উঠে। এ বড় ঝর্ণাটি উভয় সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ৪৫ সূক্ষ্ম কোনে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়ে চিরুনির দাঁতের আকৃতি ধারণ করে বাঁধের ন্যায় কাজ করে। এ ক্রিয়াকলাপের ফলে রোম সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগর একটি আরেকটির সঙ্গে মিশতে পারে না।
দু’টি সমুদ্রের মিলনস্থলে যে পৃথকীকরণ বা পর্দা রয়েছে তা খালি চোখে বুঝার উপায় নেই। কেননা বাহ্যত সব সাগর একই রূপের মনে হয়। শুধু তিনি নন, বরং সমগ্র মেরিন বিজ্ঞানীরাই এই বাঁধা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। তারা ১৯৪২ সনে শতাধিক মেরিন স্টেশন বসিয়ে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরীক্ষা করলেন। কোন জিনিস দুই সাগরের মিলন কেন্দ্রে বাঁধা সৃষ্টি করে আছে? তারা তথায় আলো পরীক্ষা করেন, বাতাস পরীক্ষা করেন এবং মাটি পরীক্ষা করে এর মধ্যে কোন বাঁধা বা পর্দা সৃষ্টি করার কারণ খুঁজে পেলেন না। এখানে পানির একটি হালকা, একটি ঘন রং পরিলক্ষিত হয়। যা খালি চোখে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়।
এমনকি বিজ্ঞানীরা আরো গভীর ভাবে বিষয়টিকে উপলব্ধির জন্য এবং আরো-পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র-এর দূরের থেকে অনুধাবনের পদ্ধতির মাধ্যমে বা এর মাধ্যমে ছবি ধারণ করেন।
যার বর্ণনা এরূপ যে, ভূমধ্য সাগরের পানি গাঢ় নীল এবং আটলান্টিক সাগরের পানি হালকা নীল, আর জিবরাল্টার সেল যা পাহাড়াকৃতির এবং তার রং হল খয়েরি।


ঘনত্ব-উষ্ণতা এবং লবণাক্ততার দিক থেকে ভূমধ্য সাগরের পানি আটলান্টিকের তুলনায় অনেক বেশী। আরো মজার ব্যাপার হলো, ভূমধ্য সাগরের পানি জিবরাল্টার সেল বা সাগর তলের উঁচু ভূমির ওপর দিয়ে আটলান্টিক সাগরের মধ্যে শতাধিক কিলোমিটার প্রবেশ করেছে এবং তা ১০০০ হাজার মিটার গভীরে পৌঁছার পরেও তার উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের ও রঙ্গের কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। যদিও এতদূভয়ের মাঝে রয়েছে প্রচন্ড ঢেউ, প্রবল খরস্রোত এবং উত্তাল তরঙ্গ তথাপিও পরস্পর মিশ্রিত হয় না এবং একে অন্যকে অতিক্রম করতে পারে না। যেহেতু উভয়ের মাঝে রয়েছে একটি পর্দা।

খ্যাতনামা Marine Biologist- Jack V Costa-র ইসলাম গ্রহন-


Marine Biology-র একজন প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী Jack V Costa । তিনি সমুদ্রের পানি নিয়ে গবেষণা করছেন কয়েক যুগ ধরে- বিভিন্ন গবেষনার মধ্যে অন্যতম প্রধান রিসার্চ ছিল-কি কারণে দুই সমুদ্রের পানির পরস্পর সম্মিলন ঘটে না, এক সমুদ্রের পানি এক রঙ্গের এবং এক স্বাদের অপর সমুদ্রের পানি আরেক রঙ্গের এবং আরেক স্বাদের।
পানি সম্পর্কে গবেষণায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন তিনি। তারঁ গবেষনালব্ধ ফলাফল আমরা জানি যাকে বলা হয়- COSTA Theory ।একটা সময় পর তার সঙ্গে একজন মুসলমান বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎ হল, আলোচনাকালে কোষ্টা যখন তার মতবাদ উপস্থাপন করল তখন তিনি বললেন-‘‘আপনি তো এখন গবেষণা করেছেন। আমি আপনাকে শত শত বছর আগের গবেষণা দেখাতে পারব। যখন মুসলিম বিজ্ঞানী তাকে কুরআনের আয়াত দেখালো-
055.019 مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ
055.020 بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لا يَبْغِيَانِ
055.021 فَبِأَيِّ آلاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন, যারা পরস্পর মিলিত হয়। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক আড়াল, যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। অতএব (হে মানব ও দানব) তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোনো নিয়ামতকে অস্বীকার করবে? (রহমান, ৫৫ : ১৯- ২১)
কোষ্টা স্তম্ভিত হয়ে গেল এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হল।




Wednesday, July 17, 2013

পবিত্র কুরআন নিয়ে নকুল কুমারের গান টি সবাই শুনুন এবং শেয়ার করুন - বিশ্ব থেকে হারাবে না পবিত্র কোরআন



অপর একটি অসাধারণ গান - কুরআন হলো এই দুনিয়ার জীবন্ত গ্রন্থ:





কুরআনের ইলাহী সংরক্ষণ ও একজন ইহুদী পন্ডিতের ইসলাম গ্রহণ

কুরআনের ইলাহী সংরক্ষণ ও একজন ইহুদী পন্ডিতের ইসলাম গ্রহণ

- মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী


আব্বাসীয় খলীফা মামূনুর রশীদের দরবারে মাঝে মাঝে শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হ’ত। এতে তৎকালীন বিভিন্ন বিষয়ে বিদগ্ধ পন্ডিতগণ অংশগ্রহণ করতেন। একদিন এমনি এক আলোচনা সভায় সুন্দর চেহারাধারী, সুগন্ধযুক্ত উত্তম পোষাক পরিহিত জনৈক ইহুদী পন্ডিত আগমন করলেন এবং অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অলংকারপূর্ণ এবং জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখলেন। বিস্মিত খলীফা সভা শেষে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ইহুদী? সে স্বীকার করল। মামূন তাকে বললেন, আপনি যদি মুসলমান হয়ে যান তবে আপনার সাথে উত্তম ব্যবহার করা হবে। তিনি উত্তরে বললেন, পৈত্রিক ধর্ম বিসর্জন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বলে তিনি প্রস্থান করলেন।
কিন্তু এক বছর পর তিনি মুসলমান হয়ে আবার দরবারে আগমন করলেন এবং আলোচনা সভায় ইসলামী ফিক্বহ সম্পর্কে সারগর্ভ ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। সভাশেষে মামূন তাকে ডেকে বললেন, আপনি কি ঐ ব্যক্তি নন, যিনি গত বছর এসেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমিই ঐ ব্যক্তি। মামূন জিজ্ঞেস করলেন, তখন তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর এখন মুসলমান হওয়ার কি এমন কারণ ঘটল?
তিনি বললেন, এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমি বর্তমান কালের বিভিন্ন ধর্মগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখার মনস্থ করি। আমি একজন সুন্দর হস্তলেখাবিশারদ। স্বহস্তে গ্রন্থাদি লিখে উচুঁ দামে বিক্রয় করি। তাই পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করলাম এবং এগুলির অনেক জায়গায় নিজের পক্ষ থেকে কিছু কমবেশী করে লিখলাম। অতঃপর কপিগুলো নিয়ে আমি ইহুদীদের উপাসনালয়ে উপস্থিত হ’লাম। তারা অত্যন্ত আগ্রহ সহ্কারে আমার কপিগুলো কিনে নিল। অতঃপর একইভাবে ইঞ্জীলের তিন কপি করলাম এবং তাতে কমবেশী করে লিখে খ্রীষ্টানদের গীর্জায় নিয়ে গেলাম। সেখানেও তারা খুব আগ্রহভরে কপিগুলো ক্রয় করে নিল। এরপর আমি কুরআনের ক্ষেত্রেও একই কাজ করলাম এবং সে কুরআনের বেলাও আমি কম-বেশী করে লিখলাম এবং বিক্রয়ের জন্য নিয়ে গেলাম। কিন্তু ক্রয়কারীকে দেখলাম, সে প্রথমে আমার লেখা কপিটি নির্ভুল কি না যাচাই করে দেখল। অতঃপর সেখানে কমবেশী দেখতে পেয়ে ক্রয় না করে কপিগুলি ফেরত দিল।
এ ঘটনা দর্শনে আমি এ শিক্ষাই গ্রহণ করলাম যে, নিশ্চয়ই এ গ্রন্থ সংরক্ষিত, আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং এর সংরক্ষক। আর এই উপলব্ধিই আমার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণ হয়ে দাড়ালো।
এই ঘটনা বর্ণনাকারী কাযী ইয়াহইয়া বিন আকছাম বলেন, ঘটনাক্রমে সে বছরই আমার হজ্জব্রত পালন করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে প্রখ্যাত আলেম সুফিয়ান ইবনে ওয়ায়নার সাথে সাক্ষাত হ’লে ঘটনাটি আমি তার নিকটে ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে এরূপ হওয়াই যথার্থ। কারণ কুরআনেইতো এ চিরন্তন সত্যের সমর্থনে আয়াত রয়েছে। তিনি বললেন, কোথায় রয়েছে? সুফিয়ান বললেন, কুরআনে যেখানে তাওরাত ও ইঞ্জীলের আলোচনা এসেছে, সেখানে এসেছে, ‘তাদেরকে ইলাহী গ্রন্থের দেখাশোনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তারা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন’ {মায়েদা ৫/৪৪}। অতঃপর যখন তারা দায়িত্ব পালন করেনি তখন গ্রন্থদ্বয় বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’ {হিজর ১৫/৯}। আল্লাহ নিজেই আমাদের জন্য কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন ফলে তা বিনষ্ট হয়নি।
(আল-মুনতাযাম ফিত তারীখ ১০/৫১; কুরতুবী ১০/৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৩৮৮)।


শাশ্বত মোজেজা : পবিত্র কোরআন (১-২০)

শাশ্বত মোজেজা : পবিত্র কোরআন (১-২০)


