Showing posts with label Islamic Sign in Turkey. Show all posts
Showing posts with label Islamic Sign in Turkey. Show all posts

Wednesday, July 10, 2013

ইস্তানবুলের পথেঃ মুসলিম স্থাপত্য কলার অপূর্ব নিদর্শন ব্লু মস্ক

ইস্তানবুলের পথেঃ মুসলিম স্থাপত্য কলার অপূর্ব নিদর্শন ব্লু মস্ক

- এম ই জাভেদ

 

ছোট বেলায় খুব বইয়ের পোকা ছিলাম আমি । একেবারে বুক ওয়ার্ম যাকে বলে আর কি। পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি সময় পেলেই কোন না কোন গল্পের বই নিয়ে বসে যেতাম। একবার কোন বই নিয়ে বসলে ওটা শেষ না হওয়া অবধি দুদণ্ড স্বস্তি মিলত না মনে। কর্ম জীবনে এসে ব্যস্ততার অজুহাতে সে অভ্যাসকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি বহু আগে। এখন আমার অবসরের সঙ্গী ইন্টারনেটের গুগল, ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকা আর বাংলা ব্লগ। ছোট বেলার অভ্যাসের সূত্রে ইস্তাম্বুলের গল্প পড়েছি সম্ভবত সৈয়দ মুজতবা আলির কোন এক বইয়ে। সে থেকেই পরবর্তীতে একটু একটু করে জেনেছি মুসলিম সভ্যতার অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ইস্তাম্বুল শহরকে। এ শহরে আছে মুসলিম শৌর্য বীর্যের প্রতীক অটোমান সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদ – তপকাপি প্যালেস। এ প্যালেস এক সময় ছিল বর্তমান হোয়াইট হাউজের মত বিশ্ব শাসনের কেন্দ্র বিন্দু। তাছাড়া এ শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, যার মধ্যে অন্যতম সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মস্ক। ইস্তাম্বুলের বুক চিরে প্রবাহমান রয়েছে বসফরাস প্রণালী যা বিনি সুতোর মালার মত দুই দিক থেকে সংযুক্ত করে রেখেছে মর্মর সাগর আর কৃষ্ণ সাগরকে। বিশ্ব মানচিত্রে ইস্তাম্বুলই এক মাত্র শহর যার এক অংশ পড়েছে এশিয়ায় অন্য অংশ ইউরোপে। এক শহরে অবস্থান করে দুই মহাদেশের টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের আমেজ নেওয়ার সুযোগ যে কোন মনুষ্য সন্তানের জন্য অবশ্যই পরম কাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়। মনে তাই সুপ্ত বাসনা জেগেছিল কোন একদিন সময় সুযোগ হলে এ শহরটি ঘুরে দেখার। সৌভাগ্যক্রমে কিছুদিন পূর্বে আবিদজান থেকে বাংলাদেশে ছুটি গমনের প্রাক্কালে একটা সুযোগ হাতে এসে ধরা দেয়।

আইভরিকোস্ট থেকে বাংলাদেশ ভ্রমনের সব চেয়ে সহজ রুট আবিদজান- দুবাই- ঢাকা। সঙ্গত কারনে এমিরেটস এয়ার লাইন্স ই একমাত্র ভরসা। এমিরেটস আর তার ট্রাভেল এজেন্ট সাতগুরু এ দেশে একচেটিয়া দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল দীর্ঘদিন।কোন ভাল অপশন না থাকায় তাদের নিকট হতে চড়া দামে টিকেট কেনা ছাড়া অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে তাদের এ একচেটিয়া ব্যবসায় ছাই ঢেলে দেয় টার্কিশ এয়ার লাইন্স। তারা সরাসরি আবিদজান থেকে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে এমিরেটস এর চেয়ে অনেক কম রেটে। ব্যাপারটা আমার জন্য হয়ে দাঁড়ায় একেবারে সোনায় সোহাগায়। 