এক.
অবিনশ্বর ও চিরন্তন অলৌকিকতায় ভরপুর পবিত্র কোরআনই একমাত্র খোদায়ি মহাগ্রন্থ যা সব যুগেই মানুষকে কল্যাণের অশেষ ধারায় সিক্ত করতে সক্ষম। এর নিত্য-নতুন কল্যাণ ও আকর্ষণ অফুরন্ত। তাই প্রথম থেকেই চিরনবীন আলকোরআন অলৌকিক বিস্ময়ের অশেষ উৎস।
ইতিহাস সাক্ষী, পবিত্র কোরআনই মানব জাতির ওপর এবং তাদের সভ্যতা সংস্কৃতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে । এ মহাগ্রন্থের শিক্ষা খুব দ্রুত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়। বিশ্বের বিশাল ভূখন্ডে অনেক জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন সংস্কৃতি একত্ববাদের এ ঐশী আলোর প্রভাবে বিলুপ্ত হয়েছে। জ্ঞানের এই অতলান্ত সাগরের মুনি-মুক্তার ভান্ডার থেকে যতই মনি মুক্তা আহরণ করা হোক না কেন তা চিরকালই অজস্র ও অপরিমেয়ই থেকে যাবে। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনের জ্ঞানসাগরের অজস্র দিক গবেষকদের কাছেও অজানা রয়ে গেছে।
কেউ কেউ মানুষের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত জীবনে পবিত্র কোরআনকে সূর্যের সাথে তুলনা করেছেন। সূর্যের কেবল একটি দিক দৃশ্যমান। এ মহাগ্রন্থ সূর্যের আলোর মতই প্রাণ সঞ্চারক ও ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। কিন্তু এর সব দিকের প্রতি লক্ষ্য করা মানুষের সাধ্যাতীত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম বাকের (আঃ) বলেছেন, “পবিত্র কোরআনকে সূর্য ও চাঁদের সাথে তুলনা করা যায়। সূর্য ও চাঁদ সব সময়ই ছিল এবং সব সময়ই পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষকেই আলো দিয়ে আসছে। এভাবে কোরআনও চিরকাল (সব যুগের ও সব অঞ্চলের) মানুষকে আলো দিয়ে যাবে।”
অবশ্য মানুষ তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী এ মহাগ্রন্থ থেকে শক্তি ও হেদায়াত বা সুপথের দিশা পাবে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, কোনো এক প্রজন্ম কোরআনের বা সূর্যের আলো ব্যবহার করায় পরবর্তী প্রজন্ম তা থেকে আর আলোই পাবে না, অথবা কম আলো পাবে। সুরা ইব্রাহিমের প্রথম আয়াতেই মহান আল্লাহ বলেছেন, “এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি-যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন-পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে।”
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইসলামের শত্রুরা পবিত্র কোরআনের কপি পুড়িয়ে বা তা বিকৃত করার মাধ্যমে এর প্রতি অবমাননার যেসব কাজে জড়িত হচ্ছে তা মানুষের ওপর এই মহাগ্রন্থের বিস্ময়কর প্রভাবের প্রতিহিংসামূলক প্রতিক্রিয়া। মজার ব্যাপার হল, ইসলাম ও কোরআন-বিদ্বেষী এ ধরনের তৎপরতা সত্ত্বেও কোরআনের প্রতি অমুসলমানদের আগ্রহ দিনকে দিন বাড়ছে এবং বাড়ছে ইসলামে দীক্ষিতের সংখ্যা। এটাও পবিত্র কোরআনের আরেকটি মোজেজা বা অলৌকিকত্ব।
বৃটিশ লেখক কেন্ট গ্রেইক “কোরআনকে কিভাবে চিনেছি” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, ” একজন মুসলিম নারী ও পুরুষের ওপর কোরআনের যে প্রভাব তা এ মহাগ্রন্থের প্রতি তাদের বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত এবং এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মত একজন অমুসলিম কোরআন সম্পর্কে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস ছাড়াই যখন তা খুলে পড়তে শুরু করি তখনও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা অসম্ভব। এভাবে অমুসলমি কেউ যতই কোরআন পড়তে থাকে ততই তার ওপর এ গ্রন্থের প্রভাবও বাড়তেই থাকে। আর এটা বিস্ময়কর বা ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার।”
বৃটিশ লেখক কেন্ট গ্রেইক আরো লিখেছেন,”আমরা ইংরেজরা ১৪০০ বছর আগে বৃটেন ও আশপাশের বৃটিশ দ্বীপগুলোতে প্রচলিত ভাষাগুলো বুঝতে পারি না। ভাষা বিশেষজ্ঞ ফরাসি অধ্যাপকও ১৪০০ বছর আগের ফরাসি ভাষা বোঝেন না। কিন্তু কোরআনের ভাষায় সেকেলে হয়ে পড়ার এমন কোনো নজির নেই। আমরা যখন কোরআন পড়ি তখন মনে হয় যেন কোনো আরব দেশের আধুনিক সংবাদপত্র বা বই পড়ছি।”
জার্মানির মহাকবি গ্যাটে পবিত্র কোরআন পড়ে এত গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে এ মহাগ্রন্থের দশটি সুন্দর সূরা তিনি নোট করে রাখেন। নিজ শিক্ষকের কাছে লেখা চিঠিতে গ্যাটে লিখেছেন, “কোরআন মহত্ত্ব, কল্যাণ ও বিস্ময়কর বাস্তবতায় ভরপুর। .. … হযরত মূসা (আঃ)’র যে দোয়ার কথা কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে সেভাবেই আপনার জন্য প্রার্থণা করতে চাই। যেখানে বলা হয়েছে যে, “মূসা বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন,আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। (সূরা ত্বাহা, ২৫-২৮)”
কোরআনের এই আয়াত অনুযায়ী মানুষ মহান আল্লাহর ওপর ভরসার মাধ্যমে এবং সর্বরোগ নিরাময়কারী ইসলামী চিন্তাধারার ওপর বিশ্বাসের বলে নিজেকে ভয়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম।
গ্যাটে “প্রাচ্যের কাব্য” শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে মনোজ্ঞ এক কবিতায় বলেছেন, কোরআন সম্পর্কে কোনো কোনো বিতর্ক নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। এরপর তিনি বলেছেন, “… শুধু এটাই জানি যে, কোরআন বইয়ের রাজা। ”
পবিত্র কোরআন সৃষ্টি জগতের নানা রহস্য, উচ্চতর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, নৈতিক ও জীবন গড়ার শিক্ষাসহ অশেষ জ্ঞান এবং তথ্যের উৎসে ভরপুর। খোদায়ী এ মহাগ্রন্থ নিজেকে আলোর মত পবিত্র ও সুন্দর এবং সত্য ও মিথ্যার স্পষ্টতম পার্থক্যকারী প্রভৃতি নামে অভিহিত করেছে। পবিত্র কোরআন মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় আল্লাহর কথা। উল্লেখ করে মহান আল্লাহর অনেক সুন্দর নাম ও গুণ। যেমন, তিনিই সৃষ্টিকূলের ও সব অভিনবত্বের উৎস। এ মহান গ্রন্থ সব সময়ই আল্লাহর এবাদত ও একত্ববাদের ওপর অবিচল থাকার পথ দেখায় মানুষকে। পবিত্র কোরআনে রয়েছে ফেরেশতা, আসমানি গ্রন্থ ও নবী-রাসূলদের বর্ণনা। সৃষ্টির সূচনা, ক্রমবিকাশ ও সমাপ্তি তথা পরকাল এবং আল্লাহর কাছে সব কিছু ফিরে যাওয়ার কথা। সর্বোপরি অনন্য এ ঐশী গ্রন্থে রয়েছে মানুষের মুক্তি বা সৌভাগ্য ও দূর্ভোগের পথ । কোরআনে কখনও মিথ্যা বা বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেনি ও ভবিষ্যতেও ঘটবে না। কারণ, আল্লাহই বলেছেন, “এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই , পেছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। (হা মিম সিজদা-৪২)
চিরমধুর, চিরনবীন ও বিশ্বজনীন গ্রন্থ আল কোরআনের উপযোগীতা সব যুগে এবং সব স্থানেই কার্যকর রয়েছে। বিশেষ কোনো জাতির জন্য অবতীর্ণ হয়নি এ ঐশী গ্রন্থ। কোরআনের বহু আয়াতে ” হে মানবজাতি বা হে মানুষ ” শীর্ষক সম্বোধন এর অন্যতম প্রমাণ। একই কারণে নিজেকে ” বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ” ও “মানবজাতির জন্য সতর্ককারী” বলে উল্লেখ করেছে এ মহাগ্রন্থ। অতীতের নবী-রসূল ও জাতিগুলোর কাহিনী থেকে কোরআন শুধু শিক্ষনীয় অংশই উল্লেখ করেছে। কোরআনের বাণীর সুপ্ত অর্থগুলোর ব্যাখ্যা করা হয় নানা দিক থেকে। এভাবে অনেক নতুন তথ্য ও অর্থ বেরিয়ে আসায় সব সময়ই নতুনত্বের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখছে কোরআন।
দুই.
পবিত্র কোরআনের সূরা আসরার নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার।”
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়্যত লাভের পর পবিত্র কোরআন তাঁর ওপর নাজেল হয়। সে যুগে কবিতা রচনাসহ ছন্দবিদ্যা ও অলংকার শাস্ত্র এবং আবৃত্তিতে আরবরা বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিল। জাহেলি যুগে “ওকাজ” নামক বাজার বা মেলায় আরব শিল্পীরা শ্রেষ্ঠ শিল্প ও সাহিত্য-কর্ম নিয়ে উপস্থিত হত। বিচারক ও সমালোচকরা সেরা কবিতা বা কাসিদাগুলো নির্বাচন শেষে সেগুলোর কথা ঘোষণা করতেন। সবচেয়ে সেরা কবিতা বা কাসিদাটি সোনার অক্ষরে লেখা হত এবং তা কাবা ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হত। সবাই বিস্ময়কর ওই শিল্পকর্ম দেখতে যেত। “মুআল্লাক্বাতুস সাবআ” নামে খ্যাত সপ্ত কাসিদা ছিল আরবের বিখ্যাত কবিদের রচনা। সেযুগে তাদের ওইসব রচনাকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট রচনা হিসেবে ধরা হত। কিন্তু পবিত্র কোরআন নাজেল হওয়ার পর এর অলৌকিক ভাষা-শৈলী, প্রকাশ-ভঙ্গী ও সাহিত্য-মান মানুষের অন্তরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে যে সেরা আরব কবিরা লজ্জায় মুখ লুকাতে বাধ্য হন। সপ্ত কাসিদার অন্যতম কাসিদার রচয়িতা ও অন্যতম সেরা আরব কবি “লবিদ বিন রবিয়া” পবিত্র কোরআনের সাথে পরিচিত হওয়ার পর এ মহাগ্রন্থের ভাষায় এতটা আকৃষ্ট হন যে তিনি এরপর আর কখনও কবিতা লেখেননি। বরং সব সময়ই কোরআন পড়ার চেষ্টা করতেন। কেন কবিতা লিখছেন না, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কোরআন আত্মপ্রকাশের কারণে কবিতা রচনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। কোরআনের বক্তব্যের বিপরীতে আমাদের বক্তব্য অর্থহীন ও প্রলাপ মাত্র। আমি কোরআন পড়ে এত মজা পাই যে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের কোনো বক্তব্য আছে বলে আমার জানা নেই। ”
পবিত্র কোরআন প্রকাশের মাধ্যমে নিরক্ষর মহানবী (সাঃ)’র নবুওয়্যাতের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এ ঐশী গ্রন্থের হৃদয় নাড়া-দেয়া বিস্ময়কর আয়াতগুলো অলৌকিকতার স্পষ্ট নিদর্শন। বিশেষ করে মক্কায় নাজেল হওয়া ছোট সূরাগুলোর ছন্দ-মিল ও অন্তমিল, পদ্যময় লালিত্য ও ধ্বনি-মাধুর্য অত্যন্ত উচ্চ মানের। কোরআনের সুললিত ও প্রাণসঞ্চারক বাণীগুলো বড় বড় বাগ্মী ও কবিদের এটা বলতে বাধ্য করেছে যে, “এ বই পুরোপুরি গদ্যও নয়, পুরোপুরি পদ্যও নয়, কেবল কোরআনই কোরআনের তুলনা।”
পবিত্র কোরআনের সূরা ও আয়াতগুলো আরবদের মধ্যে দ্বিমুখী এবং বিপরীতমুখি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। একদিকে তারা কোরআনের হৃদয়স্পর্শী আয়াত শুনে মুগ্ধ হত। এসব আয়াতের অভূতপূর্ব আলংকারিক সৌন্দর্য্য, অভিনবত্ব ও সাহিত্য-মান তাদেরকে অভিভূত করত। অন্যদিকে এসব আয়াতের বিষয়বস্তু তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেগুলো মেনে নেয়া বা সমর্থন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাপদাদার যুগ থেকে প্রচলিত প্রথা, বিশ্বাস ও কুসংস্কার ত্যাগ করা তাদের জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু পবিত্র কোরআনের অকাট্য যুক্তি এবং বুদ্ধি ও বিবেক খাটানোর জন্য এর আহ্বানের জবাব দেয়ার মত ক্ষমতাও তাদের ছিল না। অবশ্য আরবদের অনেকেই কোরআনের হৃদয়-ছোঁয়া বাণী শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে অনেকেই মহানবী (সাঃ)’র বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে।
পবিত্র কোরআনের আলোয় ধীরে ধীরে হিজাজের অজ্ঞতা ও শির্কের ঘাঁটিগুলো বিলুপ্ত হয় এবং ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে গোটা আরব উপদ্বীপ । বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র ইন্তেকালের পর মুসলিম ভূখণ্ডে বিভিন্ন গ্রুপ কোরআনের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা শুরু করায় অনেক বিশেষজ্ঞ ও মুফাসসির পবিত্র কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। হিজরি তৃতীয় শতক থেকে নবম শতক পর্যন্ত বহু জ্ঞানি ও বিশেষজ্ঞ পবিত্র কোরআন সম্পর্কে অনেক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত আরব সাহিত্যিক জাহেজ “নজমুল কোরআন” নামক বইয়ে এ মহাগ্রন্থকে সাহিত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ও অবিনশ্বর গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে ফাখরে রাজি, অস্টম ও নবম শতকে সিয়ুতি পবিত্র কোরআনের অশেষ জ্ঞান ও চিরন্তন বাস্তবতাগুলো সম্পর্কে অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন।
সুন্দর ও সুদৃঢ় ভবনের জন্য যেমন উন্নত বা মজবুত নির্মাণ-সামগ্রী ও সুদক্ষ পরিকল্পনা জরুরি তেম্নি বাণী বা বক্তব্যের সৌন্দর্য্য ও বলিষ্ঠতার জন্য দরকার প্রাঞ্জল ও জোরালো শব্দের পাশাপাশি সুগঠিত বাক্য। এ বিষয়টি পাঠকদের ওপর পবিত্র কোরআনের ব্যাপক প্রভাবের অন্যতম রহস্য।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা জুমারের ২৩ নম্বর আয়াতে এ মহাগ্রন্থকে শ্রেষ্ঠ বাণী বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন,যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পূনঃ পূনঃ পঠিত।” এখানে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলতে কোরআনের আয়াতগুলো যে সবই সুন্দর, সুললিত, সমন্বিত এবং পরস্পর-বিরোধীতা বা বৈপরীত্য থেকে মুক্ত তা বোঝানো হয়েছে। মানুষের কথার মত কোরআনের কোনো কথা হাল্কা মানের ও কোনো কথা গভীর ভাবার্থপূর্ণ এমন নয়। কোরআনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সূরা জুমারের ২৩ নম্বর আয়াতে আরো বলা হয়েছে, “এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের ভেতর বা অন্তর ও বাহির আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই। ”
পবিত্র কোরআনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, খোদাভীরুরা যখন এর আয়াত শোনে তখন তাদের শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হয় এবং তাদের ভেতর ও বাইর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এই ভয় থেকে সূচিত হয় জাগরণ ও সক্রিয়তা এবং দায়িত্ব-সচেতনতা। যাদের মনে সত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত তারা কোরআনের বাণী শুনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। সত্যকে মেনে নেয়ার জন্য তাদের মধ্যে বিনম্র ভাব সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে তারা প্রশান্তি পায়। কোরআনের পাঠক সতর্ককারী আয়াত পড়ে চিন্তায় বিভোর হয় এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন নিদর্শন, নেয়ামত ও দয়া সম্পর্কিত আয়াত পড়ার পর প্রশান্ত হয়। মহানবী (সাঃ)’র সাহাবীরা যখন কোরআনের আয়াত শুনতেন তখন তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু বইত এবং কেঁপে উঠত শরীর। সুসংবাদমূলক আয়াত পড়ে বা শুনে এমনভাবে আনন্দিত হতেন যেন তারা বেহেশত দেখতে পাচ্ছেন এবং অনুরূপভাবে সতর্কতামূলক আয়াত শুনে বা পড়ে তারা অন্তরের কান দিয়ে দোযখে পাপীদের কান্না ও অগ্নিশিখার গর্জন শুনতেন।
পবিত্র কোরআনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, কোনো কোনো বক্তব্য ও ঘটনার পুণরাবৃত্তি। এসব পুনরাবৃত্তি মোটেই একঘেয়ে নয়, বরং সৃষ্টিশীল ও নতুনত্বে ভরপুর হওয়ায় অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও আকর্ষনীয়। কোনো কিছুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আধুনিক যোগাযোগ-বিদ্যায়ও সৃষ্টিশীল পুনরাবৃত্তিকে খুবই কার্যকর পন্থা বলে ধরা হয়। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যাকারদের মতে, পুনরুল্লোখিত আয়াতগুলো পরস্পরকে ব্যাখ্যা করে এবং অনেক অস্পষ্টতা দূর করে। #
তিন.
সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ পবিত্র কোরআন যে কোনো মানুষের রচিত গ্রন্থ হতে পারে না তা অনেক অমুসলিম জ্ঞানী-গুণীও স্বীকার করেছেন। সব যুগের মানুষের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ, মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিশারী এ বইয়ের অলৌকিকতাও চিরস্থায়ী।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, “পবিত্র কোরআন পূর্ববর্তী ও নতুন সব যুগের মানুষের জন্য প্রামাণ্য আদর্শ বা হুজ্জাত। তাই প্রত্যেক প্রজন্মের কাছেই কোরআন সজীব ও নতুন। যারা বার বার পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করে ও এর আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তারা প্রত্যেক বারই এর মধ্যে নতুন কিছু দিক খুঁজে পায়। কোনো কবিতা বা ভাষণের এ ধরণের বৈশিষ্ট্য নেই।”
পবিত্র কোরআনের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই এর প্রতি মুসলমানরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বিশ্বনবী (সাঃ)’র মোজেজা এই কোরআন থেকেই উদ্ভুত। তিনি মানুষকে এ মহাগ্রন্থের মাধ্যমে মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিশা দেখিয়ে গেছেন।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশকে ছাত্রদের ক্লাসের সাথে তুলনা করা হলে এটা বলা যায় যে, প্রাচীন যুগে মানুষের মধ্যে তথ্যের অভাব ছিল এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতা অতটা বিকশিত ছিল না বলে মহান আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখানোর জন্য সহজ সরল বই নাজেল ও প্রাথমিক কর্মসূচীর বা বিধি-বিধানের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধি যতই বিকশিত হয়েছে ততই তাদের উন্নততর বই ও বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে । মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও চিন্তা যখন পরিপক্কতা পেল তখনই তাদেরকে দেয়া হল জীবনের সব দিকের পরিপূর্ণ বিধি-বিধান সম্বলিত গ্রন্থ কোরআন। এ মহাগ্রন্থ এতই পরিপূর্ণ যে, মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে এরপর আর কোনো বই বা জীবন বিধান মানুষের দরকার নেই। বিশ্বনবী (সাঃ)’র যুগে তাঁর কাছে যে কোরআন নাযেল হয়েছিল তা এখনও অবিকৃত রয়েছে। কারণ, মহানবী (সাঃ) ওহি লেখকদের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন লিপিবদ্ধ করেছিলেন। হিজরি ২৮ সনে পবিত্র কোরআনের কয়েকটি কপি সংকলিত হয়েছিল এবং সবাইকে সেগুলো পড়ার ও ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হত।
পবিত্র কোরআনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল- মানুষের চিন্তা ও আচরণ সংশোধনে এর গঠনমূলক ভূমিকা। কোরআন নিজেকে সব মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক বলে উল্লেখ করেছে। সূরা মুদাসসিরের শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, ” এই কোরআন তো মানুষের জন্যে উপদেশদাতা ও সতর্ককারী ছাড়া অন্য কিছু নয় ”
মানুষ তার আত্মাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করার জন্য সব কিছুর আগে কোরআনের শরণাপন্ন হতে পারে। কোরআন অধ্যয়ন আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের অন্যতম যোগসূত্র এবং খোদায়ি জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে মানুষ বস্তুগত আকর্ষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারে।
মানুষের নৈতিক ও আত্মিক রোগগুলোর মূল শেকড় চিহ্নিত করে এসব রোগের চিকিৎসা করা উচিত। তা না হলে একটা পর্যায়ে এসব রোগ সারানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআনের সূরা ইসরার ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।”
পবিত্র কোরআন বিভিন্ন আয়াতে ফেরাউন, কারুন ও বালাম বাউরের মত মানসিক রোগীদের রোগ চিহ্নিত করেছে। এ মহাগ্রন্থ নৈতিক সংকটগুলোর চিকিৎসা-বিধান কখনও গল্প ও কখনও উপমার মাধ্যমে, আবার কখনও স্পষ্ট ভাষায় বা সরাসরি তুলে ধরেছে। পবিত্র কোরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, হিংসা, অহংকার ও লোভের মত বিভিন্ন মন্দ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় যুগে যুগে মানুষ নানা সংঘাত ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। হিংসা ও ক্ষোভের বশীভূত হওয়ার কারণেই হাবিলকে হত্যা করেছিল তারই ভাই কাবিল।
পবিত্র কোরআন মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করে তাকে সম্মান দিয়েছে। এভাবে কোরআন মানুষের মধ্যকার ধ্বংসাত্মক প্রবণতা নির্মূল করে ও ঈমানি চেতনা জাগিয়ে তুলে মানব জীবনকে অর্থপূর্ণ ও লক্ষ্যপূর্ণ করে। এ জন্যই সূরা ইউনুসের ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং এতে রয়েছে মুসলমানদের জন্য অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত ।
সূরা ফুসিলাতের ৪১ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে, বলুন, “এটা (কোরআন) বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার।”
এভাবে কোরআন সুস্থতা ও সঠিক পথ বাতলে দেয় এবং অসুস্থতা ও মন্দ পথ থেকে দূরে থাকার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেয়।
আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, ” পবিত্র কোরআনে রয়েছে সবচেয়ে বড় যন্ত্রণাগুলোর চিকিৎসা। যেমন, এতে রয়েছে খোদাদ্রোহীতা বা কুফরি, নিফাক্ব বা কপটতা ও পথভ্রষ্টতার মত রোগের চিকিৎসা।” তিনি আরো বলেছেন, ” জেনে রাখ, পবিত্র কোরআনে রয়েছে ভবিষ্যদ্বাণী, নানা ঘটনার বর্ণনা, নানা রোগের চিকিৎসা, তোমাদের সামাজিক জীবনের বিধি-বিধান… আল্লাহর কিতাবকে শক্ত করে ধর। কারণ এ বই অত্যন্ত শক্ত রশি এবং চিরন্তন আলো…. যে কেউ কোরআন আকড়ে ধরবে সে মুক্তি পাবে।”
ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোরআনের শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের সাথে জাহেলি বা অজ্ঞতার যুগের লোকদের তুলনা করলে এ মহাগ্রন্থের অসাধারণ প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মূর্তিপূজারী, অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবরা রাসূল (সাঃ)’র মাধ্যমে প্রচারিত পবিত্র কোরআনের শিক্ষার প্রভাবে ঈমান ও হেদায়াতের আলো লাভ করে।
এভাবে পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে ইসলাম সৃষ্টি করেছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা-ভিত্তিক এমন এক মহান সভ্যতা যা সমাজের শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির পথ নিশ্চিত করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একদল লোক রাসূল (সাঃ)’র ওপর ঈমান না আনা সত্ত্বেও তাদের ভেতরকার আত্মিক চাহিদার টানে গোপনে রাসূল (সাঃ)’র ঘরের আশপাশে সমবেত হয়ে তাঁর মুখে উচ্চারিত পবিত্র কোরআনের হৃদয়-জুড়ানো ও জ্ঞান-প্রদীপ্ত আয়াতের বাণী শুনত।
পবিত্র কোরআনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এ মহাগ্রন্থ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও তারা সব সময় সব বিষয়ে সুপথ বা সঠিক পথটি চিনতে সক্ষম হয় না। কারণ, বিশ্বে অনেক কিছুই সত্য ও মিথ্যায় মিশ্রিত বা অস্পষ্ট। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ অজ্ঞতা ও মিথ্যার অন্ধকারকে দূর করার জন্য বিশ্বনবী (সাঃ)’র মাধ্যমে মানব জাতিকে দান করেছেন পবিত্র কোরআনের আলো। মহান আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ এ উপহার থেকে উপকৃত হবার পথও দেখিয়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহ শ্রেষ্ঠ নবী (সাঃ) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের মাধ্যমে।
চার.
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা আররহমানে সৃষ্টি জগতের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা মহান আল্লাহর অশেষ বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক নেয়ামতগুলোর মধ্য থেকে কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। সৃষ্টিকূলের বিস্ময়কর নানা রহস্যের কথাও তুলে ধরেছেন এ সুরায়। যেমন, “তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করে না।”
এ ধরনের অনেক বিস্ময়কর সৃষ্টি রহস্যের কথা তুলে ধরে এ সুরায় মহান আল্লাহ বার বার বলেছেন, “অতএব,তোমরা মানুষ ও জিন তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্া অবদানকে অস্বীকার করবে?”লক্ষনীয় বিষয় হ’ল এ সুরায় উল্লেখিত সমস্ত খোদায়ী নেয়ামতগুলোর মধ্যে প্রথমে আল্লাহর করুণার কথা এবং এরপরই পবিত্র কোরআন শিক্ষা দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। তাই আমাদের উচিত কোরআন সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করা এবং এর শিক্ষাগুলোকে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করা। কারণ, কোরআন অনেক বাস্তবতা বা সত্য তুলে ধরার পাশাপাশি মানুষকে দেখায় সৌভাগ্যের পথ।
কেউ অর্থ-সম্পদে দরিদ্র বা নিঃস্ব হলেও তার মধ্যে যদি থাকে কোরআনের শিক্ষা ও সম্পদ তাহলে সেই প্রকৃত ধনী এবং তার জীবনে দুঃখ করার মত কিছুই নেই।
পবিত্র কোরআনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, আসমানি বা অন্য ঐশী গ্রন্থগুলোর ওপর এ মহাগ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্ব। কারণ, পবিত্র কোরআনের অতীতের ঐশী গ্রন্থগুলোকে সত্যায়ন করে এবং মানব সভ্যতার জ্ঞানগত পরিপূর্ণতার আলোকে একমাত্র এ মহাগ্রন্থেই মানব জীবনের জন্য জরুরি পরিপূর্ণ শিক্ষা ও কর্মসূচী তুলে ধরা হয়েছে। সুরা আলে ইমরানের ২ থেকে ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “তিনি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন সত্যতার সাথে; যা সত্যায়ন করে পূর্ববর্তী কিতাবসমুহের। তিনি এ কিতাবের পূর্বে,নাযিল করেছেন তাওরাত ও ইঞ্জিল, মানুষের হেদায়েতের জন্যে এবং অবতীর্ণ করেছেন মীমাংসা। …”
পবিত্র কোরআনের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, এ মহাগ্রন্থ দুইবার মহানবী (সাঃ)’র ওপর নাজেল হয়েছে। প্রথমে একবার পুরো কোরআনের আয়াত রাসূল (সাঃ)’র অন্তরে নাজেল হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে নাজেল হয় এ মহাগ্রন্থ। তাই এ ঐশী গ্রন্থে মিথ্যা বা ভুলের কোনো অবকাশ নেই। এর বিধি-বিধান মানুষের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
তাওরাত ও ইঞ্জিলের মত গ্রন্থগুলো ঐশী গ্রন্থ হলেও সেগুলো কেবল বিশেষ যুগের বিশেষ সম্প্রদায়ের সামাজিক ও চিন্তাগত অবস্থার প্রেক্ষাপটে নাজেল হয়েছে এবং সেগুলোর বেশির ভাগই কেবল নির্দিষ্ট যুগের জন্য প্রযোজ্য ও সীমিত। কিন্তু পবিত্র কোরআনের উপযোগীতা কালোত্তীর্ণ এবং তা বিশেষ কোনো জাতি ও যুগের জন্য নির্দিষ্ট নয়। কোরআনের বাণী সব যুগেই মানুষের জন্য সজীব, নতুন ও প্রাণবন্ত হয়ে বিরাজ করছে যা কেবল এ মহাগ্রন্থেরই অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং এর অন্যতম প্রধান অলৌকিকতা।
দুঃখজনকভাবে অতীতের ঐশী গ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গেছে এবং সেগুলোর আদিরূপ বা অবিকৃত সংস্করণ আর পাওয়া যায় না। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে পুরোপুরি অবিকৃত ও অক্ষত থেকে গেছে পবিত্র কোরআন। এর প্রমাণ হল, এতে তৌহিদ বা একত্ববাদ এবং আল্লাহর পরিচয় এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে তা যৌক্তিক ও মহান আল্লাহর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাওরাত ও ইঞ্জিলের মত বিকৃত হয়ে যাওয়া ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে অনেক কূসংস্কার স্থান করে নিয়েছে এবং আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা ও নবীদের সম্পর্কে অনেক অমর্যাদাপূর্ণ বক্তব্য দেখা যায় এসব বইয়ে।
পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহ সব ধরণের ত্রুটি ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত, তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং একমাত্র তিনিই ইবাদত বা উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। আকাশ ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁরই। তিনি চিরঞ্জীব ও স্বয়ম্ভু বা স্বয়ং-সৃষ্ট তথা স্ব-অস্তিত্বশীল। অর্থাৎ কেউই তাঁকে অস্তিত্বে আনেননি।
সর্বশেষ ঐশী মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে অতীতের নবী-রাসূলদের কথা উল্লেখ করেছে এবং সবচেয়ে সুন্দরভাবে তাঁদের পরিচয় তুলে ধরেছে। পবিত্র কোরআন তাঁদের সৎ গুণাবলীর প্রশংসা করেছে। মহান আল্লাহর নির্বাচিত এইসব মহাপুরুষদের সম্বোধন করে আল্লাহ সালাম দিয়েছেন ও দরুদ পাঠিয়েছেন। যেমন, কোরআনে বলা হয়েছে, সালাম হে আলে ইয়াসিন!, সালাম হে নূহ! সালাম হে ইব্রাহিম এবং সালাম রাসূলবৃন্দ!
হযরত মূসা (আঃ)’র যুগে সামেরি নামে বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি বাছুরের মূর্তি তৈরি করে মানুষকে ওই মূর্তি পূজার দিকে আহ্বান জানিয়েছিল। এটাই বাস্তব ঘটনা ও সত্য। অথচ বিকৃত হয়ে যাওয়া তৌরাতে হযরত মূসা (আঃ)’র ভাই এবং তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হযরত হারুন (আঃ)-কে ওই বাছুরের মূর্তি নির্মাতা ও বাছুর পূজার আহ্বায়ক হিসেবে অপবাদ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে হযরত মূসা ও হারুন (আঃ)-এই উভয়কেই সব ধরণের শির্ক এবং মূর্তি পূজা থেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনের বাণী এত শ্রতিমধুর ও ছন্দময় যে তার বাণীগুলো মুখস্ত করা সহজ এবং কোরআনের সুরা বা আয়াতগুলো মুখস্ত করা হলে সেসব আয়াতের মর্মার্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও বাস্তব জীবনে সেসব শিক্ষার প্রয়োগ করাও সহজ হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরআনের অনেক হাফেজ বা মুখস্তকারী রয়েছেন। মানব ইতিহাসে আর কোনো বইয়ের এত হাফেজ নেই। বর্তমানেও যুব সমাজের অনেকেই এ মহাগ্রন্থের হাফেজ। কোরআনের তেলাওআত ও নানা আকর্ষণ তাদের জীবনকে বদলে দিচ্ছে।
পবিত্র কোরআন অতীতের ঐশী গ্রন্থগুলোকে শ্রদ্ধা করে এবং নিজেকে সুপথ প্রদর্শনকারী অতীত ধর্মগ্রন্থগুলোর ধারাবাহিকতা বলেই মনে করে। এর পাশাপাশি এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, অতীতের ঐশীগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গেছে এবং দূর্নীতিবাজ পন্ডিত বা আলেমরাই এসব বিকৃতি ঘটিয়েছেন। ফলে এসব বইয়ের কোনো কোনো শিক্ষা মূল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে। পবিত্র কোরআন অন্য ঐশী ধর্মগুলোর অনুসারীদের সাথে মুসলমানদের অভিন্ন দিকগুলো ও ইসলামী শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্বের কথাও উল্লেখ করেছে।
আল-কোরআন অতীতের ঐশীগ্রন্থগুলোর মধ্যে তাওরাত ও ইঞ্জিলকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং বহু আয়াতে ইহুদি ও খৃস্টানদের ইতিহাস তুলে ধরেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে অতীতের ধর্মগুলো ও বিশেষ করে, ইহুদি ও খৃস্ট ধর্ম আসমানি বা ঐশী ধর্মগুলোর পরিপূর্ণতার প্রক্রিয়ার অংশ। আর পরিপূর্ণতম ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মগুলোর পরিপূর্ণতার প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করেছে।
পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে সব ঐশী ধর্মের নবী-রাসূল ও আসমানি গ্রন্থগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখা প্রকৃত মুমিন বা বিশ্বাসী হওয়ার অন্যতম শর্ত। (সুরা বাকারার ২৮৫ নম্বর আয়াত দ্রষ্টব্য) কোরআন হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত সব মানুষকে একই পথ এবং আদর্শের ধারক-বাহক মনে করে।
পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদীয় বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমুদয়ের উপর। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।”
তাওরাত ও ইঞ্জিল শুধু বনি ইসরাইল বা ইহুদি জাতির উদ্দেশ্যে নাজেল হয়েছিল। অন্যদিকে পবিত্র কোরআনের বাণী গোটা মানব জাতির মুক্তির জন্য নাজেল হয়েছে এবং এতে রয়েছে পরিপূর্ণতম ও চিরন্তন জীবন-বিধান। এ প্রসঙ্গে সুরা তাকভিরের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
এটা তো কেবল বিশ্বাবাসীদের জন্যে উপদেশ, নতুন বিধান প্রণীত হলে যেমন পুরনো বিধান বাতিল হয়ে যায়, তেমনি অতীতের ধর্মগ্রন্থগুলোর বিধান বা শরিয়তও বাতিল হয়ে গেছে। তাই ওইসব গ্রন্থের শিক্ষা আর স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। অতীতের ধর্মগ্রন্থের যে অংশগুলো কোরআনের বিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কেবল সেগুলোই গ্রহণযোগ্য। সুরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, একমাত্র ইসলামই আল্লাহর কাছে মনোনীত ধর্ম।
একই সুরার ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত।”
পাঁচ.
এ পর্বে আমরা অন্য ঐশী ধর্মগ্রন্থগুলোর তুলনায় পবিত্র কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একজন ফরাসি বিশেষজ্ঞের মতামত তুলে ধরব। ডক্টর মরিস বুকাইলি ” বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞানের তুলনা” শীর্ষক বইয়ে পবিত্র কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে গবেষণালব্ধ অনেক মূল্যবান মত ব্যক্ত করেছেন।
অধ্যাপক মরিস বুকাইলি ১৯২০ সালে ফ্রান্সের এক খৃস্টান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশুনার পর তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি ক্লিনিকের প্রধান নির্বাচিত হন। বুকাইলি কয়েক বছর ধরে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলো ও আধুনিক প্রযুক্তির নানা আবিস্কারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন এবং অবশেষে কোরআনের আয়াত নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
বুকাইলি পবিত্র কোরআনের জ্ঞান-সাগরে অবগাহনের জন্য প্রথমে আরবী ভাষা শেখেন। বিভিন্ন বিষয়ে কোরআনের কিছু বাণী তাকে অভিভূত করে। তিনি বলেছেন, “একত্ববাদী তিনটি ধর্ম তথা ইসলাম, ইহুদি ও খৃস্ট ধর্মের রয়েছে নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলো ইহুদি, খৃস্টান ও মুসলমানদের ধর্ম-বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ-ভিত্তিক তথ্য আমাদেরকে নবী-রাসূলদের ওপর নাজেল হওয়া প্রত্যাদেশ বা ওহীগুলো মেনে নিতে বাধ্য করে। অবশ্য খৃস্টানরা এই নীতি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। হযরত ঈসা (আঃ)’র যুগের ছয় শতক পর নাজেল হওয়া ধর্মগ্রন্থ কোরআনে তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য রয়েছে। কোরআন মুসলমানদের পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থগুলোর ওপর বিশ্বাস রাখার এবং আল্লাহর নবীদের উচ্চ মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। কোরআন হযরত নুহ, ইব্রাহিম, মুসা ও ঈসা (আঃ)’র মত মহান নবীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে বলেছে।”
বুকাইলি আরো বলেছেন,« ইঞ্জিল বা বাইবেলের মত কোরআনেও হযরত ঈসা (আঃ)’র জন্মগ্রহণের ঘটনাকে মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত মরিয়ম (সাঃ)’র প্রতি কোরআনের রয়েছে বিশেষ শ্রদ্ধা। এ ধর্মগ্রন্থের ১৯ নম্বর সুরাটির নাম “মরিয়ম”। কিন্তু এ সত্য স্বীকার করতে হবে যে, হযরত ঈসা (আঃ) ও মরিয়ম (সাঃ)’র প্রতি কোরআনের শ্রদ্ধা বা প্রশংসাগুলো পাশ্চাত্যের সাধারণ জনগণের মধ্যে অজানাই রয়ে গেছে।
ডক্টর মরিস বুকাইলি ইসলামের হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে বলেছেন, ” হাদীসে মহান ব্যক্তিদের জীবনী, তাদের চিন্তাধারা ও বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। যারা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র জীবনী উদ্ধৃত করেছেন তারা তাঁরই পাশে ছিলেন এবং খুব কাছ থেকে তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক গুণগুলো লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু বাইবেল বা ইঞ্জিলের চারটি প্রধান সংস্করণ হিসেবে স্বীকৃত কিংবা বহুল প্রচলিত সংস্করণগুলোর সংগ্রহকারী এবং ওই বইগুলোতে উল্লেখিত হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত নানা ঘটনার বর্ণনাকারীরা ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ্যদর্শী নন।”
ডক্টর মরিস বুকাইলি লিখেছেন, ” কোরআন ও বাইবেলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল, বাইবেলের বক্তব্য বা বাণীগুলো সমন্বিত নয়, বরং বিচ্ছিন্ন সূরের। কিন্তু কোরআনের বাণীগুলো সমন্বিত ও একই সূরে গ্রন্থিত। কোরআন হল ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ যা মহান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আঃ)’র মাধ্যমে মুহাম্মদ (সাঃ)’র ওপর নাজেল হয়েছে। এসব ওহী আসার পর পরই ওহী লেখকদের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ এবং মুখস্ত করে ফেলা হত। এ ছাড়াও ওহীর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করা হত নামাজের মধ্যে ও বিশেষ করে রমজান মাসে। মুহাম্মাদ (সাঃ)’র জীবদ্দশাতেই কোরআন বিভিন্ন সুরার আকারে বিন্যস্ত হয়েছিল।”
পবিত্র কোরআন সম্পর্কে বুকাইলি লিখেছেন, ” মুহাম্মাদ (সাঃ)’র মৃত্যুর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কোরানের সুরাগুলো একত্র করে সংকলিত করা হয়। অন্যদিকে বাইবেল মূলতঃ বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্য-ভিত্তিক বর্ণনা এবং এসব বর্ণনায় পরোক্ষভাবে হযরত ঈসা (আঃ)’র বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।”
ডক্টর মরিস বুকাইলি আরো লিখেছেন, ” অতীতে পন্ডিতদের এ মত খুবই দৃঢ় ছিল যে, বিজ্ঞান ও পবিত্র গ্রন্থগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় বা সঙ্গতি রয়েছে। খৃস্টান পাদ্রি সেন্ট অগাস্টিন তার ৮২ নম্বর চিঠিতে স্পষ্টভাবে এই সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে এটা লক্ষ্য করেছেন যে বিজ্ঞান ও পবিত্র গ্রন্থগুলোর মধ্যে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। তাই তিনি পরে সিদ্ধান্ত নেন যে বিজ্ঞান ও পবিত্র গ্রন্থগুলোর মধ্যে আর কখনও তুলনা করবেন না। অথচ কোরআনের শিক্ষাগুলোর সাথে বিজ্ঞানের কোনো বৈপরীত্য বা সংঘাত নেই। ”

মরিস বুকাইলি অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও নির্মোহ মন নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কোরআনের সাজুয্য বা সঙ্গতি নিয়ে গবেষণা শুরু করে এটা দেখতে পান যে, কোরআনের শিক্ষাগুলোর সাথে বিজ্ঞানের সঙ্গতি রয়েছে। একইভাবে অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও নির্মোহ মন নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে তাওরাত বা ওল্ড টেস্টাম্যান্ট ও বাইবেলের মিল-অমিল সম্পর্কেও গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষণার ফল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ” আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে তাওরাত বা ওল্ড টেস্টাম্যান্টের অসঙ্গতি স্পষ্টই ছিল। বাইবেল খোলার পরও খুব দ্রুত এটা বোঝা যায় যে, লুকের বাইবেল ও মথির বাইবেলে হযরত ঈসা (আঃ)’র বংশ-পরিচয় সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের বক্তব্য রয়েছে। লুকের বাইবেলে পৃথিবীতে মানুষের আগমন বা আবির্ভাবের সময়কাল সম্পর্কে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ইব্রাহিমী তিন ধর্ম তথা ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্ট – এ তিন ধর্মেই নুহ (আঃ)’র যুগের প্লাবন হওয়ার কথা বিশ্বাস করে। বুকাইলি এ ব্যাপারে তিন ধর্মের বর্ণনার তুলনা করেছেন এবং এ সংক্রান্ত কোরআনের বর্ণনার শ্রেষ্ঠত্ব কথা তুলে ধরে বলেছেন, “এ ঘটনার ব্যাপারে কোরআনের বর্ণনা পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র। এ বর্ণনার সাথে ইতিহাসের কোনো বিরোধ দেখা যায় না। কিন্তু বাইবেল ও ইঞ্জিলে এ সম্পর্কে ভিন্ন যুগে লেখা দুই ধরনের ভাষ্য পাওয়া যায়। কোরআন এ মহাপ্লাবনকে নুহের জাতির প্রতি আল্লাহর শাস্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। আর কোরআনের এ সংক্রান্ত বক্তব্যের সাথে বিজ্ঞানের নতুন গবেষণা-লব্ধ ফলাফলের কোনো পার্থক্য নেই। ”
আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কোরআনের এই অসাধারণ ও নজিরবিহীন মিলকে সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করেছেন বুকাইলি। তিনি লিখেছেন, “পাশ্চাত্যের ধর্মের জ্ঞান বলতেই ইহুদি ও খৃস্ট ধর্মের জ্ঞানকে বোঝানো হয় এবং এক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি কোনো গুরুত্বই দেয়া হয় না। কোরআন সম্পর্কে পাশ্চাত্যের এসব দৃষ্টিভঙ্গি অজ্ঞতা, অবিচার ও বিদ্বেষের ফল। যেমন, ইউনিভার্সেলিস বিশ্বকোষের ৬ নম্বর খন্ডে লেখক কোরআনকে ব্যক্তিগত জীবনী বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ সবাই জানেন যে ব্যক্তিগত জীবনীর সাথে কোরআনের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এতে রয়েছে সতর্কবাণী ও সুসংবাদ। জ্ঞান সম্পর্কে ইসলামের নীতিও স্পষ্ট।” রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনে যাও” এবং “মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ।”
বুকাইলির মতে কোরআনে বিশ্ব জগত, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাণী ও উদ্ভিদ বিদ্যা, মানুষের জন্ম-রহস্য এবং ভূ-তত্বসহ বহু বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ অনেক আয়াত রয়েছে। অথচ তাওরাত ও বাইবেলে বিজ্ঞান সম্পর্কিত যেসব মারাত্মক ভুল দেখা যায় কোরআনে সেগুলো নেই। বুকাইলি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, সেই ১৪০০ বছর আগে কোনো মানুষের পক্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এতসব বিষয় লেখা কি সম্ভব? অর্থাৎ নিঃসন্দেহে কোরআন অবিকৃত ও খোদায়ী গ্রন্থ।
ছয়.
পবিত্র কোরআন সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, “এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর-যাতে তোমরা আল্লাহর করুণা বা রহমতপ্রাপ্ত হও। ”
আলকোরআন মানুষের সৌভাগ্যের দিশারি পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়সহ সৌভাগ্যময় এবং উন্নত জীবন যাপনের সমস্ত নির্দেশনা রয়েছে এ মহাগ্রন্থে। কোরআন ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থ মানুষের জীবনের সব দিকের নির্দেশনা দেয় না। কোরআনের বাণীর বাহ্যিক কাঠামো যেমন সৌন্দর্য্যে অনন্য তেমনি এর বিষয়বস্তুও গভীরতা ও গুরুত্বের দিক থেকে অনন্য। কোরআন যে মানুষের রচিত গ্রন্থ নয়, এটাই তার বড় প্রমাণ এবং এ মহাগ্রন্থের চিরন্তন অলৌকিকতার স্বাক্ষর।
মোজেজা বা অলৌকিকতা হল সাধারণ ঘটনা বা প্রচলিত নিয়মের বহির্ভূত কিছু ঘটনা। মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ মোজেজা দেখাতে পারে না। নবী-রাসূলদের দেখানো যেসব মোজেজার সত্যতার প্রতি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, তারা বুঝতেন যে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এ ধরনের অতি-প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটানো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার বহু মানুষ নবী-রাসূলদের মোজেজাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেনি।
নবী-রাসূলদের মোজেজা ছিল সমসাময়িক যুগের অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা মহান আল্লাহরই কৌশলগত বিধান। যাদুবিদ্যা বা সম্মোহন ও ছলনাপূর্ণ নানা কৌশলের মাধ্যমে দৃশ্যতঃ যেসব অস্বাভাবিক বিষয় দেখানো হয়, মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা সেরকম কৃত্রিম কোনো বিষয় নয়। মোজেজা প্রচলিত জ্ঞান ও ছলা-কলার এত উর্দ্ধে যে তার স্বরূপ মানুষের সিমীত জ্ঞান দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। আর এ জন্যই মোজেজা ও যাদুর মত কৃত্রিম বিষয়ের পার্থক্য খুব সহজেই জ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন, ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত সুদক্ষ যাদুকররা হযরত মূসা (আঃ)’র মোজেজা দেখেই বুঝতে পেরেছিল যে তা যাদু নয়, বরং মানুষের সাধ্যাতীত কোনো ঘটনা। তাই ওই যাদুকররা ফেরাউনের হত্যার হুমকি অগ্রাহ্য করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং সিজদাবনত হয়। হযরত মূসা (আঃ)’র যুগে যাদু বিদ্যার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল বলে আল্লাহ তাঁকে ঐসব অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন।
হযরত ঈসা (আঃ)’র যুগে চিকিৎসা বিদ্যায় ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল। সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের চিকিৎসকরা কোনো কোনো দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করতেন। তাই এ যুগে মহাপ্রজ্ঞা ও কৌশলের অধিকারী মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে এমন ক্ষমতা দিয়েছিলেন যে তিনি তার বলে জন্মান্ধকে দৃষ্টি শক্তি দান করতে এবং দূরারোগ্য রোগ সারাতে ও এমনকি মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন ।
জাহেলি যুগে আরবরা পদ্য-সাহিত্য, বাগ্মীতা ও অলংকার শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। তাই মহান আল্লাহ মানুষের জন্য তাঁর নেয়ামত পরিপূর্ণ করার লক্ষ্যে শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র কাছে নাজেল করেন মহাগ্রন্থ কোরআন, যা বাগ্মীতা, ভাষা-শৈলী, সাহিত্য-মান ও আলংকারিক সৌন্দর্য্যে অনন্য। আরবরা কোরানের ছন্দময় ভাষার অলৌকিক সৌন্দর্য্য ও সুললিত ধ্বনি- মাধুর্যের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।
ইবনে হিশাম এক ঐতিহাসিক ঘটনায় লিখেছেন, “এক রাতে আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল ও আখনাস পরস্পরকে না জানিয়ে রাসূল (সাঃ)’র ঘরের কাছে এসে কোরআনের মধুর তেলাওয়াত শুনছিল। ফেরার পথে তারা একে অপরকে দেখে ফেলে এবং কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য সবাই নিজেকে তিরস্কার করে। তারা আর রাসূল (সাঃ)’র ঘরের কাছে আসবে না বলেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু কোরআনের বিস্ময়কর আয়াত ও অলৌকিক আকর্ষণে পরের রাতে তারা আবারও পৃথকভাবে রাসূল (সাঃ)’র ঘরের কাছে এসে গোপনে কোরআনের আয়াতের মধুর আবৃত্তি শোনে। ফেরার পথে আবারও পরস্পরের সাথে সাক্ষাত ও লজ্জিত হওয়ার পালা। তৃতীয় রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ওই তিন কাফের নেতা আবারও পরস্পর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, কোরআনের আয়াতের আবৃত্তি শোনার জন্য তারা নবী(সাঃ)’র ঘরের পাশে জড় হবে না। ”
মিশরিয় চিন্তাবিদ ডক্টর তাহা ইয়াসিন বলেছেন,” কোরআনের অলৌকিকতা এমন এক বিষয় যে মন সেদিকেই যায় এবং তাকে মেনে নেয়। আর কলম ও ভাষা এর বর্ণনা দিতে অক্ষম।”
পবিত্র কোরআন ছাড়াও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)’র আরো অনেক মোজেজা ছিল। যেমন, চাঁদ দ্বিখন্ডিত করা এবং তাঁর নির্দেশে পাথর-কনার আল্লাহর প্রশংসা ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ)’র সবচেয়ে বড় ও চিরস্থায়ী মোজেজা হল পবিত্র কোরআন। তাঁর অন্য মোজেজাগুলো ছিল বিশেষ উপলক্ষ-ভিত্তিক ও অস্থায়ী। ভবিষ্যতের মানুষ ওইসব অস্থায়ী মোজেজা নিজ চোখে দেখতে সক্ষম নয়। আর সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি ও উক্তির মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায় বা সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাই যারা কাছ থেকে মোজেজা দেখেনি তাদের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে যেতেই পারে। তাই আল্লাহ শেষ নবী (সাঃ)’র জন্য ব্যবস্থা করেছেন চিরন্তন বা শাশ্বত মোজেজার।
পবিত্র কোরআন অতীতেও যেমন ছিল রাসূল(সাঃ)’র নবুওতের প্রমাণ, তেমনি তা বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে সুস্পষ্টতম প্রমাণ হিসেবে টিকে থাকবে। যতই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকশিত হবে ততই পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতা বেশি স্পষ্ট হবে।
মুসলমান বিশেষজ্ঞ বা আলেমরা পবিত্র কোরআনের অলৌকিকত্বের অনেক দিকের কথা বলেছেন। জালালউদ্দিন সিয়ুতির মতে, মোজেজা দুই ধরনের। ইন্দ্রিয়গাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক। অতীতের নবী-রাসূলদের মোজেজা ছিল ইন্দ্রিয়গাহ্য। যেহেতু বিশ্বনবী (সাঃ)কে গোটা মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাই তাঁর মোজেজা হল চিরস্থায়ী ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আর এ মোজেজাই হল পবিত্র কোরআন।
ইমাম ফখরে রাজির মতে, ” ভাষার বিশুদ্ধ রীতি, কাঠামো ও সব ধরনের ত্রুটিহীনতা কোরআনের অলৌকিকতা।” ইবনে আতিয়ার মতে, ” সুশৃঙ্ক্ষল শব্দ ও অর্থের বাস্তবতা কোরআনের অলৌকিকতা”।
কোরআন মানুষের পরিপূর্ণতা ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করে। বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ” কোরআন জ্যামিতি বা গণিতের বই নয়, বরং এটা এমন কিছু বিধি-বিধানের সংকলন যা মানুষকে সঠিক পথ দেখায়, যে পথ নির্ধারণ ও বর্ণনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দার্শনিকের পক্ষেও অসম্ভব। ” এই আসমানি মহাগ্রন্থ খুব কম সময়ের মধ্যে রক্তপিপাসু, বল্গাহারা, অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবদেরকে মূর্তি পূজা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কুসংস্কার এবং নৈতিক অনাচারগুলোর নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছিল।
কোরআনের শিক্ষায় উজ্জীবিত আরব মুসলমানরা পৃথিবীকে অতি উন্নত সভ্যতা উপহার দিয়েছিল। এ সভ্যতা শত শত বছর ধরে বিশ্বে উন্নত সংস্কৃতি ও উন্নত নৈতিক গুণাবলীর আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের বীরত্ব, মহানুভবতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল কোরআনের শিক্ষারই প্রভাব। এভাবে কোরআনই জ্ঞান ও একত্ববাদ-ভিত্তিক ইসলামের সোনালী সভ্যতার ভিত্তি রচনা করেছে।
কোরআন তার অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নিরক্ষরতার কথা উল্লেখ করেছে। মহানবী (সাঃ) নিজেও তা বার বার বলেছেন। অথচ তিনি মানব জাতির জন্য যে মহাগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন তা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, উচ্চতর শিক্ষা ও নৈতিক দিক-নির্দেশনার মত নানা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদে এতটা ভরপুর যে, পন্ডিত ও চিন্তাবিদরা বিস্ময়ে অভিভুত হন।
সাত.
মহানবী (সাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর , ইয়াতিম, দরিদ্র। অথচ পবিত্র কোরআন নাজেল হয়েছিল তাঁর কাছে। কোরআনও তার অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নিরক্ষরতার কথা উল্লেখ করেছে। মহানবী (সাঃ) নিজেও তা বার বার বলেছেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোরআনের আয়াতগুলোকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ও ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াই হুবহু মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন।
বিশ্বনবী (সাঃ) কোনো মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি হচ্ছেন এমন এক ফুল যাকে শিক্ষা ও পরিপূর্ণতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বয়ং বিশ্ব জগতের মালিক। রাসূল (সাঃ) কাগজ, কলম ও কালির সাথে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু কোরআনে কলম ও লেখনির শপথ দেখা যায়। তাঁর ওপর মহান আল্লাহর প্রথম যে বাক্যটি ওহি বা প্রত্যাদেশ হিসেবে নাজেল হয়েছিল তা হল, পড়। তিনি মানুষের জন্য জ্ঞানকে সবচেয়ে বড় সম্পদ বা নেয়ামত বলে মনে করতেন। মদিনায় ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি সবাইকে জ্ঞান অর্জনের জোর আহ্বান জানান।
কোন মানব-শিক্ষক মহানবী (সাঃ)কে কিছু শেখায়নি এবং তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সাঃ) মানব জাতির শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি হয়েছেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকেন্দ্রের উৎস।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র পবিত্র আহতে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আঃ) অন্য ঐশী ধর্মের আলেমদের সাথে এক বিতর্কে বলেছিলেন, মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নবী হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হল, তিনি ছিলেন ইয়াতিম, নিঃস্ব ও রাখাল। তিনি কোনো বই পড়েননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছে যাননি । অথচ তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবীদের ইতিহাস এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক তথ্য। ”
একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ দিয়ে উচ্চারিত কোরআনে সৃষ্টির উৎস, পরকাল, মানুষ, নৈতিকতা, বিধি-বিধান ও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অসাধারণ সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার বর্ণনা রয়েছে। সুরা জুমআর দ্বিতীয় আয়াতে এসেছে, “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ,তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।”
সুরা ইউনুসের ১৬ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে : “বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন না এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না?”
বাস্তবতা সম্পর্কে অনবহিত কেউ কেউ বিশ্বনবী (সাঃ)’র নিরক্ষরতার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসূল (সাঃ) যদি নিরক্ষর না হতেন তাহলে জ্ঞান শেখার জন্য অন্যদের কাছে যেতেন । এভাবে তাঁর চিন্তাধারার ওপর সমসাময়িক যুগের চিন্তাবিদদের প্রভাব পড়ত। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ) মানুষের কাছে যেসব চিন্তাধারা ও আদর্শ তুলে ধরেছেন সেসবের সাথে সেই জাহেলি যুগের মানুষের চিন্তাধারার কোনো মিল ছিল না, বরং সেসবই ছিল জাহেলি যুগের প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা বা রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
মহানবী (সাঃ)’র যুগের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল মূর্তি পূজারী ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। কেউ কেউ তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে জ্ঞান এবং বিধি-বিধান খুঁজত। বিশ্বনবী (সাঃ) যদি সমসাময়িক জ্ঞানীদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতেন তাহলে প্রচলিত চিন্তাধারায় প্রভাবিত হতেন। ফলে বিকৃত হয়ে যাওয়া তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং পবিত্র কোরআনের মধ্যে মোটামুটি মিল দেখা যেত। কিন্তু পবিত্র কোরআন অন্য ধর্মগুলোর কুসংস্কার ও হেঁয়ালী বা কাল্পনিক চিন্তাধারার কঠোর বিরোধিতা করেছে।
কোরআনের বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য, বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্য ও ঐশী বাস্তবতাগুলো এ মহান গ্রন্থকে তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেছে।
মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ নবীকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছেন বলেই মহানবী (সাঃ) সব ধরণের মানব-রচিত মতাদর্শ বা তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি বাবা মায়ের সাহচর্য ও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। শৈশব থেকেই জাহেলি যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির ছোঁয়া বা স্পর্শ ছাড়াই অনেক দূরে মরুর বুকে বড় হয়েছেন বিশ্বনবী (সাঃ)। ফলে ওহি বা ঐশী প্রত্যাদেশ ধারণের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর মধ্যে।
আর এ অবস্থায় একদিন হেরা পর্বতের গুহায় বিশ্বনবী (সাঃ)’র কাজে নাজেল হয় ঐশী প্রত্যাদেশ এবং তাঁর পবিত্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে সত্যের বাণী। এটা ছিল এক অলৌকিক বিপ্লব। তাঁর কাছে মহান আল্লাহর বাণী বা কোরআন ২৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছে ।
বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেছেন, “বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু এই নিরক্ষরতা তাঁর জন্য পরিপূর্ণতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা ওহির মাধ্যমে। অথচ আমাদের জন্য নিরক্ষর হওয়া এক ধরণের ত্রুটি। কারণ, আমাদের নিরক্ষরতা অজ্ঞতার সমতুল্য।”
প্রাচ্যবিদসহ গবেষকরা বিশ্বনবী (সাঃ)’র জীবনে পড়া-লেখার ক্ষুদ্রতম অভিজ্ঞতার আভাসও খুঁজে পাননি। তারা সবাইই স্বীকার করেছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিরক্ষর ছিলেন এবং সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জাতির সদস্য হয়েও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে সৃষ্টি জগতের, গ্রহ-নক্ষত্রের এবং আকাশ ও ভূ-মন্ডলের অনেক অজানা তথ্য ও নানা রহস্যের ভান্ডার।
ফরাসি প্রাচ্যবিদ “কুসিন ডি পার্সিভাল” বলেছেন, ” মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিগুলো হতচকিত হয়ে যায় এটা ভেবে যে কিভাবে একজন নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে এত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানপূর্ণ স্পষ্ট বাক্য। ”
” সভ্যতার ইতিহাস” শীর্ষক বইয়ে উইল ডুরান্ট লিখেছেন, “সে যুগে আরবদের মধ্যে লেখা পড়ার কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাই গোটা কোরাইশ গোত্রের মধ্যে লিখতে ও পড়তে সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। নবী হওয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) বিশেষ বইয়ের অধিকারী হন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও আরবী ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত ও বাগ্মীতাপূর্ণ বই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল এবং তিনি যে কোনো জটিল বা সূক্ষ্ম বিষয়েও সমস্ত শিক্ষিত লোকদের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখতেন। ” রোমানিয়ার গবেষক কনস্টান ভার্জিল গিউরগিভ ” পয়গাম্বর মুহাম্মদ(সঃ)-কে আবারও নতুন করে জানতে হবে” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, “নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মুহাম্মদ(সঃ)’র ওপর প্রথম যে আয়াত নাজেল হয়েছিল তাতে কলম ও জ্ঞানের কথা রয়েছে। অর্থাৎ লেখা, জ্ঞান শেখা ও অন্যকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন কোনো ধর্ম পাওয়া যায় না যে ধর্মের সূচনাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদ(সঃ) যদি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হতেন তাহলে হেরা গুহায় তাঁর কাছে এই আয়াত নাজেল হওয়ার কারণে কেউই বিস্মিত হত না। কারণ, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং কোনো শিক্ষকের কাছেই তিনি পড়াশুনা করেননি। ইসলাম ধর্মে জ্ঞান অর্জনকে এত ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ার কারণে আমি মুসলমানদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
সাত.
মহানবী (সাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর , ইয়াতিম ও দরিদ্র। অথচ পবিত্র কোরআন নাজেল হয়েছিল তাঁর কাছে। কোরআনও তার অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নিরক্ষরতার কথা উল্লেখ করেছে। মহানবী (সাঃ) নিজেও তা বার বার বলেছেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোরআনের আয়াতগুলোকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ও ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াই হুবহু মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন।