আবিদজানে টার্কিশের এ শুভাগমন আমার মত আরও অনেক ভ্রমণ পিপাসুর কাছে গ্রীষ্মের দীর্ঘ তপ্ত দহনের পর এক পশলা বৃষ্টি রূপেই আবির্ভূত হয়। আগে টার্কিশের ফ্লাইট ধরতে হলে যেতে হত ঘানায়। কাল বিলম্ব না করে ছুটির পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্কিশ এয়ার লাইন্সের টিকেট কেটে ফেললাম । 


যাক, আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক কিভাবে দেশটিকে গড়ে তুলেছেন ইউরোপের আদলে তা স্বচক্ষে দেখা যাবে এবার। আমার পরিকল্পনা ছিল ঢাকা যাওয়ার পথে ইস্তানবুলে যাত্রা বিরতি করবো কিছুদিনের জন্য। একে একে দেখে নিব এখানকার সকল দর্শনীয় স্থান। কিন্তু বাধ সাধে আমার অদৃষ্ট। জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা যেতে হয় আমাকে এক অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে। আর সে সময় সহযাত্রী হিসাবে যাদের পেয়েছি তাদের কেউই ইস্তানবুলে অবস্থানে ইচ্ছুক ছিল না। তারা সরাসরি বাংলাদেশ যেতে চায়। এতে কিছুটা হতাশায় পড়ে গেলাম। অবশ্য ইচ্ছে করলে দলছুট হয়ে আমি দুই একদিন থেকে যেতে পারতাম ইস্তানবুলে। কিন্তু একা একা ভ্রমনে আমি ঠিক স্বস্তি পাইনা। আর আমার দেশে ফেরার তাড়াও ছিল। অগত্যা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত ৮ ঘণ্টার ট্রানজিট টাইম কাজে লাগানোর সিদ্বান্ত নিলাম। শুনেছি টার্কিশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য সিটি টুরের ব্যবস্থা রয়েছে। 

নির্ধারিত দিনে আবিদজান থেকে রাতের ফ্লাইটে চড়ে বসলাম ইস্তানবুলের উদ্দেশ্যে। বিমানে এক ঝাঁক ডানা কাটা টার্কিশ পরীদের আতিথেয়তায় বেশ মুগ্ধ হলাম। শুনেছি টার্কিশ এয়ার লাইন্স তাদের দুর্দান্ত সার্ভিস দিয়ে ২০১২ সালে ইউরোপের সেরা এয়ার লাইন্সের খেতাব জিতে নিয়েছে। আমার ও মনে হল – দে ডিজার্ব দিস। সব কিছু মিলিয়ে তাদের সেবার মান যথেষ্ট ভাল।
সকাল আটটায় আমাদের বিমান ইস্তানবুলের মাটি স্পর্শ করল। 


ইমিগ্রেশানে আমাদের গ্রুপের একজনের পাসপোর্টে কোন এক সমস্যা ধরা পড়ে। ইমিগ্রেশান পুলিশকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে কনভিন্স করে বের হতে একটু দেরি হয়ে যায় আমাদের। ফলশ্রুতিতে টার্কিশ এয়ার লাইন্সের সিটি ট্যুর প্যাকেজটা মিস করে ফেলি। কি আর করা, অভাগা যে দিকে চায় …..সাগর শুকিয়ে যায়! সিদ্বান্ত নিলাম নিজেরাই ঘুরব। এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রো ট্রামের টিকেট কেটে চড়ে বসলাম তাতে। গাড়ি গুলো দেখতে খুবই সুন্দর। ইউরোপের আমেজ টের পেয়ে গেলাম এয়ারপোর্টেই। আমার হাতে ইস্তানবুল শহরের ছোট একটা ম্যাপ। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো, কিভাবে কোথায় যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মেট্রোট্রাম পরের স্টপেজে থামলে দেখি টার্কিশ এয়ার লাইন্সেরই এক এয়ার হোস্টেস( না ডানা কাটা পরী! এরা এত সুন্দর হয় কেন? ) আমার পাশে এসে বসল। মনে মনে ভাবলাম একে জিজ্ঞেস করলে কিছুটা গাইডলাইন পাওয়া যেতে পারে। আমি হায় হ্যালো বলে বেশ জমিয়ে ফেললাম তার সাথে। মেয়েটা বেশ আন্তরিক ভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিল কিভাবে যেতে হবে দর্শনীয় স্থান গুলোতে। আমি মুসলিম শুনে বেশ খুশি হল সে। তার সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে খেয়াল করলাম সহযাত্রীরা কেমন যেন ঈর্ষার চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু তাদেরকে ঈর্ষার আগুনে বেশিক্ষণ আর পোড়ার চান্স না দিয়ে মেয়েটি পরের স্টেশনে নেমে গেল। আমাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল- বা…ই , হ্যাভ এ নাইস ট্যুর। আমরা এগিয়ে চললাম ব্লু মস্ক এর উদ্দেশ্যে। মেয়েটির নির্দেশনা মোতাবেক একবার ট্রাম চেঞ্জ করতে হল এক স্টেশনে এসে। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।  
                                        