বিশ্বনবী (সাঃ) কোনো মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি হচ্ছেন এমন এক ফুল যাকে শিক্ষা ও পরিপূর্ণতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বয়ং বিশ্ব জগতের মালিক। রাসূল (সাঃ) কাগজ, কলম ও কালির সাথে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু কোরআনে কলম ও লেখনির শপথ দেখা যায়। তাঁর ওপর মহান আল্লাহর প্রথম যে বাক্যটি ওহি বা প্রত্যাদেশ হিসেবে নাজেল হয়েছিল তা হল, পড়। তিনি মানুষের জন্য জ্ঞানকে সবচেয়ে বড় সম্পদ বা নেয়ামত বলে মনে করতেন। মদিনায় ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি সবাইকে জ্ঞান অর্জনের জোর আহ্বান জানান।
কোন মানব-শিক্ষক মহানবী (সাঃ)কে কিছু শেখায়নি এবং তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সাঃ) মানব জাতির শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি হয়েছেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকেন্দ্রের উৎস।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র পবিত্র আহতে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আঃ) অন্য ঐশী ধর্মের আলেমদের সাথে এক বিতর্কে বলেছিলেন, “মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নবী হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হল, তিনি ছিলেন ইয়াতিম, নিঃস্ব ও রাখাল। তিনি কোনো বই পড়েননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছে যাননি । অথচ তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবীদের ইতিহাস এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক তথ্য।”
একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ দিয়ে উচ্চারিত কোরআনে সৃষ্টির উৎস, পরকাল, মানুষ, নৈতিকতা, বিধি-বিধান ও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অসাধারণ সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার বর্ণনা রয়েছে। সূরা জুমআর দ্বিতীয় আয়াতে এসেছে, “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ,তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।”
সূরা ইউনুসের ১৬ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে : “বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন না এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না?”
বাস্তবতা সম্পর্কে অনবহিত কেউ কেউ বিশ্বনবী (সাঃ)’র নিরক্ষরতার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসূল (সাঃ) যদি নিরক্ষর না হতেন তাহলে জ্ঞান শেখার জন্য অন্যদের কাছে যেতেন । এভাবে তাঁর চিন্তাধারার ওপর সমসাময়িক যুগের চিন্তাবিদদের প্রভাব পড়ত। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ) মানুষের কাছে যেসব চিন্তাধারা ও আদর্শ তুলে ধরেছেন সেসবের সাথে সেই জাহেলি যুগের মানুষের চিন্তাধারার কোনো মিল ছিল না, বরং সেসবই ছিল জাহেলি যুগের প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা বা রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
মহানবী (সাঃ)’র যুগের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল মূর্তি পূজারী ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। কেউ কেউ তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে জ্ঞান এবং বিধি-বিধান খুঁজত। বিশ্বনবী (সাঃ) যদি সমসাময়িক জ্ঞানীদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতেন তাহলে প্রচলিত চিন্তাধারায় প্রভাবিত হতেন। ফলে বিকৃত হয়ে যাওয়া তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং পবিত্র কোরআনের মধ্যে মোটামুটি মিল দেখা যেত। কিন্তু পবিত্র কোরআন অন্য ধর্মগুলোর কুসংস্কার ও হেঁয়ালী বা কাল্পনিক চিন্তাধারার কঠোর বিরোধিতা করেছে।
কোরআনের বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য, বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্য ও ঐশী বাস্তবতাগুলো এ মহান গ্রন্থকে তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেছে।
মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ নবীকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছেন বলেই মহানবী (সাঃ) সব ধরনের মানব-রচিত মতাদর্শ বা তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি বাবা মায়ের সাহচর্য ও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। শৈশব থেকেই জাহেলি যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির ছোঁয়া বা স্পর্শ ছাড়াই অনেক দূরে মরুর বুকে বড় হয়েছেন বিশ্বনবী (সাঃ)। ফলে ওহি বা ঐশী প্রত্যাদেশ ধারণের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর মধ্যে।
আর এ অবস্থায় একদিন হেরা পর্বতের গুহায় বিশ্বনবী (সাঃ)’র কাজে নাজেল হয় ঐশী প্রত্যাদেশ এবং তাঁর পবিত্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে সত্যের বাণী। এটা ছিল এক অলৌকিক বিপ্লব। তাঁর কাছে মহান আল্লাহর বাণী বা কোরআন ২৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছে ।
বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেছেন, “বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু এই নিরক্ষরতা তাঁর জন্য পরিপূর্ণতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা ওহির মাধ্যমে। অথচ আমাদের জন্য নিরক্ষর হওয়া এক ধরনের ত্রুটি। কারণ, আমাদের নিরক্ষরতা অজ্ঞতার সমতুল্য।”
প্রাচ্যবিদসহ গবেষকরা বিশ্বনবী (সাঃ)’র জীবনে পড়া-লেখার ক্ষুদ্রতম অভিজ্ঞতার আভাসও খুঁজে পাননি। তারা সবাইই স্বীকার করেছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিরক্ষর ছিলেন এবং সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জাতির সদস্য হয়েও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে সৃষ্টি জগতের, গ্রহ-নক্ষত্রের এবং আকাশ ও ভূ-মন্ডলের অনেক অজানা তথ্য ও নানা রহস্যের ভাণ্ডার।
ফরাসি প্রাচ্যবিদ “কুসিন ডি পার্সিভাল” বলেছেন, ” মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিগুলো হতচকিত হয়ে যায় এটা ভেবে যে কিভাবে একজন নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে এত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানপূর্ণ স্পষ্ট বাক্য। ”
” সভ্যতার ইতিহাস” শীর্ষক বইয়ে উইল ডুরান্ট লিখেছেন, “সে যুগে আরবদের মধ্যে লেখা পড়ার কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাই গোটা কোরাইশ গোত্রের মধ্যে লিখতে ও পড়তে সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। নবী হওয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) বিশেষ বইয়ের অধিকারী হন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও আরবী ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত ও বাগ্মীতাপূর্ণ বই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল এবং তিনি যে কোনো জটিল বা সূক্ষ্ম বিষয়েও সমস্ত শিক্ষিত লোকদের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখতেন। ”
রোমানিয়ার গবেষক কনস্টান ভার্জিল গিউরগিভ “পয়গাম্বর মুহাম্মদ(সঃ)-কে আবারও নতুন করে জানতে হবে” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, “নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মুহাম্মদ(সঃ)’র ওপর প্রথম যে আয়াত নাজেল হয়েছিল তাতে কলম ও জ্ঞানের কথা রয়েছে। অর্থাৎ লেখা, জ্ঞান শেখা ও অন্যকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন কোনো ধর্ম পাওয়া যায় না যে ধর্মের সূচনাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদ(সঃ) যদি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হতেন তাহলে হেরা গুহায় তাঁর কাছে এই আয়াত নাজেল হওয়ার কারণে কেউই বিস্মিত হত না। কারণ, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং কোনো শিক্ষকের কাছেই তিনি পড়াশুনা করেননি। ইসলাম ধর্মে জ্ঞান অর্জনকে এত ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ার কারণে আমি মুসলমানদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
আট.
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও মানবতাকে বিকশিত করতে কোরআন নাজেল হয়েছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র পবিত্র অন্তরে। ইসলাম প কোরআনেরই উপহার। মানুষের চিরন্তন মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিক-নির্দেশক মহাগ্রন্থ কোরআন সবচেয়ে মূল্যবান এবং দীর্ঘস্থায়ী আধ্যাত্মিক গ্রন্থ। ঐতিহাসিকরা একবাক্যে তা স্বীকার করে গেছেন। কোরআনের অন্যতম অলৌকিক দিক হল এর বক্তব্যগুলোর মধ্যে সঙ্গতি, সমন্বয়, ছন্দময়তা ও অলংকারসমৃদ্ধতা।
নতুন বিশ্বাস ও জ্ঞান বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ধারণাকে বদলে দেয়ার পাশাপাশি অতীতের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দেখা দেয়। বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা, লেখনি, ভাষণ ও বক্তব্য প্রায়ই বদলে যায় এবং অনেক সময় অতীতের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। তাই মানুষের কোনো রচনাই ত্রুটিমুক্ত নয়।
পবিত্র কোরআন বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনো বই নয়। অথচ দর্শন ও বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সত্য ও বাস্তব তথ্য রয়েছে এ মহাগ্রন্থে। মানুষের চিরন্তন মুক্তি ও সৌভাগ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ দিক-নির্দেশক হিসেবে কোরআন মানুষের জীবনের অনেক সূক্ষ্ম দিক ও বড় দিকের স্পষ্ট নীতিমালা তুলে ধরেছে। অথচ পরস্পর বিরোধী দুটি বাক্য বা সাংঘর্ষিক কোনো কথা এতে নেই। বিশ্বনবী (সাঃ)’র জীবনের নানা ঘটনা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ২৩ বছরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছে এ মহাগ্রন্থ। কখনও একটি প্রশ্নের জবাব কিংবা কখনও খোদায়ি কোনো বিধান ব্যাখ্যা করার জন্য, কখনওবা বিশেষ কোনো সমস্যার সমাধান অথবা কোনো সন্দেহ দূর করার জন্য বিশেষ সূরা বা আয়াত নাজেল হত। দীর্ঘ ২৩ বছরে ক্রমান্বয়ে ও বিচ্ছিন্নভাবে নাজেল হওয়া সত্ত্বেও পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলোর মধ্যে নেই সমন্বয়হীনতা বা সঙ্গতিহীনতা ও ছন্দ-পতন।
পবিত্র কোরআনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়েও দিক-নির্দেশনা রয়েছে। পরিবার, নারীর অধিকার, হিজাব বা পর্দা এবং চারিত্রিত পবিত্রতা সম্পর্ক বিধান দিয়েছে এ মহাগ্রন্থ। ঈমানদারদের পারস্পরিক আচরণ এবং নিজ সমাজের বাইরের অন্যদের সাথে আচরণ সম্পর্কেও পথের দিশা দেয় সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ আলকোরআন। এ মহাগ্রন্থ কখনও মানুষের সৌভাগ্যের ক্ষেত্রে নবী-রাসুলদের ভূমিকার কথা বলে, আবার কখনও শির্ক বা অংশীবাদিতার প্রভাব সম্পর্কে কথা বলে। বিশ্ব জগত, আকাশ ও তারকারাজি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা কোরআনে বিশেষভাবে গুরুত্ব বা ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে। বৃষ্টি, বাতাস, মেঘ, সাগর, পশু-পাখি, উদ্ভিত, লতা-পাতা – এসবই মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি ও আল্লাহর নেয়ামত। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তি এবং যুদ্ধ ও সন্ধির নানা শর্ত সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে। কখনও বা কয়েকটি সূরার মধ্যে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এসেছে। কোনো কোনো ঘটনার বর্ণনার পুনরাবৃত্তি থাকলেও সেসবের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি বা বৈপরীত্য নেই। যেমন, হযরত মূসা (আঃ)’র ঘটনা কোরআনের বেশ কয়েকটি সূরায় এসেছে। ঘটনা এক হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক সূরায় রয়েছে স্বতন্ত্র বার্তা ও আলাদা গুণ।
কোরআন সব সময়ই প্রজ্ঞা ও চিন্তা-ভাবনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। চিন্তা-ভাবনা না করার পরিণতি সম্পর্কে বার বার সতর্ক করেছে কোরআনে।
কোরআনের নানা বৈশিষ্ট্য থেকে এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট, এ গ্রন্থ কোনো মানুষের রচনা নয়। কারণ, মানুষের রচনার মত এতে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য, অসঙ্গতি, সমন্বয়হীনতা ও কোনো মানবীয় ভুল-ত্রুটি নেই। কোরআনের এ অলৌকিকতা ও অনন্য বৈশিষ্ট্য যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে। সূরা নিসার ৮২ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কর না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে নাজেল হত তাহলে অনেক মতপ্রার্থক্য দেখতে পেতে।”
কোরআনের অলৌকিকত্বের আরেকটি বড় দিক হল, এর বাক্য ও শব্দগুলোর শ্রুতিমধুর ছন্দময়তা এবং আলংকারিক সৌন্দর্য। আরব সাহিত্য-বিশারদ ও ভাষাবিদরা যুগে যুগে এটা স্বীকার করেছেন যে কোরআনের সাহিত্য মান, ছন্দশৈলী ও ভাষার সৌন্দর্য এবং মাধুর্য কোনো মানুষের কাজ নয়, বরং তা মানুষের সাধ্যাতীত। আবু জাহেল যখন সে যুগের শ্রেষ্ঠ আরব ভাষাবিদ ও বাগ্মী ওয়ালিদ বিন মুগিরা’র কাছে কোরআন সম্পর্কে তার মত জানতে চেয়েছিল তখন সে বলেছিল, “কোরআন সম্পর্কে আমি আর কী বলব? আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমাদের মধ্যে কেউ আরবী কবিতা ও কাসিদায় আমার মত জ্ঞান রাখ না। অলংকার শাস্ত্র, ছন্দ-বিদ্যা ও কবিতার ভাষা শৈলী বা কবিতার নানা শিল্প সম্পর্কে তোমরা কেউ আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহর শপথ করে বলছি, মুহাম্মদ যা বলছে, তার কোনো তুলনা নেই। কোরআনে ভাষা এমন সুমিষ্ট যে তা অন্য যে কোনো বাগ্মীতাপূর্ণ বক্তব্যের মিষ্টতাকে তুচ্ছ করে দেয়। কোরআনের বক্তব্য নতুন, দৃঢ়-ভিত্তিপূর্ণ, ব্যাপক ফলদায়ক ও নজিরবিহীন এবং তা সব বক্তব্যের চেয়ে উন্নত। কোরআনের চেয়ে উন্নত বক্তব্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।” (তাফসিরে তাবারি )
পবিত্র কোরআনের শব্দ ও বাক্যের ছন্দময়তা এবং হৃদয় কেড়ে নেয়া ধ্বনি-মাধুর্য বা শ্রুতিমধুরতা মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত বা উদ্দীপ্ত করে। বৃটিশ চিন্তাবিদ কারবুলড (গ্যারিবাল্ড?) যখন প্রথম বার পবিত্র কোরআনের আবৃত্তি শোনেন তখন তার মধ্যে যে আবেগ বা প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “রাতের প্রথম প্রহরে জেগে থাকা অবস্থায় হৃদয় নাড়া দেয়া মধুর ধ্বনি শুনলাম। এ ধ্বনি ছিল ইসলামের আহ্বান এবং সত্যে পরিপূর্ণ কোরআনের মধুর আয়াত। এ ধ্বনি আমাকে বাস্তবতার গভীরে নিয়ে গেল। চোখ দুটি বন্ধ করে নিজেকে মহান স্রষ্টার প্রাণ-সঞ্চারক ধ্বনির কাছে সমর্পণ করলাম- মনে মনে বললাম, এ ধ্বনি যেখানে খুশি নিয়ে যাক আমাকে।”
মহান আল্লাহ সূরা বনি ইসরাইলের ১০৬, থেকে ১০৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “তোমরা কোরআনকে মান্য কর অথবা অমান্য কর; যারা অতীতে জ্ঞান পেয়েছে, তাদের কাছে এর তেলাওয়াত করা হলে তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলেঃ আমাদের পালনকর্তা পবিত্র, মহান। নিঃসন্দেহে আমাদের পালকর্তার ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা ক্রন্দন করতে করতে নতমস্তকে ভুমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি পায়।” পবিত্র কোরআনের বাক্য, শব্দ ও অর্থের সঙ্গতি এবং সমন্বয় ব্রিটিশ চিন্তাবিদ কারবুলডকে অভিভুত করেছে। তিনি বলেছেন, “মহান আল্লাহর রহমত, সুসংবাদ ও দয়া সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতের ভাষা ও শব্দগুলো এমনই যে তা পাঠকের মধ্যে এসব বিষয়ের অকৃত্রিম ভাবই তুলে ধরে, ফলে পাঠকরা আত্মহারা হয়ে পড়েন। অন্যদিকে মানুষের বিচ্যুতি ও ভুলের পরিণতি সম্পর্কে এ মহাগ্রন্থের সতর্কবাণীতে ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষা বেশ কঠিন এবং জোরালো। এভাবে কোরআনের বাহ্যিক কাঠামো ও অর্থের সমন্বয় এ মহাগ্রন্থকে করেছে অনন্য। এ ছাড়াও কোরআনের সুন্দর, মানানসই বাক্য ও শব্দ, অকাট্য যুক্তি, উপমার অভিনবত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্বের আরো হাজার হাজার দিক ঐশী এ গ্রন্থকে দান করেছে বাগ্মীতা ও সাহিত্যের শীর্ষ স্থান।”
নয়.
পবিত্র কোরআন চিরন্তন অলৌকিকতার এবং ইসলাম ধর্মের সত্যতার নিদর্শন। মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সব যুগের জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা কোরআনের বিচিত্রময় তথ্য সম্ভার, ভবিষ্যদ্বাণী এবং এর বাগ্মীতা, ভাষাশৈলী বা সাহিত্যমানকে অলৌকিক বলে উল্লেখ করেছেন। আরবী শব্দ ও বাক্য প্রকরণ, ছন্দ প্রকরণ ও অর্থবিদ্যাসহ আরবী ব্যকরণের নানা দিক ব্যাপক মাত্রায় এ মহাগ্রন্থের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে। কোরআনের ভাষা-শিল্প নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে। তবে মানুষের জন্য কোরআনের সবচেয়ে বড় উপহার হল, মানুষের পথের দিশা ও তার চিন্তাগত পরিপক্কতার জন্য সহায়ক বাস্তবতাগুলোকে সবচেয়ে সুন্দর ভাষায় তুলে ধরেছে এ মহাগ্রন্থ। মহান আল্লাহ নিজেই কোরআনের সূরা জুমারের ২৩ নম্বর আয়াতে কোরআনের বক্তব্যকে “আহসানুল হাদীস”বা “সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম বাণী” বলে উল্লেখ করেছেন। ওই আয়াতের পুরো বাক্যটি এ রকম: “আল্লাহ সর্বোত্তম ( ও সবচেয়ে সুন্দর ) বাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন, যা (সূক্ষ্মতা, কোমলতা, সৌন্দর্য ও বিষয়বস্তুর মত বিভিন্ন দিকে) সামঞ্জস্যপূর্ণ, বার বার উচ্চারিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়।” মহান আল্লাহ সূরা ইসরা’র ১০৭ ও ১০৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “যারা এর পূর্ব থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছে, যখন তাদের কাছে এর তেলাওয়াত করা হয়,তখন তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।… তারা কাঁদতে কাঁদতে নতমস্তকে ভুমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি পায়।” পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৮৩ নম্বর আয়াতে একদল খৃস্টান সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে।”
কোরআনের ভাষা খুবই প্রাঞ্জল, সাবলিল, মানানসই, কার্যকর, অলঙ্কারপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক। একইসঙ্গে পরিপূর্ণ ও স্পষ্ট ভাব প্রকাশেও এর জুড়ি নেই। ইসলামের আবির্ভাবের সমসাময়িক যুগে আরবরা ছিল বাগ্মীতা ও অলঙ্কারপূর্ণ বক্তব্যের অনুরাগী। তাই কোরআনের ভাষা তাদের কাছে ছিল অন্তহীন আকর্ষণ ও মহাবিস্ময়ের উৎস। গদ্য ও পদ্যের মাঝামাঝি বাকরীতি অথচ এ দুয়েরই নানা দূর্বলতা থেকে মুক্ত কোরআন যে ঐশী গ্রন্থ সে বিষয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। জাহেলি যুগের আরবরা উন্নত ভাষাশৈলী ও সাহিত্যের সূক্ষ্ম দিক সম্পর্কে দক্ষ হলেও তারা বিজ্ঞান, নৈতিক জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। কোরআন নৈতিক ও চিন্তাগত বিষয়ে অকাট্য যুক্তি ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা তুলে ধরে অজ্ঞতার যুগের অসার চিন্তাধারাগুলোকে চুরমার করে দিয়েছে। এ অবস্থায় কোরআনের ধারা অনুসরণ করে চিত্তাকর্ষক বক্তব্য রচনা করা সমসাময়িক যুগের আরব পন্ডিতদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু হিজরী তৃতীয় শতকে আরবী ” বালাগাত” বা অলংকার শাস্ত্র গড়ে ওঠায় জাহেজ, তাবারসি ও ফাখরে রাজির মত একদল মুসলিম মনিষী পবিত্র কোরআনের বাগ্মীতা ও প্রাঞ্জলতার মানদন্ডকে অন্য বাকরীতির ধারা থেকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। এভাবে কোরআনের সাহিত্য-মানের অলৌকিকত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সবার কাছে স্পষ্ট হয়।
ভাষাশৈলী, প্রাঞ্জলতা ও অর্থের গভীরতার দিক থেকে পবিত্র কোরআনের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইবনে আতিয়া বলেছেন, ” যখনই কোরআনের কোনো শব্দের পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করতে চেয়েছি এবং এ জন্য আরবী ভাষার পুরো শব্দ জগতে উপযুক্ত কোন শব্দের সন্ধান করেছি তখনই কোরআনের ওই শব্দের চেয়ে ভাল বা মানানসই কোনো শব্দ কখনও খুঁজে পাইনি।” পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদরাও পবিত্র কোরআনের এই বৈশিষ্ট্যের কথা স্বীকার করেছেন। বৃটিশ চিন্তাবিদ টমাস কার্লাইল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ” কোরআন যে ঐশী গ্রন্থ তা মনে না রেখেও বলা যায়, কোরআনের শব্দ চয়ন ও শব্দ বিন্যাস পরিপক্কতা বা পরিপূর্ণতার শীর্ষে রয়েছে। এ গ্রন্থ মূল মহাসত্য ও উচ্চতম এবং পবিত্র উৎসের সাথে যুক্ত। কোরআনের এ বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি এমন যে পৃথিবীর সব বই এর কাছে তুচ্ছ এবং এ মহাগ্রন্থ অপছন্দনীয় সব মত বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।”
ফরাসি চিন্তাবিদ ডারমিংহাম লিখেছেন, “কোরআন মোহাম্মদের অনন্য মোজেজা বা অলৌকিক নিদর্শন। এর উচ্চতর সাহিত্য মান ও সৌন্দর্য এবং আলোকোজ্জ্বল শক্তি আজো অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে বিরাজ করছে।”
পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলোর অর্থের সঙ্গতি এ মহাগ্রন্থের আরেকটি অনন্য সৌন্দর্য। কোরআনের সূরা ও আয়াতগুলো একই সময়ে ও একই স্থানে নাজেল হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে নানা উপলক্ষ্যে ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে মহানবী (সাঃ)’র ওপর নাজেল হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর সূরা ও আয়াতগুলোর অর্থ এবং লক্ষ্যের সঙ্গতি বিস্ময়কর। আধুনিক যুগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরআনের প্রত্যেক সূরার রয়েছে স্বতন্ত্র এবং কিছু অভিন্ন লক্ষ্য। সূরাগুলোর কাঠামোও ভিন্ন ধরনের। এসব সূরা চিত্তাকর্ষক ভূমিকার মাধ্যমে শুরু হয় এবং এরপর উচ্চতর লক্ষ্যগুলো তুলে ধরে। কখনওবা সেগুলো একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। মিশরীয় গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেছেন, ” বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে কোরআনের আয়াতগুলো নাজেল হওয়া সত্ত্বেও পুরো গ্রন্থের যৌক্তিক ঐকতান ও ভাষাগত ঐক্য বজায় রয়েছে। আর এটাই কোরআনের মোজেজা বা অলৌকিকতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন।”
অভিনব নানা দিক ও সূক্ষ্ম ভাব তুলে ধরার ক্ষেত্রে কোরআনের ভাষাশৈলী খুবই যথাযথ এবং অনন্য। কোরআনের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত, তুলনা, উপমা বা রূপক প্রভৃতি অত্যন্ত অসাধারণ এবং আরবী সাহিত্যের দিক থেকে প্রচলিত রীতিসিদ্ধ। কিন্তু কোরআনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগ বিস্ময়করভাবে নিখুঁত ও যথাযথ হয়েছে।
কোরআনের দৃষ্টান্ত, তুলনা ও রূপক বা চিত্রকল্পগুলোর শৈল্পিক মান আরবী সাহিত্যে নজিরবিহীন। প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ ইবনে আসির এ প্রসঙ্গে সূরা নাবার দশ নম্বর আয়াতের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এ আয়াতে রাতকে পোশাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ইবনে আসির বলেছেন, রাতের অন্ধকার মানুষকে অন্যদের দৃষ্টি থেকে ও শত্রুদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে এবং শত্রুর অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ পালানোর সুযোগ পায়। পবিত্র কোরআন ছাড়া অন্য কোথাও এত সুন্দর ‘তুলনা’ পাওয়া যায় না বলে আসির মন্তব্য করেছেন। আরবী গদ্য ও পদ্যেও এমন সূক্ষ্ম তুলনার অস্তিত্ব নেই। আসির সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতের কথাও উল্লেখ করেছেন যেখানে স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোষাক হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। আসির লিখেছেন, “পোশাক যেমন মানুষকে সুশ্রী করে, মানুষের অসুন্দর অংশকে গোপন রাখে এবং রোদ, বৃষ্টি ও ঠান্ডা আবহাওয়ার ক্ষতি থেকে তাকে রক্ষা করে তেমনি স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের জন্য সৌন্দর্য্যের মাধ্যম। তারা পরস্পরের অপছন্দনীয় স্বভাবগুলো ঢেকে রাখে এবং তাদেরকে পদস্খলন ও পাপাচার থেকে রক্ষা করে। তাই এটা খুবই চমৎকার তুলনা।”
কোরআনের অপূর্ব ভাষাশৈলী বিশ্ব সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে। যেমন, মহাকবি হাফেজ, সাদী ও মাওলানা রুমির কবিতা বা গজলগুলো কোরআনের ভাষাশৈলীর মধুর রসের ছোঁয়ায় সিক্ত হয়েছে বলেই সেগুলো এত মিষ্টি শোনায় এবং এত জনপ্রিয়।
দশ.
পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতা এত ব্যাপক যে এখন পর্যন্ত চিন্তাবিদ ও আলেমরা এসব অলৌকিকতার সব দিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে কেউ দাবি করেননি। তবে জ্ঞান বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে কোরআন পরিচিতির অশেষ রহস্যের কিছু কিছু দিকও স্পষ্ট হচ্ছে। অবশ্য পবিত্র কোরআন নিরেট বিজ্ঞান বা গণিত বিষয়ক বই নয় যে, এর মধ্যে কেবলই বিজ্ঞান ও গণিত সম্পর্কিত মতামত বা বিস্তারিত বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যাবে।
মহানবী (সাঃ)’র চিরন্তন মোজেজা পবিত্র কোরআন মানুষের পথ প্রদর্শক। এ মহাগ্রন্থ নিজেকে প্রজ্ঞা, জ্ঞান, আলো ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলে অভিহিত করেছে। যেমন, সূরা বনি ইসরাইল বা সূরা আসরার নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে,যা সবচেয়ে সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে এ সুসংবাদ দেয় যে,তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে।”
ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের বর্ণনার রীতিও লক্ষনীয়। যেমন, এ মহাগ্রন্থে গুহায় আশ্রয় নেয়া কয়েকজন মুমিন যুবকের তথা আসহাবে কাহাফের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। তাগুতি ও কাফের শাসকের জুলুম থেকে আত্মরক্ষা এবং ঈমান রক্ষার জন্য তারা একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ক্লান্ত অবস্থায় তারা ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন তিনশ বছর পেরিয়ে গেছে।
মহাগ্রন্থ কোরআন এ কাহিনী তুলে ধরেছে যাতে এর শিক্ষা সম্পর্কে সবাই সচেতন হয়। আল্লাহ যে মৃত্যুর পর আবারও মানুষকে জীবিত করতে পারেন- এই শিক্ষার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অনেক মানুষ ওই ঘটনার অগুরুত্বপূর্ণ দিকের দিকে দৃষ্টি দেয়ায় কোরআন বিস্ময় প্রকাশ করেছে। যেমন, গুহাবাসীর সংখ্যা কয়জন ছিল তা নিয়ে বিতর্ক করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং মানুষের উচিত এ ঘটনার আলোকে মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তা করা।
পবিত্র কোরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মাধ্যমে অনেক নতুন তথ্য বা জ্ঞান অর্জন সম্ভব। যেমন, পবিত্র কোরআনের সংখ্যাগত মোজেজা বা অলৌকিকতার নানা দিক গত এক শতকে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ মহাগ্রন্থের সব বাক্য ও শব্দ বিশেষ গাণিতিক বা সংখ্যাগত নিয়মে বিন্যস্ত হয়েছে। এ বিষয়টি ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মত তুলে ধরেন মিশরের একজন চিন্তাবিদ। গবেষকরা তার এই আবিস্কারকে স্বাগত জানিয়েছেন। ওই মিশরিয় গবেষক এ নিয়ে তিন বছর গবেষণা করেন এবং কোরআনের সংখ্যাগত বিস্ময় তুলে ধরার মাধ্যমে এটা প্রমাণ করেছেন যে, এ মহাগ্রন্থ কোনো মানুষের রচনা নয়।
পবিত্র কোরআনের সংখ্যা বিষয়ক মোজেজা বা অলৌকিকতার প্রধান সংখ্যাটি উনিশ। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বা “পরম করুণাময় ও অনন্ত দাতা আল্লাহর নামে” বাক্যটিতে রয়েছে ১৯ টি অক্ষর। কোরআনের প্রতিটি সূরার শুরুতে রয়েছে এই মহান আয়াত। এ আয়াতটি কোরআনে ১১৪ বার এসেছে, যা উনিশের ছয় গুণ। কোরআনের সূরার সংখ্যাও ১১৪টি। অবশ্য সূরা তওবার শুরুতে এ মহান বাক্যটি নেই। অন্যদিকে সূরা নামলে এ বাক্য দু’বার রয়েছে।
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”-এর গভীর অর্থ ও গুরুত্বের কথা মুসলিম আলেম সমাজ যুগ যুগ ধরে উল্লেখ করে আসছেন। বিশ্বনবী (সাঃ)’র উপদেশ বা দিক নির্দেশনাতেও এ বাক্য তেলাওয়াতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলা না হলে বা এ বাক্যটি স্মরণ করা না হলে সে কাজটি বিফল হয়।
উল্লেখ্য, কোরআনের সর্বশেষ সূরা “সূরা আন নাস”-এর শব্দ সংখ্যা ১৯। এই সূরার প্রথম আয়াতের বর্ণ সংখ্যাও ১৯। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ সূরা আল আলাকের প্রথম আয়াতের শব্দ সংখ্যাও ১৯। এ সূরা কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরা। অন্য কথায় শেষের দিক থেকে এ সূরার অবস্থান ১৯ নম্বরে। এই সূরার মোট আয়াতের সংখ্যা ১৯। সূরা আত তওবা থেকে সূরা নামল পর্যন্ত সূরার মোট সংখ্যা ১৯। সূরা তওবায় ” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” শীর্ষক সূচনা-বাক্য দিয়ে শুরু হয়নি। অন্যদিকে সূরা নামলে এ বাক্য দু’বার রয়েছে। কোরআনে ওয়াহেদ শব্দটি ১৯ বার এসেছে। রহমান শব্দটি কোরআনে ৫৭ বার এসেছে যা ১৯ এর তিন গুণ। রহিম শব্দটি এসেছে ১১৪ বার যা ১৯ এর ৬ গুণ। ১৯ দিয়ে মেলানো যায় এমন আরো অনেক বিষয় রয়েছে এ মহাগ্রন্থের।* কোরআনের বিভিন্ন অংশের এসব সংখ্যাগত মিল সত্যিই অলৌকিক।
অনেক গবেষক বিচ্ছিন্ন কিছু বর্ণ বা হরফ দিয়ে শুরু হওয়া সূরাগুলো নিয়ে গণনাগত গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, এসব বর্ণের সাথে সংশ্লিষ্ট বা মূল সূরাটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, আলিফ লাম মীম দিয়ে শুরু হয়েছে সূরা বাকারা। এই সূরার সাথে আলিফ, লাম ও মীম বর্ণগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ি তাফসির আল মিযানের ১৮ তম খণ্ডে লিখেছেন, বিচ্ছিন্ন অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া যে সূরাগুলোর প্রথম অক্ষরটি অভিন্ন সেসব সূরার বিষয়বস্তুর মধ্যে মিল দেখা যায়। যেমন, সূরা আরাফের সাথে সূরা সোয়াদ এবং আলিফ লাম মীম দিয়ে শুরু হওয়া সূরাগুলোর বিষয়বস্তুর মধ্যে মিল লক্ষনীয়। “আলিফ লাম রা” দিয়ে শুরু হওয়া সূরা রাদের বিষয়বস্তুর সাথে আলিফ লাম মীম ও আলিফ লাম রা দিয়ে শুরু হওয়া সূরাগুলোর বিষয়বস্তুর মিলের কথাও এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক।
গবেষকরা আরো দেখেছেন যে, অশেষ রহস্যে ভরা মহাগ্রন্থ কোরআনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দ ও বিষয়ের মধ্যেও সংখ্যাগত সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, কোরআনে মাস অর্থে ব্যবহৃত “শাহর” শব্দটি এসেছে ১২ বার। দিন অর্থে “ইয়াওম” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৩৬৫ বার। ঘন্টা অর্থে “সয়াত” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২৪ বার।
আল কোরআনে ঈমান বা এর সমার্ধক শব্দ এসেছে ৮১১ বার এবং জ্ঞান বা এর সমার্থক শব্দ এসেছে ৮১১ বার। আর এ থেকে মানুষের সৌভাগ্যের দুই প্রধান চাবিকাঠি হিসেবে ঈমান ও জ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও গুরুত্ব ফুটে উঠে। মানবীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য ঈমান যতটা জরুরি, মানুষের পূর্ণতার জন্য জ্ঞানও ততটা জরুরি।
কোরআনে আকল বা এর সমার্থক শব্দ এবং নূর বা আলো শব্দটি এসেছে ৪৯ বার। কোরআনে ইবলিস শব্দ এসেছে ১১ বার এবং আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশও এসেছে ১১ বার। কোরআনের সংখ্যাগত বা গাণিতিক বিষয় সংক্রান্ত নবীন গবেষকদের সব দাবিই গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। প্রখ্যাত মুফাসসির ও ফকিহ আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজির মনে করেন, কোরআনের সূরার সাথে সূরার অক্ষরের সংখ্যাগত সম্পর্ক নির্নয়ে কম্পিউটারের ব্যবহার জরুরি; কিন্তু এ সংক্রান্ত গবেষণা এখনও খুব বিকশিত না হওয়ায় তাতে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। তার মতে এ ধরনের গবেষণা কোরআন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।
এগারো.
পবিত্র কোরআন হচ্ছে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ। কোরআন প্রতিটি মানুষকে সত্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানায়। সূরা সোয়াদের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমি কল্যাণময় গ্রন্থ তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি,যাতে মানুষ এর আয়াতসমুহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে’।
পবিত্র কোরআনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও মহাবিশ্বের এমন সব রহস্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে যা কোরআন নাজেলের হাজারো বছর পরে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করতে সক্ষম হচ্ছেন। ১৪শ’ বছর আগে কোরআন যখন মহাবিশ্ব, প্রকৃতি ও নভোমণ্ডল সম্পর্কে কথা বলেছে তখন আরব বিশ্বের মানুষ ওই সব বিষয়ে বিন্দুমাত্রও অবগত ছিল না। আরব বিশ্বের বাইরে গ্রীসসহ গুটি কয়েক দেশের কিছু দাশর্নিক প্রাকৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখতেন।
পঞ্চম হিজরির প্রখ্যাত দার্শনিক ও ফকিহ ইমাম মোহাম্মদ গাজ্জালি কোরআনের অলৌলিকতা সম্পর্কে বলেছেন, যেহেতু সাধারণতঃ আল্লাহর সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে চেনা সম্ভব হয় সেহেতু কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্টিজগতের নানা অলৌকিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
বর্তমান যুগেও যেসব উদারমনা বিজ্ঞানী কোরআন নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা সবাই এটা স্বীকার করেছেন যে,বিজ্ঞান সম্পর্কে কোরআনে যেসব কথা বলা হয়েছে তা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কানাডার সাবেক খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক ও অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার পবিত্র কোরআন সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। কোরআন নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যটা মোটেই ভালো ছিল না। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক হওয়ার কারণে তিনি ইসলাম ধর্মের নানা ভুল-ত্রুটি খুঁজে বেড়াতেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কোরআন ঘেটে এমন কিছু বিষয় বের করবেন যা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যাবে এবং কোরআনকে ঐশী ধর্ম হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা যাবে।
তিনি কোরআনে ভুল খোঁজার জন্য কাজ শুরু করলেন। কিন্তু তিনি কোরআন নিয়ে যতবেশি গবেষণা করলেন ততই বিস্মিত হতে থাকলেন। এভাবে কোরআন যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ সে বিষয়টি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো। অবশেষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল বলে যে তত্ত্ব বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “সত্য-প্রত্যাখ্যানকারীরা কি ভেবে দেখে না যে,আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিল। অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করলাম এবং সব প্রাণীকে পানি থেকে সৃষ্টি করলাম।”
ড.মিলার বলেছেন,এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণার পর কোরআন যে ঐশী গ্রস্থ তা মেনে নিতে বাধ্য হই। যারা প্রচার চালায় যে কোরআন হচ্ছে হযরত মোহাম্মদ (সা.)’র নিজস্ব বক্তব্য তাদের দাবি নাকচ করার জন্য এই একটি আয়াতই যথেষ্ট।
ড. মিলার বলেছেন, ১৪শ বছর আগে ইসলামের নবীর পক্ষে কীভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে কথা বলা সম্ভব, যিনি কোন দিন কোন স্কুলে পড়ালেখা করেননি। কারণ এটি এমন এক বৈজ্ঞানিক বিষয় যা সম্পর্কে তত্ত্ব আবিস্কার করে মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এক বিজ্ঞানী। মিলারের মতে,এই আয়াতে সেই বিগ ব্যাং’র কথাই বলা হয়েছে যার মাধ্যমে পৃথিবী, আকাশমন্ডলী ও তারকারাজি সৃষ্টি হয়েছে।
এই আয়াতের শেষাংশে পানিকে জীবনের উৎস বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়টিও আধুনিক বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রত্যেক প্রাণি দেহের মৌলিক গাঠনিক একক হচ্ছে কোষ এবং এই কোষের মূল উপাদান হচ্ছে সাইটোপ্লাজম। পানি ছাড়া কেউই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। একারণে মহাকাশবিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করেন,তখন তারা সর্বপ্রথমে খোঁজ করেন সেই গ্রহ বা উপগ্রহে কোনো পানির সন্ধান পাওয়া যায় কি-না। এর আগের অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা ফরাসি দার্শনিক ও চিকিৎসক মরিস বুকাইলি সম্পর্কে কথা বলেছি। তিনি তার “বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান” বইয়ে লিখেছেন, কোরআনের বিভিন্ন সূরায় সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে যেসব বক্তব্য এসেছে তার সবগুলোই আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি আরো লিখেছেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনের ঘটনা সম্পর্কে কোরআনের দু’টি আয়াতে সংক্ষেপে বর্ণনা এসেছে। এর একটি হলো সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত। যেখানে মহাবিস্ফোরণের কথা বলা হয়েছে।
অন্যটি হলো সূরা ফুস্সিলাতের ১১ নম্বর আয়াত যেখানে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অস্তিত্বের কথা বলে। ওই আয়াতে এসেছে, “অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধোঁয়ার পুঞ্জবিশেষ, এরপর আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি হতে নির্দেশ দেন। এখানে ধূম্রপুঞ্জ শব্দটি বিশ্বের আদিম অবস্থার সঠিক বর্ণনা দিচ্ছে, যা ছিল গরম গ্যাসের পিণ্ড যাতে বস্তুকণা দ্রুত ছোটাছুটি করছে, ধোঁয়ার মত। এ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র ও পৃথিবী তৈরি হয়।”
মরিস বুকাইলি বলেছেন, বিশাল জায়গাজুড়ে যে ছায়াপথ রয়েছে তা প্রথমে কী ছিলো, সে ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞান এখনও উত্তর দিতে পারেনি। আধুনিক বিজ্ঞান যা বলতে পারছে তাহলো বিশ্ব গ্যাসের পিণ্ড থেকে সৃষ্টি হয়েছে যা ঘূর্ণায়মান ছিল এবং এর মূল উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। তারপর নীহারিকা দৃশ্যমান বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডিত হয়েছে।
আমরা মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিষয়ে কথা বলছিলাম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিস্ফোরণ বা বিং ব্যাং’র মাধ্যমেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, ওই বিস্ফোরণের পর অতি দ্রুততার সঙ্গে যেসব পদার্থ ছড়িয়ে পড়েছিল তা থেকেই ছায়াপথ, সুর্য্য, তারা, পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
তারা বলছেন, ওই বিস্ফোরণের পর ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে যাতে তিল পরিমাণ বিঘ্ন সৃষ্টি হলে সব কিছু উলটপালট হয়ে যাবে। মহাবিশ্বে এই যে সুনিপুন শৃঙ্খলা,এর অর্থই হলো এর সৃষ্টিকর্তা রয়েছে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তা সৃষ্টি করেছেন।
ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফোর্ড হাবিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন মহাবিশ্ব একটি বিস্ফোরণে মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আমরা জানি, যেকোন বিস্ফোরণের ফলে যেসব উপাদান ছিটকে পড়ে তা কখনোই কোন নিয়ম মেনে বা সুশৃঙ্খলভাবে বেরোয় না। কিন্তু মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং’র ক্ষেত্রে এর উল্টো ঘটনাটি ঘটেছে। এটা বিস্ময়কর। কাজেই বিগ ব্যাং’র মাধ্যমে যদি কোন সুশৃঙ্খল ও সুনিপুণ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সেখানেই ঐশি হস্তক্ষেপ ছিল। অন্যদিকে পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্বও বিস্ময়কর। এটি এমন একটি গ্রহ যেখানে প্রাণিকূলের জীবন যাপনের জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে যা কোন ভাবেই দুর্ঘটনাক্রমে হওয়া সম্ভব নয়।
কাজেই আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করছি তা এমন এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ বহন করছে যিনি শুন্য থেকে সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টিতে সুনিপুণ শৃঙ্খলা দিয়েছেন।
বারো.
ঐশী প্রত্যাদেশ বা ওহী এবং বুদ্ধিমত্তা বা আকল মানুষের জ্ঞান অর্জনের দু’টি প্রধান উৎস। মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের কাছে যে ওহী পাঠিয়েছেন তার সুবাদে মানুষের কাছে বিশ্ব জগতের অনেক রহস্য ও বাস্তবতা স্পষ্ট হয়েছে। মানুষ তার প্রতিভা বা আকলকে কাজে লাগিয়ে, অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টার সুবাদেও কিছু জ্ঞান অর্জন করে। এ দুই উৎসের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাবিদরা যুগে যুগে অনেক গবেষণা করেছেন। অনেকে মনে করেন আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক তথ্য বা মত পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তুগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা একে কোরআনের বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা বলে অভিহিত করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান বা তথ্য আমাদের কাছে বিশ্ব জগতের অনেক রহস্য উন্মোচন করে এবং মহান আল্লাহর অশেষ শক্তি, ক্ষমতা, নৈপুণ্য ও শৈল্পিক কুশলতা সম্পর্কে চিন্তার খোরাক জোগায়। মহান আল্লাহ বহু আকাশ ও জমিনগুলোসহ এর মধ্যকার সব কিছু ছয় যুগে সৃষ্টি করেছেন বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। এ বক্তব্য নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে।
ফ্রান্সের মরিস বুকাইলি ও লাপ্লাস, রাশিয়ার জর্জ গামুফ মনে করেন- কোরআনের দেয়া তথ্যগুলো নতুন বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এ মহাগ্রন্থের ৭৫০টিরও বেশি আয়াতে সৃষ্টি জগতের রহস্য নিয়ে বক্তব্য এসেছে।
সৃষ্টি জগতের নানা বিষয় নিয়ম ও লক্ষ্যের চাহিদা অনুযায়ী নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সৃষ্টির নানা বিস্ময়কর নিদর্শন স্রষ্টার মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিশ্ব জগতের কাঠামো সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে। যেমন, গ্রহ-নক্ষত্রের নানা ভূবন বা জগত রয়েছে যেখানে এসব গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যাকর্ষণ ক্ষমতা, শৃঙ্খলার চলক ও রক্ষণাবেক্ষণ নিজ নিজ অক্ষপথকেন্দ্রীক। বিজ্ঞানী নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের পর এর চেয়েও আরো গভীর বাস্তবতার সন্ধান পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, “গ্রহ-নক্ষত্রের জগতের নানা বিস্ময় ব্যাখ্যা করার জন্য কেবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী ও মহাজ্ঞানী এক উৎস এসব গ্রহ-নক্ষত্রের চলার পথ, গতি, ব্যবধান প্রভৃতি সূক্ষ্মভাবে হিসেব করেছেন এবং এসব গ্রহ-নক্ষত্রকে নির্দিষ্ট অক্ষ পথে স্থাপন করেছেন। আর এই উৎসই হলেন খোদা।”
পবিত্র কোরআনের সূরা রাদের ২ নম্বর আয়াতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে ইশারা রয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ, যিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে অদৃশ্য স্তম্ভ দিয়ে বা দৃশ্যমান স্তম্ভ ছাড়াই। অতঃপর তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন ( তথা বিশ্ব পরিচালনার নিয়ন্ত্রণকে নিজ ক্ষমতার আওতায় এনেছেন) । এবং সূর্য ও চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শনগুলো প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।”
মহান আল্লাহ কোরআনের আয়াতে আকাশগুলোকে তারকারাজি দিয়ে সুশোভিত বা সাজানোর কথা বলেছেন। এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেছেন, “তারা কি তাদের উপরস্থিত আকাশের পানে তাকায় না আমি কিভাবে তা নির্মাণ করেছি এবং সুশোভিত করেছি? তাতে কোন ছিদ্র বা ফাটলও নেই।”

মহান আল্লাহ সুর্য ও এর আলো, চাঁদ ও এর গতির কথা এবং সুপরিকল্পিতভাবে এসব সৃষ্টির কথা বলেছেন। জ্যোতি-পদার্থ বিদ্যা বা এস্ট্রোফিজিক্সের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, আমাদের সৌর জগত বা সূর্যকেন্দ্রীক এই মহাকাশে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাইরের ছায়াপথমুখী একটি প্যাঁচানো গতি রয়েছে। সূরা ইয়াসিনের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, সূর্য তার নির্দিষ্ট অক্ষ বা অবস্থানের দিকে সব সময় গতিশীল বা আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ।
সূরা নুহের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। এবং সেখানে চন্দ্রকে রেখেছেন আলোরূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপরূপে।”
ভূপৃষ্ঠ বা পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য ও এর গঠন এবং সৃষ্টি কৌশল নিয়ে বক্তব্য রয়েছে পবিত্র কোরআনে। অতীতে মানুষ মনে করত পৃথিবী স্থির। মহান আল্লাহ সূরা নামলের ৮৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তুমি পর্বতমালাকে দেখে অচল মনে কর, অথচ সেদিন এগুলো মেঘমালার মত চলমান।”
অনেক তাফসিরকারক মনে করেন পাহাড়ের গতিশীলতার কথা বলে কোরআন আসলে পৃথিবী যে গতিশীল সেটাই হয়তো বলতে চেয়েছে। পৃথিবী যে গতিশীল তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। সূরা ত্বাহা’র ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
“তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে শয্যা বা দোলনা করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন, …”
দোলনার ধীর গতির দোলা যেমন শিশুকে প্রশান্ত করে এবং তার চোখে ঘুম নিয়ে আসে তেমনি পৃথিবীও মানুষের জন্য ধীর গতির দোলার মাধ্যমে প্রশান্তি দেয়। পৃথিবী যে গোলক আকৃতির বা গোলাকার তাও কোরআন পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছে। মহান আল্লাহ সূরা মাআরেজের ৪০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলগুলোর পালনকর্তার, নিশ্চয়ই আমি সক্ষম!”
এখানে কয়েকটি পূর্ব ও কয়েকটি পশ্চিমের কথা বলা হয়েছে। পৃথিবী সমতল হলে তাতে কেবল একটি পূর্ব ও একটি পশ্চিম দিক থাকত। কিন্তু গোলাকার হওয়ায় সব জায়গাতেই একটি পূর্ব ও একটি পশ্চিম দিক তথা উদয়াচল ও অস্তাচল রয়েছে।
সৃষ্টি তত্ত্ব বা রহস্য বর্ণনা করে কোরআন মানুষকে আল্লাহমুখী বা আল্লাহর পরিচিতির দিকে আকৃষ্ট করতে চায়। মানুষের হাতের মুঠোয় এত যে ব্যাপক নেয়ামত এনে দেয়া হয়েছে তা থেকে বোঝা উচিত মানুষকে বিনা উদ্দেশ্যেই এসব নেয়ামত ও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। তাই মানুষকেও এ বিশ্ব জগতে তার অবস্থান ও দায়িত্ব বুঝতে হবে। কোরআনের সূরা আম্বিয়ায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “আমি আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। ”
প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ি’র মতে, কোরআনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানা শাখাসহ জ্ঞানের সব শাখার তথ্য রয়েছে এবং কোরআন এসব জ্ঞান মানুষকে উপহারদিয়েছে তার কল্যাণ, সৌভাগ্য ও মুক্তির জন্য। তবে শর্ত হল মানুষকে প্রকৃত বিশ্বদৃষ্টি, যার মূলে রয়েছে আল্লাহর পরিচিতি- সেই বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে এসব জ্ঞান চর্চা করতে হবে। কারণ, যেসব জ্ঞান মানুষকে মূল্যহীন বিষয়ে ব্যস্ত রাখে এবং আল্লাহকে ও বাস্তবতাকে চেনা বা জানা থেকে বিরত রাখে কোরআনের দৃষ্টিতে তা অজ্ঞতার সমতুল্য। (ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন, পৃ-৬৪) #
তের.
ঐশী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে সুশৃংখল এই বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে। আর সৃষ্টি জগতের সর্বত্রই রয়েছে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শন। আর এই পৃথিবীতে মানুষ হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষকে সৃষ্টির রহস্য উপলব্ধি এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব- মানুষকে ওই দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগালে সহজেই জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে এবং পৃথিবীতে আরো উন্নত সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
মানব ভ্রুণ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় এবং মানব সৃষ্টিতে ব্যবহৃত উপাদান সম্পর্কে কোরানের আয়াতগুলো বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা হিসেবে গণ্য করা হয়। পবিত্র কোরানের সূরা আনআম, হজ্ব, মু’মিনূন, রুম ও সিজদায় এ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। সূরা মুমিনূনের ১২ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে মানব ভ্রুণের বিকাশের প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। এ আয়াতের শুরুতে মানুষকে কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি মানুষকে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছি।অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি। এরপর জমাট রক্তকে মাসংপিণ্ডে পরিণত করি এবং মাংসপিণ্ডকে অস্থিপঞ্জরে, অতঃপর অস্থিপঞ্জরকে মাংস দিয়ে ঢেকে দেই। অবশেষে আমি আরেক রূপ দেই। অতএব কত মহান সেই আল্লাহ যিনি শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিকর্তা।
ভ্রুণ সম্পর্কে কোরানের বক্তব্যের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। আর এ কারণে আধুনিক যুগের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা বিস্মৃত হয়েছেন। ড. কেইট মোর হলেন ভ্রুণতত্ত্বের জনক। তিনি ১৯৮৪ সালে কানাডার বিজ্ঞান বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারটি পেয়েছেন। কোরানে ভ্রণতত্ত্ব সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতে তাকে একবার একটি মুসলিম দেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি প্রথমে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, কোরান হচ্ছে এক হাজার চৌদ্দশ’ বছর আগের এক গ্রন্থ। কাজেই সেখানে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কিছুই থাকার কথা নয়। কারণ মাত্র প্রায় ৫০ বছর আগে ভ্রুণ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। ড. কেইট মোর এ বিষয়ে কোরানের দূর্বল দিকগুলো তুলে ধরার মনোবাসনা নিয়ে মুসলিম দেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি ভ্রুণ সম্পর্কে কোরানের কয়েকটি আয়াত পড়ে দেখার পর বিস্মিত হন এবং এরপর তার দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন আসে। তিনি বলেছেন, কোরানের ভ্রুণ সংক্রান্ত বেশির ভাগ বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। তিনি আরো বলেছেন, এ সংক্রান্ত কোরানের আরো কিছু বক্তব্য আছে যেগুলো সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট জ্ঞান নেই। কারণ কোরানে ভ্রুণ সম্পর্কে আরো যেসব কথা বলা হয়েছে,বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কথা বলেনি। এক হাজার চারশ’ বছর আগে কোন ব্যক্তির পক্ষে এমন তত্ত্ব দেয়া সম্ভব নয় বলে তিনি জানিয়েছেণ। কোরান যে আল্লাহর বাণী অবশেষে কেইট মোরই তা স্বীকার করেছেন।
ড. মোর ঐশী গ্রন্থ কোরানের কোন ত্রুটিতো খুঁজে বের করতে পারেনইনি বরং কোরান থেকে পাওয়া তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি তার প্রকাশিত কয়েকটি বই ও নিবন্ধে মৌলিক পরিবর্তন এনেছেন। তার একটি বই হলো মানব বিকাশ সম্পর্কে। তিনি ওই বইয়ের নতুন সংস্করণেও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন। ওই বইটি ১৯৮২ সালে চিকিৎসা বিষয়ক সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে এবং অনেক দেশে তা পাঠ্যবই হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
কেইট মোর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, মানুষের বিকাশ সংক্রান্ত কোরানের বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। তিনি আরো বলেছেন, আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে, কোরানের বানী আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মোহাম্মদ(স.) এর কাছে পাঠানো হয়েছে। কারণ রাসূলের যুগের কয়েক শ বছর পরেও ভ্রুণ সংক্রান্ত সব বিষয় আবিস্কৃত হয়নি। আমি নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করে, রাসূল হচ্ছে আল্লাহর দূত।
তার মতে, বর্তমানে ভ্রুণের বিকাশের যে পর্যায়গুলোর কথা বলা হয় তা খুব সহজে বোধগম্য নয়। কিন্তু কোরানে ভ্রুণের বিকাশের পর্যায়গুলোকে সুস্পষ্টভাবে বিভাজন করা হয়েছে। এর ফলে সহজে তা বোধগম্য। কোরানের বক্তব্য অনুযায়ী আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ভ্রুণের পরিপূর্ণতার সকল পর্যায় সম্পন্ন হয়। সুরা এনফেতারের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ,অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি তোমাকে তার ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করেছেন।
মানুষ তার অস্তিত্বের প্রথম পর্যায়ে ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগে ভ্রুণ অবস্থায় থাকে। জন্মের পর মানুষ অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করে। সুরা হজ্বের ৫ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমাদের সন্দেহ থাকে তবে এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করো যে, আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্র হতে ,তারপর রক্তপিণ্ড হতে। যেন আমি তোমাদের সুবিদিত করি। আমি যা ইচ্ছা করি,তা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে রেখে দেই।, তারপর আমি তোমাদের শিশুরুপে বের করি, যেন তোমরা স্বীয় যৌবনে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্য ঘটে। কেউ কেউ এতদিন বেচে থাকে যে জীবনের সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌছে দেয়। যার ফলে তারা যা জানতো সে সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না।
ভ্রুণবিদ্যা অনুযায়ী, ভ্রুণ অবস্থায় মানুষের যে ইন্দ্রিয়টি সক্রিয় হয় তাহলো শ্রবণ ইন্দ্রিয়। ভ্রুণ অস্তিত্ব লাভের ২৪ সপ্তাহ পর থেকে শব্দ শুনতে পায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে ভ্রুণের দৃষ্টি শক্তি বিকশিত হয়। ২৮ সপ্তা বয়স থেকে চোখের রেটিনা আলোর সামনে প্রতিক্রিয়া দেখায়। সুরা সিজদার ৯ নম্বর আয়াতে ভ্রুণের ইন্দ্রিয় শক্তি সক্রিয় হওয়া সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা করেছেঃ অতপরঃ তিনি ওকে সুঠাম করেছেন, তাতে রুহ সঞ্চার করেছেন তার নিকট হতে এবং তোমাদের দিয়েছেন চোখ,কান ,অন্তর।
ড. মোর কোরানের বৈজ্ঞানিক দিকগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর কোরানের বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা সংক্রান্ত অধিকাংশ সম্মেলনেই অংশ নিয়েছেন। রাশিয়ার এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি মুসলিম ও অমুসলিম জ্ঞানী-গুণিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ওই সম্মেলন রাশিয়ার একটি টিভি চ্যানেল থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে। ওই সম্মেলনের ফলে রাশিয়ার ৩৭ জন বিজ্ঞানী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ড.মোর মুসলমান হয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, কোরান আল্লাহর গ্রন্থ এবং মোহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। এরপর প্রশ্নকর্তা বলেন, তাহলে আপনি এখন মুসলমান?
তিনি এরপর বলেছিলেন, আমি মুসলমান হওয়ার কথা এখনো ঘোষণা করিনি কিন্তু তারপরও আমি সামাজিকভাবে নানা চাপের মধ্যে আছি। এর এক বছর পর ভ্রুণ তত্ত্বের জনক ড. কেইট ইসলাম গ্রহণের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেন। ড. কেইটের মতো আরো অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ইসলামের প্রতি ঈমান আনছেন।
মার্কিন নাগরিক ও বিজ্ঞানী মার্শাল জনসন ভ্রুণতত্ত্ব সম্পর্কিত আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন, ভ্রুণের বিকাশের পর্যায়গুলো সম্পর্কে কোরানের বর্ণনা দুর্ঘটনাজনিত হতে পারে না। কেবলমাত্র শক্তিশালী মাইক্রোসকোপের সাহায্যেই এ বাস্তবতা আবিস্কার করা সম্ভব। কোরান হলো, ১ হাজার চৌদ্দশ বছর আগের গ্রন্থ। সে সময় কোন মাইক্রোসকোপের অস্তিত্ব ছিল না। তখনও মাইক্রোসকোপ আবিস্কৃতই হয়নি। কোরান নাজিলের বহু বছর পরে যখন মাইক্রোসকোপ আবিস্কৃত হলো তখন ওই মাইক্রোসকোপ কোন বস্তুকে ১০ গুণের বেশি বড় করতে পারতো না এবং এর স্বচ্ছতাও কম ছিল। কাজেই কোরানের বাণী মানুষের হতে পারে না।
কোরান হলো, মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করার দিকনির্দেশনা। প্রাকৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কে কোরানে যেসব সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ও বক্তব্য রয়েছে তা চিন্তাশীলদের জন্য পথনির্দেশক। সুরা আল ইমরানের ১৯০ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: নিশ্চয় আকাশ ও জমিন সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাতের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।
কোরানের আয়াত আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে , আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার কিছু গুণ মানুষকে আমানত হিসেবে দিয়েছেন। যদি এসব গুণ ধারণ করে মানুষ এগিয়ে যায় এবং যোগ্যতাকে বিকশিত করার চেষ্টা চালায় তাহলে অনেক কিছু অর্জন করতে পারবে। পৃথিবীর মানুষ তার মাধ্যমে উপকৃত হবে।#
চৌদ্দ.
পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সমুদ্রের পানির স্বাদ কটু ও নোনা। অবশ্য সমুদ্রের আশপাশের স্থলভাগের নিচের পানি বা ভূগর্ভস্থ পানি নোনা ও তিক্ত হয় না। যদি সাগরের নোনা পানি ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানির সাথে মিশে যেত তাহলে এই পানিও পানের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ত। পবিত্র কোরআনে সাগরগুলোর পানির মধ্যে দেয়াল থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামী সংস্কৃতিতে পানি পবিত্রতা ও জীবনের প্রতীক এবং পানিকে সর্ব সাধারণের সম্পদ ও শ্রেষ্ঠ পানীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কোরআনে ৫৯ বার পানি শব্দটি স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে পানিকে জীবনের উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের সুরা আম্বিয়ার ত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
“..প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। ..”বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) পানিকে শ্রেষ্ঠ পানীয় বলে উল্লেখ করেছেন। পানি সংক্রান্ত গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হল নোনা ও মিষ্টি পানি। সুরা ফোরকানের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, এটি মিষ্ট, তৃষ্ণা নিবারক ও এটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।”
কোরআনে সাগর বা সমুদ্র সম্পর্কে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে সেসব তথ্য মানুষ শত শত বছর ধরে জানত না। সূরা নামলের ৬১ নম্বর আয়াতেও “দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায়” থাকার কথা এসেছে। এ আয়াতে দুই সাগরের পানির বৈশিষ্ট্য হিসেবে “স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানি” এবং “নোনা ও কাদাযুক্ত” পানির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা ফাতিরের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,”দু’টি সমুদ্র সমান হয় না-একটি মিঠা ও তৃষ্ণা-নিবারক এবং অপরটি লোনা। উভয়টি থেকেই তোমরা তাজা গোশত (মৎস্য) আহার কর এবং পরিধানে ব্যবহার্য গয়নাগাটি আহরণ কর। তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”
সমুদ্র সম্পর্কিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সুবাদে এটা স্পষ্ট যে সাগর উপকূলে মিষ্টি পানির প্রবাহ পাওয়া যায় এবং এসব প্রবাহের ওপর নোনা পানির কোনো প্রভাব নেই। মিষ্টি পানির ওজন নোনা পানির চেয়ে হাল্কা হওয়ায় মিঠা পানি নোনা পানির ওপরে থাকে। এ দুই পানির মধ্যে থাকে অভিন্ন পর্দা বা আড়াল। বেশিরভাগ জীব-জন্তু পাওয়া যায় উপকূলীয় অঞ্চলে। যেমন, শৈবাল, শামুক, মাছ প্রভৃতি। উপকূলীয় অঞ্চলের পানির সর্বোচ্চ গভীরতা ২০০ মিটার। তাই সূর্যের আলো এই গভীরতায় পৌঁছতে পারে। ফলে মাছসহ বিভিন্ন জীব-জন্তু এসব অঞ্চলে ব্যাপক হারে জন্ম নেয় যা মানুষের খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এ ছাড়াও সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চলে উর্বর বা সমৃদ্ধ পলি জমে। এ অঞ্চলে লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালমুনিয়াম ও বিভিন্ন ধরণের ধাতব লবণ এবং ধাতু ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্য পূর্ণ নোনা দরিয়া রয়েছে। এসব দরিয়ার পানির প্রবাহ সব সময়ই আলাদা থাকে। যেমন,লোহিত সাগরের পানি ভারত মহাসাগরের পানির চেয়ে বেশি গরম এবং এ সাগরে লবণও বেশি। এ দুই সাগরের মধ্যে রয়েছে মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের নির্দিষ্ট পানি সীমা।
কয়েকটি সাগর মিলিত হয়ে গড়ে ওঠে মহাসাগর। এসব সাগরের পানির ঘনত্ব, তাপমাত্রা, উপাদান ও জীবনের পরিবেশ ভিন্ন ধরণের। কিন্তু এসব সাগরের মধ্যে রয়েছে অদৃশ্য সীমানা বা দেয়াল যা সাগরগুলোর পানিকে পরস্পরের সাথে মিশতে দেয় না। বিংশ শতকে আধুনিক উপগ্রহ থেকে বিভিন্ন মহাসাগরের পানির আলোকচিত্র নেয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে সাগরগুলোর পানির রং এক নয় এবং কয়েকটি সাগর মিলে একটি মহাসাগর গঠিত হওয়া সত্ত্বেও সেসবের পানি পরস্পরের সাথে মিশে যায় না বা নিজ সীমানা লংঘন করে না। বিশেষ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই এই স্বাতন্ত্র বা পার্থক্য বজায় থাকে। ঘনত্বের পার্থক্য এ আকর্ষণ তৈরি করে এবং এর ফলে সৃষ্ট একটি কোমল দেয়াল বা পর্দা এক সাগরের পানির সাথে অন্য সাগরের পানিকে মিশতে দেয় না। এমনকি বিশাল ঢেউ ও স্রোতের প্রবাহও এই দেয়ালকে ভাঙ্গতে পারে না।
ফরাসি চিন্তাবিদ ও চিকিৎসক অধ্যাপক মরিস বুকাইলি বলেছেন, “সাগরগুলো সম্পর্কে কোরআনের আয়াত বা বক্তব্যগুলোর সাথে এ মহা গ্রন্থ নাজেল হওয়ার সময়কার সাগর সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তী ও বক্তব্যগুলোর কোনো মিল নেই। আধুনিক বিজ্ঞান সাগরের নোনা পানির সাথে নদীর মিঠা পানির মিশ্রিত না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। অনেকে বিষয়টিকে কেবল ফোরাত ও টাইগ্রিস সম্পর্কে প্রযোজ্য মনে করেন। কিন্তু মিসিসিপি ও ইয়াংসি’র মত বড় নদীর ক্ষেত্রেও কোরআনের এ বক্তব্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোরআনের এসব আয়াত এ মহা গ্রন্থের অলৌকিকতাই তুলে ধরছে। সাগর থেকে মুক্তা ও মূল্যবান অলঙ্কার বা গয়না যে আহরণ করা যায় কোরআন তাও উল্লেখ করেছে যা পাঠককে এসব বিষয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার আমন্ত্রণ জানায়।”
অনেক আলেম মনে করেন মিষ্টি পানি ও নোনা পানির সাগর পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য বজায় থাকার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ কাফের ও মুমিনদের পার্থক্যও তুলে ধরেছেন। তিনি মুমিনদেরকে “স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানি” এবং কাফেরদেরকে “নোনা ও কাদাযুক্ত” পানির সাথে তুলনা করেছেন যদিও তারা পৃথিবীতে পাশাপাশি বসবাস করে।
মুমিনদের মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পবিত্র। তারা সৎ কাজের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের অধিকারী। কিন্তু অবিশ্বাসীরা মানবীয় প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভ্রান্ত ও ধ্বংসের শিকার হয়। কাফেররা দুনিয়ার নানা নেয়ামত ভোগ করা সত্ত্বেও মুমিনদের মত সত্যের অনুসারী নয় এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য অভিন্ন নয়। সুরা নুরের ত্রিশ ও ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“যারা কাফের, তাদের কাজ মরুভুমির মরীচিকার মত, যাকে পিপাসার্ত ব্যক্তি পানি মনে করে। এমনকি, সে যখন তার কাছে যায়, তখন কিছুই পায় না এবং পায় সেখানে আল্লাহকে, এরপর আল্লাহ তার হিসাব চুকিয়ে দেন। আল্লাহ দ্রুত হিসাব নেন। অথবা (তাদের কাজ) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের মত, যাকে উদ্বেলিত করে তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ, যার ওপরে ঘন কালো মেঘ আছে। একের ওপর এক অন্ধকার। যখন সে তার হাত বের করে, তখন তাকে একেবারেই দেখতে পায় না। আল্লাহ যাকে জ্যোতি দেন না, তার কোন জ্যোতিই নেই।”
সমুদ্র বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্যের আলোর তিন থেকে ত্রিশ ভাগ সাগরে প্রতিফলিত হয়। তাই ২০০ মিটার গভীর সাগরে নীল রং ছাড়া আলোর সবই রংই মিশে যায়। সাবমেরিনসহ নানা উন্নত সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন গভীর সাগরের পানির ঘনত্ব বেশি হওয়ায় দুই ধরণের ঢেউ সৃষ্টি হয়। ওপরের ঢেউ ও ভেতরের ঢেউ। নিচের ঢেউ অন্ধকার হওয়ায় দেখা যায় না। সাগর বিষয়ক জার্মান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দুগারো মনে করতেন বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে ধর্মের দরকার নেই। কিন্তু সুরা নুরের এ আয়াত শোনার পর তিনি বলেছেন, ” এসব কথা কোনো মানুষের কথা হতে পারে না, এ আয়াত ইসলামের অলৌকিকতার প্রমাণ”। #
পনের.
পবিত্র কোরআন সুপথ বা হেদায়াত লাভের ঐশী মহাগ্রন্থ। প্রতিদিন লাখ লাখ মুসলমান এবং এমনকি অনেক অমুসলমানও বিভিন্ন ভাষায় অধ্যয়ন করছেন এই অনন্য কিতাব। এ আসমানি কিতাব সব সময়ই মানুষকে জ্ঞান অর্জন করতে ও জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানায়। ফরাসি চিন্তাবিদ জোয়েল লুবিন মনে করেন কোরআনের বাণীগুলো যুক্তিপূর্ণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক হওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জীবনে এ মহাগ্রন্থ যোগায় অশেষ প্রাণশক্তি এবং কোরআনই তাদের জীবনের মূল অক্ষ বা কেন্দ্র-বিন্দু। জোয়েল লুবিন লিখেছেন, “কোরআন এমন এক গভীর সাগর যা থেকে সঞ্চারিত হয়েছে জ্ঞানের অনেক নদ-নদী। এভাবে বিশ্ববাসীর কাছে কল্যাণ পৌঁছে দিয়েছে এ গ্রন্থ। এটা স্পষ্ট কোরআন সব সময়ই জীবিত থাকবে। প্রত্যেক যুগেই জ্ঞান-পিপাসু ও গবেষকরা নিজস্ব চিন্তাশক্তি এবং উপলব্ধি-ক্ষমতার আলোকে কোরআন থেকে উপকৃত হচ্ছে। ”
কোরআনের দৃষ্টিতে বিশ্ব জগতের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মহান আল্লাহর সৃষ্টি-কৌশল, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈপুণ্যের নানা নিদর্শন। এ মহাগ্রন্থ সৃষ্টি-জগত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার আহ্বান জানায়। বৈজ্ঞানিক বিষয়সহ মানুষের অজানা অনেক বিষয় তুলে ধরেছে কোরআন। আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে কোরআনের তুলে ধরা এ সংক্রান্ত তথ্যগুলোর মিল বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে। তাই এ বিষয়গুলো কোরআনের অলৌকিকতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যেমন, মহান আল্লাহ বহু শতক আগে কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি উদ্ভিদসহ জীবন্ত সব কিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। সুরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন,
“পবিত্র তিনি যিনি জমিন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, তাদেরই মানুষকে এবং যা তারা জানে না, তার প্রত্যেককে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন।”
সুরা “রাদ”-এ মহান আল্লাহও বলেছেন, ” তিনিই ভূমণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড় পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দু’দু প্রকার সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি দিয়ে আবৃত করেন। এতে তাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে,যারা চিন্তা করে। ”
উল্লেখ্য পবিত্র কোরআন নাজেল হওয়ার যুগে মানুষ সমস্ত জীবন্ত সৃষ্টিকুলের লিঙ্গ ভেদ তথা পুংলিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ থাকার বিষয়ে অবগত ছিল না। কোরআনই প্রথম এ তথ্য দিয়েছে। এ বিষয়টি মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও একত্বের নিদর্শন। সুরা জারিয়াতের ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
“আমি ভূমিকে বিছিয়েছি। আমি কত সুন্দরভাবেই না বিছাতে সক্ষম। আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম কর।”
সর্বপ্রথম যে বিজ্ঞানী উদ্ভিদের মধ্যে পুলিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি হলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল লিনে। খৃস্টিয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি এ মত প্রকাশ করেন। তার ওই বক্তব্যে অনেকেই বিস্মিত হয় এবং তারা গির্জার কর্মকর্তাদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে কয়েক বছর ধরে ইউরোপে তার লেখনীকে ভুল মতামত হিসেবে ধরা হত। কিন্তু এর কিছু পরই বিজ্ঞানীরা লিনের মতামতকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেন এবং তা একটি বৈজ্ঞানিক মূল নীতি হিসেবে গৃহীত হয়।
পবিত্র কোরআনে উদ্ভিদের প্রজনন বা পরাগায়ন সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। এ মহাগ্রন্থে বলা হয়েছে, উদ্ভিদ ও গাছপালার ফুলের পরাগায়ন বাতাসের মাধ্যমে ঘটে। সুরা হিজরের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
“আমি বায়ুর বিভিন্ন প্রবাহ পাঠিয়ে থাকি (মেঘ ও গাছপালাকে) গর্ভবতী করার জন্য। আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি এবং তোমাদেরকে তা পান করাই। … …”
প্রাচীন কালেও মানুষ খেজুরের মত কোনো কোনো গাছের স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতি থাকার বিষয়ে জানতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, নর খেজুর গাছের ফুলের পরাগ-রেণু স্ত্রী খেজুর গাছের ফুলের গর্ভাশয়ে মিলিত না হলে ওই গাছে খেজুর ফলবে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সব উদ্ভিদ বা জীবের ক্ষেত্রেই স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতি থাকার কথা জানতেন না। অবশ্য সব উদ্ভিদের পরাগায়ন একই ধরণের নয়। কোনো কোনো উদ্ভিদের ফুলের পরাগায়ন কীট-পতঙ্গ, পাখি, প্রজাপতি ও মৌমাছির মাধ্যমেও সম্পন্ন হয়। তুলা, ডাল জাতীয় উদ্ভিদ, ডালিম ও মাল্টা জাতীয় ফল গাছের ফুলের পরাগায়ন বাতাসের মাধ্যমে হয়। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু যখন পরিণত বা পরিপক্ব হয় তখন এসব রেণুধারী কোষ বা বৃন্তের মুখ খুলে যায় এবং পাউডারের মত রেণুগুলো বাতাসের মাধ্যমে স্ত্রী ফুলে ছড়িয়ে পড়ে। স্ত্রী ফুলের গর্ভাশয়ে এসব পরাগ-রেণুর মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে এবং গর্ভাশয়টি ফলে পরিণত হয়। মৌমাছি বা প্রজাপতি জাতীয় কীট-পতঙ্গ ফুলে মধু খেতে গিয়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ-রেণু বহনের মাধ্যমেও একইভাবে পরাগায়ন ঘটায়।
পবিত্র কোরআনের বৈজ্ঞানিক তথ্যের আরেকটি দিক হল, সৃষ্টিকুলের ভারসাম্য। উদ্ভিদ জগতেও ভারসাম্য দেখা যায়। সুরা হিজরের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ” আমি ভূপৃষ্ঠে প্রত্যেক বস্তু সু-পরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি।” এখানে যে বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হল গাছ-পালা জন্মের ক্ষেত্রে যেসব উপাদানের প্রভাব রয়েছে সেগুলো পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ। বিভিন্ন ঋতুতে বাতাস, মাটি ও তাপমাত্রার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার আলোকে নানা ধরণের গাছপালা, ফুল ও ফল জন্মে। সম্প্রতি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রত্যেক গাছ-পালার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা অংশ ও উপাদানের সুনির্দিষ্ট হিসাব, মাপ বা ওজন রয়েছে। এসব অংশের কোনটি কম বেশি হলে তা অন্য উদ্ভিদে পরিণত হয়।
কোরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্যের অলৌকিকতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক অজানা রহস্যের পর্দা উন্মোচিত করেছে। তবে পবিত্র কোরআনের মূল লক্ষ্য হল মানুষকে সুপথ দেখানো। তবুও এ মহাগ্রন্থে মাঝে মধ্যে ইশারায় ইঙ্গিতে যেসব বৈজ্ঞানিক তথ্য দেয়া হয়েছে তা থেকেই বোঝা যায় এমন এক উৎস থেকে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে যাঁর জ্ঞান-ভাণ্ডার অশেষ বা অসীম এবং যিনি অতুলনীয় মহা-কৌশলী। আর এই মহান সত্তাই বিশ্ব জগতের একমাত্র স্রষ্টা এবং তিনিই উপাসনা বা এবাদতের যোগ্য একমাত্র সত্তা। সুরা ফোরকানের ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
” হে রাসূল! আপনি বলুন, একে তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গোপন রহস্য অবগত আছেন। তিনি ক্ষমাশীল, মেহেরবান। ” #
ষোল.
কোরআনের নানা তথ্যের অলৌকিকতার মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা ঘটার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী অন্যতম। যেমন,রোমের কাছে ইরানের পরাজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী। ৬১৫ খৃস্টাব্দে ইরানে সাসানীয় রাজবংশের শাসন চলাকালে রোমান সাম্রাজ্য ইরানের কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু খুবই শিগগিরই ইরান রোম সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হবে কোরআন জোরালো ও স্পষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে।
সুরা রোমের দুই থেকে চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “রোমকরা পরাজিত হয়েছে,নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর শিগগিরই বিজয়ী হবে,কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহর হাতেই। সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে।”
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোরআনের ওই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছিল।
কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর আরেকটি দৃষ্টান্ত সুরা কাওসার। বিশ্বনবী (সাঃ)’র পুত্র সন্তান মারা যাওয়ায় এবং তাঁর দ্বিতীয় কোনো জীবিত পুত্র সন্তান না থাকায় কোনো কোনো অজ্ঞ মুশরিকরা বলত, মুহাম্মাদ(সাঃ)-এর বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে লোকটি রাসূল (সাঃ)-কে “আবতার” বা বংশধরহীন বলে উল্লেখ করত পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাকেই “আবতার” বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেও হয়েছে তাই। লোকটির সন্তানাদি থাকা সত্ত্বেও দুই-তিন প্রজন্ম পরই তার বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ)’র পবিত্র বংশধারা তাঁর কন্যা হযরত ফাতেমা (সাঃ)’র মাধ্যমে অব্যাহত থাকে এবং তা আজো অব্যাহত রয়েছে। পবিত্র বৃক্ষের মত এর শাখা-প্রশাখা আজো প্রবর্ধমান।
মহান আল্লাহ সুরা কাওসারে বলেছেন, ” নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার (তথা ব্যাপক কল্যাণ ও বরকত) দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কোরবানী করুন। যে আপনার শত্রু, সেই তো লেজকাটা, নির্বংশ।”
১৯৮১ সালে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া মিতেরা মমি করে রাখা ফেরাউনের লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার জন্য তা ফ্রান্সে পাঠাতে মিশর সরকারের কাছে অনুরোধ করেন।
ফেরাউনের লাশবাহী বিমান যখন ফ্রান্সের মাটিতে অবতরণ করে তখন দেশটির সরকার প্রধান ও মন্ত্রী পরিষদসহ অনেক উচ্চ-পদস্থ ফরাসী কর্মকর্তা লাশটিকে সম্বর্ধনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। মনে হচ্ছিল যেন ফেরাউন এখনও জীবিত রয়েছেন এবং তিনিই ফ্রান্সের প্রকৃত শাসক।
অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের পর ফেরাউনের লাশ ফ্রান্সের একটি বিশেষ সংরক্ষণাগার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশটির সেরা শল্যবিদ বা সার্জন ও লাশ বা শরীর পরীক্ষার বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের সেখানে জড় করা হয়। ফেরাউনের মমিকৃত লাশ পরীক্ষা করা এবং এর অজানা রহস্যগুলো উদঘাটনই ছিল এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য।
ফেরাউনের লাশ সংক্রান্ত গবেষক টিমের প্রধান ছিলেন মরিস বুকাইলি। ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণ অন্য গবেষকদের উদ্দেশ্য হলেও বুকাইলি নিজে ফেরাউনের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে উদগ্রীব ছিলেন। সারা রাত ধরে তিনি গবেষণা চালান। কয়েক ঘণ্টা গবেষণার পর ফেরাউনের লাশে লবণের কিছু অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। ফলে স্পষ্ট হয় যে সাগরে ডুবেই ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার লাশ সাগর থেকে উঠিয়ে এনে মমি করা হয়। কিন্তু বুকাইলির বিস্ময়ের মাত্রা ব্যাপক হয়ে উঠেছিল একটি প্রশ্নকে ঘিরে- এ লাশ কিভাবে অন্য লাশগুলোর চেয়ে বেশি মাত্রায় সংরক্ষিত বা অক্ষত রয়েছে? বুকাইলি যখন ফেরাউনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন এবং তাতে এটা লেখেন যে ফেরাউন সাগরে ডুবেই মারা গেছে তখন উপস্থিত সঙ্গীদের মধ্যে একজন তাকে বললেন, এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশে তাড়াহুড়া না করাটাই ভাল হবে। কারণ, এ গবেষণার ফলাফল মুসলমানদের মতের পক্ষে যাচ্ছে। বুকাইলি তা নাকচ করে দেন। কারণ, তার মতে এমন ফলাফলে উপনীত হওয়া অসম্ভব। বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার অত্যন্ত উন্নত মানের বা নিঁখুত সাজ-সরঞ্জাম ও উন্নত কম্পিউটার ছাড়া এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে বুকাইলি মনে করতেন।
এরপর বুকাইলিকে বলা হল, মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে এসেছে ফেরাউন ডুবে মারা গেছে, মৃত্যুর পরও তার শরীর অক্ষত থেকে যায়। এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক বুকাইলি ভাবলেন, এটা কি মোটেও যৌক্তিক? কারণ, মুহাম্মাদ (সাঃ)’র যুগের আরব জাতি ও অন্যরা মিশরীয়দের মাধ্যমে ফেরাউনের লাশ মমি করার কথা জানত না।
মরিস বুকাইলি সারা রাত ফেরাউনের লাশের দিকে চোখ রেখে ভাবতে লাগলেন কিভাবে কোরআন ডুবে যাওয়া ফেরাউনের লাশ উদ্ধারের কথা জানল? অথচ খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল এই গল্প বর্ণনার সময় ফেরাউনের লাশ উদ্ধার সম্পর্কে কিছুই বলেনি। নিজেকে প্রশ্ন করলন, এটা কি সেই ফেরাউন যে হযরত মূসা (আঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য তার পেছনে ছুটেছিল? এখন থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তা জানতেন- এটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব?
অস্থির বুকাইলি সে রাতেই বাইবেল ও তৌরাত পড়া শুরু করেন। তৌরাতের একটি অধ্যায়ে তিনি পড়ছিলেন, ” “পানি ফিরে এসে ফেরাউনসহ তার পিছে পিছে আসা ঘোড়াগুলো ও তার সেনাদের সবাইকে গ্রাস করে। তাদের কেউই রক্ষা পায়নি।” এ অংশটুকু পড়ে বিস্মিত হলেন বুকাইলি।
কিছু দিন পর ফরাসী সরকার কাঁচের কফিনে করে ফেরাউনের মমি আবারও মিশরে ফেরত পাঠায়। কিন্তু বুকাইলির মাথা তখনও ফেরাউনের সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্য নিয়ে বিভোর ছিল। তিনি ফেরাউনের লাশ রক্ষা পাওয়া সংক্রান্ত কোরআনের বক্তব্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলো সফরের সিদ্ধান্ত নেন। ফরাসি সার্জন বুকাইলি সৌদি আরবে চিকিৎসা সংক্রান্ত এক সম্মেলনে “ডুবে-যাওয়া ফেরাউনের লাশ রক্ষা পাওয়া” সম্পর্কে গবেষণালব্ধ নতুন তথ্য উল্লেখ করেন। ওই সম্মেলনে মানব দেহ-বিশ্লেষক একদল মুসলিমও উপস্থিত ছিলেন। এ অবস্থায় সেখানে একজন মুসলমান পবিত্র কোরআন খুলে সুরা ইউনুসের ৯২ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করলেন, যেখানে বলা হয়েছে,
” ” অতএব আজকের দিনে রক্ষা করছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।”
বুকাইলি এ আয়াত শুনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমান হওয়ার কথা ও পবিত্র কোরআনের প্রতি বিশ্বাসী হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। কোরআনের সত্যতা এভাবে প্রকাশিত হতে দেখে অনেকের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু এবং হৃদয়গুলোয় বইল পরিবর্তনের ঝড়।
বুকাইলি বহু বছর ধরে তার গবেষণায় বিজ্ঞানের নতুন তথ্যগুলোর সাথে কোরআনের মিল-অমিল খুঁজতে গিয়ে একটি অমিলও পাননি। ফলে কোরআনে কোনো ভুল না থাকার ব্যাপারে তার ঈমান কেবলই দৃঢ়তর হয়েছে। তিনি এসব গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন “কোরআন, তাওরাত, বাইবেল ও বিজ্ঞান” শীর্ষক বইয়ে। ১৪০০ বছর আগেও কোরআন বিজ্ঞানের এত সূক্ষ্ম দিক এত নির্ভুল বা নিখুঁতভাবে তুলে ধরায় তার অশেষ বিস্ময় বিধৃত হয়েছে এ বইয়ে। ফলে তা পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মধ্যেও বিস্ময়ের ঝড় তুলেছে। বহু ভাষায় অনুদিত বইটি বেশ ক’বার ছাপাতে হয়েছে। অনেক অমুসলিম এ বই পড়ে মুসলমান হয়েছেন।
ফেরাউন সংক্রান্ত গবেষণার সাথে কোরআনের দেয়া তথ্যের মিল পেয়ে বুকাইলি উচ্চারণ করেছিলেন কোরআনের এ আয়াত: ” এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরীত্য বা ভুল দেখতে পেত।” (নিসা-৮২) #
সতের.
পবিত্র কোরআন নাজেল হওয়ার পর থেকে সব যুগের মানুষকে হেদায়াত বা সুপথ তথা সৌভাগ্যের পথ দেখিয়ে আসছে। আল্লাহর পরিচয়, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান, সৃষ্টি জগত, বিচার দিবস বা পুনরুত্থান দিবস, অতীতের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস, নৈতিকতা, পারিবারিক আইন, রাষ্ট্রীয় আইন, সামাজিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক বিধানসহ পবিত্র কোরআনে সব ধরনে জরুরি বিধান ও জ্ঞানের বিষয় আলোচিত হয়েছে। এসব বিষয়ে কোরআনের তথ্য, বিধান ও বক্তব্য সব যুগের জন্যই প্রযোজ্য এবং চিরনতুন। কোরআনের বিধান ও শিক্ষায় সামান্যতম বিকৃতি ঘটেনি।
মানুষের জ্ঞান যে একদিন আমাদের সৌরজগতের বাইরেও লক্ষ কোটি গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে গঠিত সুদূর ছায়াপথ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং তারা নিজ অস্তিত্বের গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো উপলব্ধি করবে, পবিত্র কোরআন সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল ১৪০০ বছর আগে। সুরা ফুসিলাতের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “শিগগিরই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাগুলো দেখাব পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে,ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে,আল্লাহ বা কোরআন সত্য। …”
কানাডিয় পাদ্রী ও গণিতের অধ্যাপক গ্যারি মিলার পবিত্র কোরআনের ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করে ইসলামকে হেয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গভীর মনোযোগ দিয়ে কোরআন অধ্যয়ন ও এ মহাগ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মিলার এ মহাগ্রন্থকে “সবচেয়ে বিস্ময়কর গ্রন্থ” বলে উল্লেখ করেন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। একদিন কানাডায় তার এক পুরনো বন্ধু তাকে বলেন যে, “তুমি কি নিশ্চিত যে, কোরআনের প্রতি ঈমান এনে সঠিক পথই ধরেছ?” উত্তরে মিলার বললেন, “১৪০০ বছর আগে অজ্ঞ লোকরা এ দাবি করত যে কোরআন একদল শয়তানের বক্তব্য ও যাদুর প্রভাব। আমার বন্ধুর অবস্থান তাদের মতই। মহান আল্লাহ তাদের এসব অপবাদের জবাবে সুরা শোয়ারায় বলেছেন,
‘এই কোরআন জিন বা শয়তানরা অবতীর্ণ করেনি। তারা এ কাজের উপযুক্ত নয় এবং তারা এর সামর্থ্যও রাখে না, তাদেরকে তো (আকাশে সংবাদ) শোনার জায়গা থেকে দূরে রাখা রয়েছে।’ “(২১০-১২)
মিলার আরো বলেছেন, “কোরআনকে জানার পর এটা বুঝতে পেরেছি যে, কোনো মানুষই এমন একটি গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম নয়। বরং কোরআন যে মহান আল্লাহরই বাণী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বইয়ে সব ধরণের সন্দেহের যৌক্তিক জবাব দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থ মহানবী (সা:)’র খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক নিদর্শন বা মোজেজা।”
কোরআন অদৃশ্যের ও অতীতের অনেক খবর দিয়েছে। বিগত অনুষ্ঠানেও আমরা কোরআনের সফল ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আলোচনা করেছি। মহান আল্লাহ সুরা হুদের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“এসব অদৃশ্যের খবর যা আমি আপনার কাছে ওহী হিসেবে নাজেল করেছি। ইতিপূর্বে এটা আপনার এবং আপনার জাতির জানা ছিল না।”
গ্যারি মিলার কোরআনের এ পদ্ধতিকে নজিরবিহীন বলে মনে করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, «আসলে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থই এভাবে কথা বলেনি। কোরআনে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা অতীত সম্পর্কিত অথবা ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু বাইবেলে কোনো ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে এ গ্রন্থ তা জানাতে সক্ষম নয়, এ ব্যাপারে গ্রন্থটি অন্য উৎসের কাছে যেতে বলে। কোরানের কোনো আয়াত সম্পর্কে যাদের মনে কোনো সন্দেহ রয়েছে এ মহাগ্রন্থ তাদেরকে কোরআন নিয়ে আরো বেশি চিন্তাভাবনার আহ্বান জানায়। কোরআনে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো কেউই অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, মানুষের জ্ঞান থেকে এসব তথ্য দেয়া হয়নি, বরং আল্লাহই এসব তথ্য দিয়েছেন এবং তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত। মহান আল্লাহ সুরা আলে ইমরানের ৪৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“এ হলো গায়েবী সংবাদ, যা আমি আপনাকে পাঠিয়ে থাকি। আর আপনি তো তাদের কাছে ছিলেন না, যখন পানিতে কলম নিক্ষেপ করে তারা প্রতিযোগিতা করছিল যে, কে প্রতিপালন করবে মারইয়ামকে এবং আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন তারা ঝগড়া করছিলো।”»
মহান আল্লাহ কোরআনের মাধ্যমে অদৃশ্যের খবর রাসূল (সা:)-কে জানিয়ে দিয়ে মুনাফিক ও তাদের সহযোগী, মুশরিক ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র উন্মোচিত করে তাদেরকে কলঙ্কিত করেছেন।
পবিত্র কোরআন নিকট ও দূর ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। ইসলামের নানা বিজয় ও বিস্তার এবং শত্রুদের একের পর এক পরাজয় ও নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল হওয়া সম্পর্কেও সুসংবাদ দিয়েছে এ মহাগ্রন্থ। যেমন, সুরা আনফালের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আর যখন আল্লাহ দুটি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে, আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোন রকম কণ্টক নেই তথা সেই নিরস্ত্র দলটি তোমাদের ভাগে আসুক; অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে, যাতে করে সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন,যদিও পাপীরা অসন্তুষ্ট হয়।”"
উল্লেখ্য এ আয়াত বদর যুদ্ধের আগে নাজেল হয়েছিল। এ সময় কাফেরদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং অস্ত্র ও অর্থ-সম্পদও ছিল নগণ্য। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে মাত্র দুজন সেনা ছিলেন অশ্বারোহী। কাফেরদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক এবং তারা বিপুল অস্ত্র, সম্পদ ও সাজ-সরঞ্জামের অধিকারী ছিল।
অথচ এ সময়ই কোরআন কাফেরদের নির্মূল হওয়ার খোদায়ী প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছে এবং কোরআনের ওয়াদা অনুযায়ী মুসলমানরাই কাফেরদের ওপর বিজয়ী হয়েছে।
আবু লাহাব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ভবিষ্যদ্বাণীও গ্যারি মিলারকে বিস্মিত করেছে। আবু লাহাব ছিল ইসলামের ঘোর শত্রু। সে সব সময় রাসূল (সা.)’র পিছে লেগে থাকত। রাসূল (সা.) যেখানেই ধর্মের দাওয়াত দিতেন সেখানেই আবু লাহাব মানুষকে বিপরীত কথা বলত। সে জনগণকে বলত, মুহাম্মাদ(সা.) যদি তোমাদের বলেন যে এটা সাদা, তোমরা জেনে রাখবে যে তা অবশ্যই কালো, সে যদি বলে রাত তবে তোমরা জানবে যে তা অবশ্যই দিন।
রাসূল (সা.)’র চাচা আবু লাহাবের মৃত্যুর দশ বছর আগেই পবিত্র কোরআন ভবিষ্যদ্বানী করেছিল যে আবু লাহাব আগুনে পতিত হবে এবং কাফের হিসেবেই মারা যাবে। সুরা “মাসাদ”-এ বলা হয়েছে: “আবু লাহাবের হাত দুটি ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে, কোন কাজে আসেনি তার ধন-সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। শিগগিরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও-যে ইন্ধন বহন করে,তার গলদেশে খর্জুরের রশি নিয়ে।”
আবু লাহাব তার সম্পর্কিত এ সুরা শোনার পর মুসলমান হওয়ার দাবি করে জনগণের সামনে রাসূল (সা.)কে বলে যে, “মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমি কি জাহান্নামে যাব? এ কেমন ওহী তুমি আনছ?”
কিন্তু ইতিহাস বলে আবু লাহাব মুসলমান হবে বলে কথা দিয়েও কখনও মুসলমান হয়নি। সে নবী(স.) ও ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা অব্যাহত রেখেছিল এবং কাফের অবস্থায় মারা যায়। সুরা “মাসাদ”-এর ওপর আস্থা রেখে রাসূল (সা.) আবু লাহাবের হুমকিগুলো মোকাবেলা করতেন দৃঢ়চিত্তে।
পবিত্র কোরআনের সুরা আম্বিয়ার ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব,যেমন গুটানো হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম,সেভাবে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেব সৃষ্টিকে। আমার ওয়াদা নিশ্চিত,আমি তা অবশ্যই পূর্ণ করব। ”
আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরাও বলছেন, বিশ্বজগত যেভাবে সব সময়ই প্রসারিত হয়েছে, তেমনি এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা আবারও সংকীর্ণ হবে ও ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষ কিছু উপকরণের সীমাবদ্ধতা ও বিদ্যমান উপকরণের কারণে বিশ্ব আরও সম্প্রসারিত বা বিস্তৃত হতে সক্ষম নয়।
মহান আল্লাহ বিশ্বের মহাপ্রলয় বা ধ্বংসের দিন ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আর কেউই এর দিন-ক্ষণ সম্পর্কে জানেন না।
ডক্টর গ্যারি মিলার মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনারা কোরআনের সৌন্দর্য নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করুন। আমি এমন সময় কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছি যখন পাশ্চাত্যে খুব কম লোকই কোরআন নিয়ে ভাবত।
আমি আপনাদের সুরা আনকাবুতের ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াত নিয়ে ভাবতে বলছি। এ দুই আয়াতে বলা হয়েছে: “এটাকি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে,আমি আপনার কাছে কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে সব সময় পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে। বলুন,আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহই সাক্ষীরূপে যথেষ্ট। তিনি জানেন যা কিছু নভোমণ্ডলে ও ভূ-মণ্ডলে আছে। আর যারা মিথ্যায় বিশ্বাস করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে,তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” #
আঠারো.
পবিত্র কোরআন গোটা মানব জাতিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছে যে, সারা বিশ্বের সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সাধনার বলেও কোরআনের বক্তব্যের মত বক্তব্য উপস্থাপন অসম্ভব। মুফাসসিরদের মতে, এর কারণ, হল কোরআন অদৃশ্যের জ্ঞান তুলে ধরেছে যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আল কোরআনের এ চ্যালেঞ্জও এ মহাগ্রন্থের অন্যতম মোজেজা বা অলৌকিকতা।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে পবিত্র কোরআনের মত সংকলন রচনার জন্য বিশ্বনবী(সা.)’র শত্রুরা বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই আরবী সাহিত্য, বাগ্মীতা ও কবিতা বা অলংকারিক ভাষা ব্যবহারে সুদক্ষ ছিল। কাব্য ও সাহিত্যে পারদর্শিতা নিয়ে এবং গোত্রীয় রীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের মধ্যে গর্ব আর অহংকার প্রকাশের প্রতিযোগিতা হত। কিন্তু পবিত্র কোরআন তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, মূর্তিপূজা ও প্রথাগুলোকে কুসংস্কার এবং অজ্ঞতাসুলভ বলে নিন্দা জানায়। এসব বিষয় নিয়ে তাদের গর্ব ও অহংকারেরও কঠোর নিন্দা জানিয়েছে এ মহাগ্রন্থ। একইসাথে কোরআন তাদেরকে এ মহাগ্রন্থের অনুরূপ রচনার চ্যালেঞ্জও জানিয়েছে।
মক্কার মুশরিকরা কোরআনকে মোকাবেলার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়। প্রথমেই তারা পবিত্র কাবা ঘরে বিশ্বনবী(সা.)-কে কোরআন তেলাওয়াত করা থেকে বিরত রাখার জন্য পদক্ষেপ নেয়। যে মুহাম্মাদ (সা.) যদি কাবা ঘরের পাশে ও মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ পড়া অব্যাহত রাখেন তাহলে তাঁর গর্দান গুড়িয়ে দেয়া হবে বলে আবু জাহেল হুমকি দেয় । অবশ্য মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে কাফেরদের আঘাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কোনো কোনো মুশরিক জনগণকে এ পরামর্শ দেয় যে, তারা যেন কোরআনের তেলাওয়াত না শোনে, অথবা এমন হৈ-চৈ করে যাতে কোরআনের মধুর শব্দ মানুষ শুনতে না পারে। কিন্তু মহান আল্লাহ কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ পড়া অব্যাহত রাখতে রাসূল (সা.)-কে নির্দেশ দেন।
বিশ্বনবী(সা.)’র অলৌকিক নিদর্শন কোরআন মক্কার জনগণকে প্রভাবিত করতে পারে এ আশঙ্কা করছিল মক্কার কাফের ও মুশরিকরা। মক্কার জনগণ প্রভাবিত হলে রাসূল (সা.)’র বিরোধিতার কোনো অজুহাত অবশিষ্ট থাকবে না বলে তারা শঙ্কিত ছিল। তাই তারা কোরআনকে স্রস্টার বা আল্লাহর বাণী বলে স্বীকার করত না যাতে জনগণের মধ্যে এর প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা না জাগে।
মক্কার কাফেররা বলত, কোরআন স্রস্টার বাণী নয়, বরং মানুষেরই বাণী এবং কোরআনের বাণীগুলো যাদু-মন্ত্র মাত্র। কোরআনের কোনো কোনো আয়াতের অংশ বিশেষকে দেখিয়ে মক্কার কাফের মুশরিরকদের কেউ কেউ বলত, এ মহাগ্রন্থ রূপকথার বই।
জাহেলি যুগের কোনো কোনো সাহিত্যিক জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য বলত যে, কোরআনের মত বাক্য রচনা কোনো কঠিন কাজ নয় এবং তারা কোরআনের সুরা ও আয়াতগুলোর মত সুরা ও আয়াত রচনা করতে সক্ষম।
ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন, অনেক কাফের-মুশরিক কোরআনের সুরা ও আয়াতগুলোর মত সুরা ও আয়াত রচনার চেষ্টা চালিয়েছেন। তারা ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানোর পর যা রচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা সেগুলোকে কোরআনের তুলনায় মূল্যহীন ও পরিহাসতুল্য বলে উল্লেখ করেছেন। নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামা কোরআনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে সুরা ফিলের অনুকরণে কিছু বাক্য রচনা করেছিলেন। সারবস্তুহীন ও অত্যন্ত হাল্কা চালের এসব বাক্যের মধ্যে ছিল না কোরআনের ধারে কাছে ঘেঁষার মত ভাষাশৈলী বা সৌন্দর্য। এসব ফন্দির জবাবে সুরা আনকাবুতে বলা হয়েছে, “তারা বলে, তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে তার প্রতি কিছু নিদর্শন অবতীর্ণ হল না কেন? বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আমি তো একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। এটাকি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে,আমি আপনার কাছে কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে সব সময় পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে। ” (৫১-৫২) আয়াতুল্লাহ তাবারসির মতে, এ আয়াতে উল্লেখিত “যথেষ্ট” শব্দ থেকে বোঝা যায়, কোরআন অলৌকিকতা হিসেবে যথেষ্ট ও শ্রেষ্ঠ মোজেজা এবং এ মোজেজার ফলে অন্য সব মোজেজার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তারপরও যদি কোরআনের ঐশী হওয়া বা এর অলৌকিকতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকে তাদের উদ্দেশ্যে সুরা আসরায় চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে: “বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ কিছু রচনার জন্যে একত্র হয়,এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়;তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ কিছু রচনা করে আনতে পারবে না।” (৮৮) কোরআনের অন্যত্র ওই চ্যালেঞ্জ কিছুটা সহজ করে দিয়ে বলা হয়েছে, “তারা কি বলে? কোরআন তুমি তৈরি করেছ? তুমি বল, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও, যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে।”(হুদ-১৩)
এরপর ওই চ্যালেঞ্জ আরো সহজ করে বলা হয়েছে,
“এ সম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার কাছে অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস। তোমাদের সব সাক্ষী বা সাহায্যকারীদেরও সঙ্গে নাও-এক আল্লাহকে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।” (বাকারা-২৩)
সভ্যতার ইতিহাসের ইতালিয় অধ্যাপক মিসেস লরা ওয়াকসিয়া ভাগলিরি লিখেছেন, ” কোরআনের অনুরূপ অন্তত: একটি সুরা রচনার যে চ্যালেঞ্জ মুহাম্মাদ(সা.) দিয়েছেন আরব দেশে মুশরিকদের মধ্যে অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক থাকা সত্ত্বেও তারা কোরআনের সাথে তুলনা করার মত একটি বাক্যও রচনা করতে সক্ষম হয়নি। বরং তারা সশস্ত্র হয়ে মুহাম্মাদ(সা.) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু তারা কোরআনের মহত্ত্ব ও বিশালত্বের কাছে অক্ষমই থেকেছে। কারণ, এ মহাগ্রন্থের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ছাড়াও বাহ্যিক সৌন্দর্য ও ভাষাশৈলীও অসাধারণ। কোরআনের উচ্চাঙ্গের চেতনা ও ভাবার্থ নকল করা সম্ভব নয়।”
মিসেস লরা আরো বলেছেন, ” আমরা কোরআনের মধ্যে এমন সব জ্ঞান দেখি যা মানবীয় প্রতিভা ও যোগ্যতার আয়ত্তাধীন নয়। পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকরাও এ ধরণের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত নন। যাঁর জ্ঞান সমস্ত আকাশ ও জমিন বেষ্টন করে আছে কেবল সেই মহান আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব কোরআন রচনা করা”।
অতীত যুগের মত সমসাময়িক বা বর্তমান যুগেও অনেকে কোরআনের অনুরূপ গ্রন্থ রচনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউই এখনও সফল হননি। সম্প্রতি “আমেরিকা অন লাইন” নামের একটি কোম্পানি কোরআনের কিছু আয়াতের রীতি বা স্টাইল অনুসরণ করে কিছু ভুল ও বিকৃত ধারণাযুক্ত সুরা রচনা করেছে। ইন্টারনেটে প্রকাশিত এসব খুবই সারবস্তুহীন, দুর্বল ও হাস্যকর। মিশরের আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও একদল মুসলিম লেখকসহ বিশ্বের মুসলিম সমাজ এই অশুভ তৎপরতার নিন্দা জানিয়েছে। ব্রিটেনের একটি সাইটও অনুরূপ পদক্ষেপ নিয়ে কিছু জাল সুরা রচনার করেছে। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম বিশেষজ্ঞরাই সেগুলোকে কোরআনের যৌক্তিক বাণীর মোকাবেলায় হাস্যকর বলে উল্লেখ করেছেন। কোরআন সম্পর্কে যার খুব সামান্য জ্ঞান আছে তারাও এটা বুঝবেন যে এসব বাক্য কোরআনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম নয়।
এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে প্রকৃত কোরআন বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমানের কাছে অবিকৃত অবস্থায় সুরক্ষিত রয়েছে। বিশ্বনবী(সা.)’র কাছে শেষ ঐশী গ্রন্থ হিসেবে ২৩ বছরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছিল এই চিরন্তন মোজেজা।
কোরআনের মোজেজা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “কোরআন এমন একটি সুদৃঢ় ও অবিচ্ছিন্ন রশি যার এক প্রান্ত রয়েছে মহান আল্লাহর হাতে এবং অন্য প্রান্ত রয়েছে মানুষের হাতে। আল্লাহর এ রশি আঁকড়ে ধরার মধ্যে রয়েছে মানুষের ইহকালীন ও পারলৌকিক সৌভাগ্য।” #
উনিশ.
পবিত্র কোরআনে রয়েছে ১১৪টি সুরা। সবচেয়ে দীর্ঘ সুরা “আল-বাকারা”-য় রয়েছে ২৮৬ বাক্য বা আয়াত। কোরআনের সবচেয়ে ছোট সুরা”আল কাওসার”-এ রয়েছে মাত্র তিনআয়াত। কোরআনের ১১৪ টি সুরার মধ্যে ৮৬টি সুরা নাজেল হয়েছে মক্কায়। দীর্ঘ ১৩ বছরে নাজেল হয়েছে এসব সুরা। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের সামাজিক কাঠামো ছিল গোত্র-ভিত্তিক। গোত্র-প্রধানের কথাই ছিল সেখানকার আইন। গোত্রীয় চুক্তিগুলোই ছিল ব্যক্তির ও সমাজের নানা অধিকার রক্ষার মাধ্যম। গোত্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ ও রক্তপাত লেগেই থাকত। চিন্তাগত দিক থেকে আরবরা ছিল বহুত্ববাদী বা মুশরিক। তারা কল্পিত নানা দেব-দেবীর পূজা করত। অবশ্য একত্ববাদে বিশ্বাসী অল্প সংখ্যক একদল আরব “হুনাফা” নামে খ্যাত ছিলেন। সে যুগে ইহুদিদের কয়েকটি গোত্র আরবের মদীনায় বসবাস করত এবং কিছু খ্রিস্টান বসবাস করত সিরিয়া ও ইয়েমেনে।
ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব ভূখণ্ডে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছিল। সমাজের অর্ধেক অংশ নারীর কোনো সম্মান ছিল না। নবজাতক কণ্যাদের জীবন্ত কবর দেয়া হত অথবা চরম অবহেলায় তাদেরকে লালন-পালন করা হত। চুরি, লুণ্ঠণ, ব্যাভিচার, শ্লীলতাহানি, সংঘাত, রক্তপাত ও চুক্তি লঙ্ঘন ছিল ব্যাপক প্রচলিত ঘটনা। বেশীরভাগ আরবই ছিল অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। কোরআনেও এসেছে,তৎকালীন আরব সমাজ ছিল পশ্চাদপদ, অধঃপতিত ও অজ্ঞ। অবশ্য আরবদের মধ্যে কবিতা ও বাগ্মীতার ব্যাপক বিকাশঘটেছিল। বেশিরভাগ কবিতারই বিষয় ছিল গোত্রীয় গুণকীর্তণ। বংশের মর্যাদা সম্পর্কেঅতিরঞ্জণ, বড়াই ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ছিল এসব কবিতার প্রধান বিষয়।
মক্কী সুরাগুলো সাধারণত ছোট। ছোট ছোট বাক্যের এসব সুরায় মুশরিকদের বহু খোদা ও তাদের অংশীবাদী বিশ্বাস এবং যেসব যুক্তি দেখিয়ে তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর উপাসনা করত সেসব যুক্তির অসারতা তুলে ধরা হয়েছে।এ ছাড়াও এ সুরাগুলোমুশরিকদের নানা সন্দেহ ও প্রশ্নের জবাব দিয়েছে এবং তারা নিজেদের মনমত বিভিন্ন মোজেজা দেখাতে রাসূল (সা.)’র কাছে যেসব দাবি জানাত অযৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। মাক্কী সুরাগুলোর ছন্দ, শব্দের ধ্বনি-মাধুর্য ও গদ্য অত্যন্ত উচ্চ মানের। একত্ববাদ, পরকালের জীবন ও অস্তিত্বের জগত বা সৃষ্টিতত্ত্ব এসব সুরার বিষয়বস্তু।
কোরআন নাজেল হওয়ার পর এর তেলাওয়াত রাসূল (সা.)’র নিয়মিত কর্মসূচীতে পরিণত হয়। তিনি নিজ নামাজে এবং বিশেষ করে নৈশ এবাদতে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এই তেলাওয়াত তাঁর আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করত এবং বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট মোকাবেলার জন্য তাঁকে প্রস্তুত করত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোরআনের বক্তব্যগুলো তুলে ধরার জন্য পবিত্র কাবা ঘরের পাশে বসতেন এবং নামাজে দাঁড়িয়ে অথবা নামাজের বাইরে খুবই মধুর সুরে এ মহাগ্রন্থের সুরাগুলো তেলাওয়াত করতেন। এভাবে কোরআনের আয়াত সবার কানে পৌঁছত। কোরআনের অমিয় বাণী মুশরিকদের চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও এরপ্রবল আকর্ষণ বহু মানুষকেবাণীগুলো শুনতেকাছে টানত এবং তারা সুযোগ পেলেই কোরআনের হৃদয়-স্পর্শী বাণীর ধারায় প্রাণ জুড়াতেচাইত।
বিশ্বনবী (সা.)’র এ ধরণের পদক্ষেপের ফলে মক্কার অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ওসমান বিন মাযউন, যমাদ বিন সাআলবাহ, আদাস এবং উৎবার গোলাম ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম। শুধু মূর্তি পূজারী নয়, আহলে কিতাবদেরও কেউ কেউ পবিত্র কোরআনের প্রভাবে মুসলমান হয়েছিল। খ্রিস্টানদের অনেকেরই চোখ পবিত্র কোরআনের আয়াত শোনার পর অশ্রু-সজল হয়ে পড়ত। সুরা মায়েদার ৮২ ও ৮৩ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“আপনি সব মানুষের চেয়ে ইহুদী ও মুশরেকদেরকে মুসলমানদের বেশি শত্রুতায় লিপ্ত পাবেন এবং আপনি সবার চেয়ে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বে বেশিকাছে তাদেরকে পাবেন, যারা নিজেদেরখ্রিস্টান বলে। এর কারণ,তাদের মধ্যে আলেম রয়েছে, দরবেশ রয়েছে এবং তারা অহঙ্কার করে না।
আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; কেননা, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলেঃ হে আমাদের প্রতি পালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। তাই, আমাদেরকেও মান্যকারীদের অন্তর্ভুক্তকরুন।”
এ অবস্থায় মহানবী (সা.)কেপ্রকাশ্যে কোরআন তেলাওয়াত এবং ইসলামের দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত রাখতে মুশরিকরা নানা প্রলোভন ও হুমকির আশ্রয় নেয়। কিন্তু এতে কোনো ফল হয়নি, বরং তারা কোনো না কোনোভাবে পবিত্র কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বা ঐশী অলৌকিকতাকে স্বীকার করেছে। মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে আসাকার লিখেছেন: “একদিন নেতৃস্থানীয় কুরাইশরা মসজিদুল হারামে রাসূল-সা.’র কাছে আসে। তাদের মধ্যে ওতবা ইবনে রবিয়া অন্য কুরাইশদের বলল, আমাকেই মুহাম্মদেরসা. সাথে কথা বলতে দাও, কারণ তার সঙ্গে আমার আচরণ তোমাদের চেয়ে বেশী নম্র। কুরাইশদের সম্মতি নিয়ে সে মুহাম্মাদ (সা.)’র কাছে এসে তাঁকে বলল, হে আমার ভাতিজা, বংশ ও উচ্চ অবস্থানের দিক থেকে তুমি আমাদের সবার চেয়ে বেশি যোগ্য, কিন্তু তুমি এমন কিছু দাবি করছ যা অতীতে আমাদের জাতি ও তোমার নিজ গোত্রও কখনও করেনি। তুমি যদি অর্থ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে এত বেশি অর্থ-সম্পদ দেব যে তুমিই হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী, যদি নেতৃত্বের প্রত্যাশী হয়ে থাক তাহলে তোমাকে শীর্ষ নেতৃত্ব দেয়া হবে এবং তোমার সাথে পরামর্শ না করে কেউ কোনো কাজ করবে না।”
বিশ্বনবী (সা.) ওতবার কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন,” তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বলল,” হ্যা”। এ অবস্থায় মহানবী(সা.) সুরা ফুসিলাতের আয়াত তেলাওয়াত শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে সিজদার আয়াত থাকায় সিজদায় গেলেন। সিজদায় গিয়ে তিনি মহান আল্লাহ’র প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। ওতবা মাথার পেছনে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিল। ওতবার দিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়েই রাসূল(সা.) সিজদা থেকে উঠলেন। হতবাক ওতবা সেখান থেকে কুরাইশদের কাছে ফিরে এসে বলল, “তোমরা আমাকে যে কথা বলতে বলেছিলে তা আমি মুহাম্মদ সা. -কে বলেছি, কিন্তু সে এমন কিছু কথা উচ্চারণ করল যে, আল্লাহর শপথ, সেগুলো আমার কান কখনও শোনেনি, তাই আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তাকে কি জবাব দেব। কুরাইশরা আমার এ কথা শোন! তোমরা এ ব্যক্তিকে তার নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও। কারণ, সে তার বিশ্বাস থেকে ফিরবে না। তাকে আরবদের মধ্যে একাকী থাকতে দেয়াই ভাল হবে। কারণ, সে যদি আরব গোত্রগুলোর ওপর বিজয়ী হয়, তাহলে তার মর্যাদা, সম্মান ও গৌরব বা নেতৃত্ব হবে তোমাদেরই সম্মান, গৌরব ও নেতৃত্বের শামিল। কিন্তু আরবরা যদি তার ওপর জয়ী হয় তাহলে তোমরা যেন মুহাম্মাদকেসা. অন্যদের হাত দিয়ে নিজেদের পথ থেকেই সরিয়ে দিলে।”
কুরাইশ নেতারা অবাক হয়ে ওতবার দিকে তাকিয়ে বলল, ” হে ওতবা! তুমিও কি মুহাম্মাদেরসা.প্রেমিক হয়ে গেলে?” #
কুড়ি.
পবিত্র কোরআনের মুফাসসির সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন, “একবার আমি ও আমার একদল বন্ধু মিশরের একটি জাহাজে চড়ে আটলান্টিক সাগর দিয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলাম। জাহাজটিতে ছিল ১২০ জন নারী ও পুরুষ। ১২০ জনের মধ্যে আমরা মাত্র ছয় জন ছিলাম মুসলমান। একজন খ্রিস্টান মিশনারী কর্মকর্তাও আমাদের সাথে ছিলেন। এ ধর্ম প্রচারের কাজে জড়িত ছিলেন তিনি এবং আমাদের কাছেও খ্রিস্ট ধর্মের দাওয়াত দেয়ার ইচ্ছে ছিল তার।শুক্রবার আমার মাথায় জুমার নামাজ আদায়ের চিন্তা আসল।
আমি সাগরের বুকে জাহাজের পাটাতনে জুমার জামায়াত আদায় করার উদ্যোগ নিলাম। নামাজ শুরু করার পর চারদিক থেকে অমুসলিম যাত্রীরা আমাদের নামাজ দেখার জন্য সবিস্ময়ে ভীড় জমায়। তাদের কেউ কেউ সন্তুষ্টিসূচক মন্তব্য করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইউগোস্লাভিয়ার একজন মহিলা।” তিনি বললেন: ” আমি আপনাদের এবাদতের কথাগুলোর অর্থ না বুঝলেও এসব কথার মধ্যে এমন কিছু বাক্য শুনতে পেয়েছি যেগুলোর সুর ছিল ভিন্ন ধরণের এবং সেগুলো এত অপূর্ব ও হৃদয়-স্পর্শী ছিল যে আমার শরীর কেঁপে উঠেছে। আমার মনে হয় আপনাদের নামাজের জামায়াতের ইমাম যখন ওই বাক্যগুলো উচ্চারণ করছিলেন তখন তার পুরো সত্তা বা আপাদমস্তক খোদার প্রেমে নিমজ্জিত ছিল! ”
সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন,”ওই মহিলা আসলে নামাজে পঠিত সুরার কথাই বলেছেন, যা আমি পড়েছিলাম। কোরআন তেলাওয়াতের অশেষ আকর্ষণে ভরা ও হৃদয়-নিংড়ানো বিশেষ সুর এমনই যে ওই মহিলাকোনো একটি শব্দেরও অর্থ না বোঝা সত্ত্বেও এত ব্যাপক মাত্রায় অভিভুত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন!”
কোরআনের ১১৪ টি সুরার মধ্যে ৮৬টি সুরা নাজেল হয়েছে মক্কায়। দীর্ঘ ১৩ বছরে নাজেল হওয়া এসব সুরা সাধারণত ছোট এবং বাক্যগুলোও ছোট ছোট । এসব সুরামুখস্ত করার জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর সাহাবারা। বিশ্বনবী (সা.)চেয়েছিলেন, কোরআনের বাণীগুলো মুখস্ত করার পর পরই মানুষের কাছে তুলে ধরবেন যাতে মানুষ এ মহাগ্রন্থের শিক্ষাগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করে। সর্বশেষ রাসূল হিসেবে মানুষকে মহান আল্লাহর বাণী বা কিতাব ও প্রজ্ঞা শেখানো ছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র দায়িত্ব। তাই তিনি কোরআন হেফজ বা মুখস্ত করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব ও সচেষ্ট থাকতেন।
অত্যন্ত কঠিন সময়েও মহান আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.) কোরআনের আয়াত আবৃত্তি করতেন। ঐশী আয়াতগুলো ভালভাবে রপ্ত করার জন্য তাঁর উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না, কারণ, কখনও কোনো আয়াতের শব্দ তিনি ভুলে যান কিনা, কিংবা ভুলক্রমে শব্দকে বদলে ফেলেন কিনা- এ আশঙ্কা তাঁকে বিচলিত করছিল। এ সময় মহান আল্লাহ তাঁকে এ নিশ্চয়তা দিলেন যে, কোরআন তাঁর স্মৃতিতে অম্লান ও অক্ষয় হয়ে থাকবে এবং আল্লাহই তা রক্ষা করবেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম বন্ধুর জন্য কোরআনের শব্দগুলোর উচ্চারণ ও অর্থও সহজ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পবিত্র কোরআনের সুরা কিয়ামতের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্যে আপনি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করবেন না।এর সংরক্ষণ ও পঠন আমারই দায়িত্ব। ”
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র ঘনিষ্ঠ আপনজন উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সা.) ও আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র মত ব্যক্তিত্ব এবং আরো একদল ব্যক্তি পবিত্র কোরআনের গভীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে তাঁরাও পবিত্র কোরআন মুখস্ত করতেন। এর ফলে মহানবী (সা.)’র সাহাবাদের মধ্যে নৈতিক ও মানবীয় নানা গুণ বিকশিত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে পবিত্র কোরআনের কয়েক হাজার ক্বারী ও হাফেজ গড়ে উঠেন। সে যুগে মানুষের কাছে লেখার সামগ্রী তেমন একটা ছিল না এবং লেখকদের সংখ্যাও ছিল খুবই কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) কোরআন লিপিবদ্ধ করতে উৎসাহ দিতেন। তিনি নিজে কোন কিছু লিখতে ও পড়তে জানতেন না বলে কোরআনের বাণী লেখাসহ আরো অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ করার জন্য লেখক দরকার হত। তাই বিশ্বনবী (সা.) প্রথমে মক্কায় ও পরে মদীনায় সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের লেখক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
মক্কায় সবার আগে ওহী লিখে রাখার দায়িত্ব পেয়েছিলেন আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)। বিশ্বনবী (সা.)’র জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলী (আ.) এ দায়িত্ব অব্যাহত রেখেছিলেন। আলী (আ.) যেন নাজেল-হওয়া সব আয়াত লিখে রাখেন সে জন্য মহানবী (সা.) ব্যাপক জোর দিতেন। কোরআনের একটি শব্দও যেন অলিখিত না থাকে সে জন্যে তিনি সতর্ক করতেন।
আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) নিজ খেলাফতের যুগে কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে বলেছিলেন, “আমি জীবিত থাকতেই তোমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তরআমার কাছ থেকে জেনে নাও। মহান আল্লাহর কোরআন সম্পর্কে তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন কর। আল্লাহর শপথ, কোরআনের এমন কোনো আয়াত নাজেল হয়নি, যা প্রিয় নবী (সা.)আমাকে আবৃত্তি করে শোনাননি এবং ওই আয়াতের তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাকে শেখাননি।”
এক ব্যক্তি আমীরুল মুমিনিনকে প্রশ্ন করলেন, ” আপনার অনুপস্থিতিতে যখন কোনো আয়াত নাজেল হত তখন কি হত?”আলী (আ.) বললেন, “(এমনটি ঘটলে) যখন রাসূল (সা.)’র কাছে যেতাম তিনি বলতেন, তোমার অনুপস্থিতিতে কিছু আয়াত নাজেল হয়েছে। এরপর তিনি সেসব আয়াত আবৃত্তি করে আমাকে শোনাতেন এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাকে শিখিয়ে দিতেন।”
বিশ্বনবী (সা.)’র জীবিত থাকাকালীন সময়ে কোরআন ঠিক যে ধারাক্রমে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজেল হয়েছিল হুবহু সেই ধারাক্রম বজায় রেখে লিপিবদ্ধ বা সংকলিত করা হত। অবশ্য আয়াতগুলো লেখা হয়েছিল পৃথক নানা মাধ্যমে। যেমন, কাগজে, হাঁড়ে, খেজুর গাছের চামড়ায় বা বাকলে। প্রত্যেক সুরা শুরু হত ” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” শীর্ষক আয়াত দিয়ে। এ আয়াতের অর্থ “শুরুকরছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।”নাজেল হওয়ার ধারাক্রম অনুযায়ী আয়াতগুলো সুরার অন্তর্ভূক্ত হত। সুরাগুলোর মধ্যে আয়াত অন্তর্ভুক্ত করা হত খোদ বিশ্বনবী (সা.)’র নির্দেশে।
অবশ্য ওহী নাজেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুরাগুলোর ক্রমধারা নির্ধারণ করা হয়নি। এর কারণ, বিশ্বনবী (সা.)’র জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যে কোনো সময়ে নতুন সুরা বা আয়াত নাজেল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বেশিরভাগ লেখক ও গবেষকের মতে, কোরআনের সুরাগুলোর একত্রীকরণ ও ধারাক্রম সাজানো হয়েছে মহানবী (সা.)’র ওফাতের পর সাহাবীদের মাধ্যমে। এ কাজে নিয়োজিত সাহাবীদের মধ্যে আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ছিলেন সবার শীর্ষে বা নেতৃত্বে। অবশ্য কোনো কোনো সূত্রকোরআনের সুরাগুলোর একত্রীকরণ ও ধারাক্রম সাজানোর কাজেহযরত আলী (আ.)’ র অবিরাম প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী কোরআনের শিক্ষা উপলব্ধির আলোকোজ্জ্বল নানা দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পর অন্য সব কাজের আগে কোরআনের সুরাগুলোর একত্রীকরণ, সংকলন ও তাফসির লেখার কাজেই মশগুল ছিলেন আলী (আ.) এবং৬ মাস পর তা সম্পন্ন হয়। ইবনে নাদিম লিখেছেন, সর্বপ্রথম সংকলিত সহিফা আলী(আ.)’র সহিফা। মুহাম্মাদ বিন সিইরিন আকরামা থেকে বর্ণণা করেছেন, ” প্রথম খলিফার খেলাফতের প্রথম দিকে আলী (আ.) নিজ ঘরে থাকতেন এবং তিনি কোরআণের বাণীগুলো একত্র বা সংকলন করেন।
*বি.দ্র.
*বি.দ্রপ্রথম খলিফা তার শাসনামলে পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তিনি হাফেজদেরকে স্মৃতি থেকে ও ওহী লেখকদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর লেখা কোরআনের অংশগুলো একত্রিত করতে বলেন। কোরআনের বিভিন্ন অংশ একত্রিত করার কাজে হযরত জায়েদ বিন সাবেত ভূমিকা রেখেছিলেন।
তৃতীয় খলিফার শাসনামলে ব্যাপক বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বের নানা স্থানে কোরআনের উচ্চারণে পার্থক্য দেখা দেয় এবং সে সময় কোরআনের লিখিত কপিগুলোও নানা দিক থেকে দূর্বল ছিল। ফলে ২৫ হিজরীতে কোরআনের উচ্চারণ-রীতি বা আবৃত্তি নিয়ে ক্বারী ও কোরআনের শিক্ষকদের মধ্যে মতভেদ বেড়ে যায়। কেউ কেউ অন্য এক দলের কোরআন তেলাওয়াত বা আবৃত্তিকে বিকৃত উচ্চারণ বলে ঘোষণা দেন। ফলে তৃতীয় খলিফা অভিন্ন আবৃত্তিতে কোরআন একত্রিত করার জন্য ওহী লেখকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। এরপর বিছিন্নভাবে লেখা কোরআনের অংশগুলো যা কখনও কাগজে, কখনও হাড়ে, গাছের বাকলে ও চামড়া ইত্যাদি মাধ্যমের ওপর লেখা ছিল- সেগুলো পুড়ে ফেলার নির্দেশ দেন যাতে মতভেদ ও দ্বন্দ্বের উৎস সমূলে বিলুপ্ত হয় এবং মুসলমানরা সবাই একই লিপি ও অভিন্ন উচ্চারণ-রীতির কোরআনের অধিকারী হয়। আল্লামা হিল্লির মতে তৃতীয় খলিফা নতুন সংকলিত এই কোরআন হযরত আলী (আ.) র মাধ্যমে স্বাক্ষরিত বা সত্যায়িত করিয়ে নিয়েছিলেন।
কোরআনের আনুষ্ঠানিক লিপি সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছিল ৫০ হিজরীতে। হযরত আলী (আ)-এর ছাত্র আবুল আসওয়াদ দুয়েলির অনুরোধে কুফার শাসক কোরআনের লিপিতে নানা চিহ্ন তথা জের, যবর, যতি চিহ্ন প্রভৃতি যুক্ত করেন। #


এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য