ব্লু মস্কের আসল নাম সুলতান আহমেদ মস্ক। মুসলিম স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন এ ব্লু মস্ক। মসজিদের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে নীল টাইলসের আধিক্যের ( প্রায় ২০,০০০) কারনেই মসজিদের এমন নামকরণ। সুলতান আহমেদ -১ এর শাসনকালে ১৬০৯- ১৬১৬ সালের মধ্যে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এ মসজিদের আর্কিটেক্ট ছিলেন মেহমেত আগা। তিনি অটোমান মস্ক এবং বাইজান টাইন চার্চের কম্বিনেশনে এ মসজিদের সম্পূর্ণ ডিজাইন তৈরি করেন। 





সুলতানের ইচ্ছা ছিল এ মসজিদ হবে নিকটবর্তী আয়াসোফিয়ার ( কেউ কেউ বলেন হাগিয়া সোফিয়া) চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুন্দর। মসজিদ নির্মাণ নিয়ে সুলতান এত বেশি উদগ্রীব ছিলেন যে মাঝে মধ্যে তিনি নিজেও এসে মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত লাগাতেন। দুঃখ জনক ভাবে মসজিদ নির্মাণের এক বছর পরই মেহমেত আগা ২৭ বছর বয়সে অকাল মৃত্যু বরণ করেন। তাকে সপরিবারে মসজিদের বাইরের কম্পাউন্ডে সমাহিত করা হয়েছে। তার মৃত্যু আমার কাছে কেন জানি একটু রহস্য জনক মনে হল। আমাদের মসলিন শাড়ির ইতিহাস মনে পড়ে গেল হঠ ৎ করে।
                                   
এ মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ১০,০০; মসজিদের উচ্চতা ৭২ মিটার, ডোমের সংখ্যা ৮ ( মুল ডোমের উচ্চতা ৪৩ মিটার) , মিনার আছে ৬ টা( উচ্চতা ৬৪ মিটার); ধারণা করা হয় এ মসজিদের মিনার সংখ্যা বায়তুল হারামের মিনার সংখ্যার সমান হয়ে গেলে সুলতান লোক পাঠিয়ে বায়তুল হারামে আরেকটা নতুন মিনার তৈরি করে দেন।

                                 
আমরা মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করলাম। গাছ গাছালীর আধিক্যের কারণে দূর থেকে মসজিদটা ভাল মত দেখা যাচ্ছিলো না।

                                   

উত্তর পাশের গেট দিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রচুর নারী ও পুরুষ পর্যটকের ভিড় এখানে। ভেতরে ঢুকে দেখলাম মূল মসজিদের বাইরে আছে বেশ বড় সড় খোলা মেলা চত্বর                                                                                                                                          
পশ্চিম পার্শ্বের গেট দিয়ে সুলতান ঘোড়ায় চড়ে টগবগিয়ে সরাসরি চলে আসতেন এ চত্বরে। গেটের প্রবেশ মুখে একটা লোহার চেইন ঝোলানো থাকত যাতে ভেতরে প্রবেশের সময় সুলতানকে মস্তক অবনত করে ঢুকতে হতো। মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে পরাক্রমশালী সুলতান ও গোলামের মত- বিষয়টা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতেই এ লোহার চেইন রাখা। আমরা ঘুরে ঘুরে বিমুগ্ধ নয়নে দেখলাম মসজিদটির স্থাপত্য নকশা, ক্যালিগ্রাফি, সুউচ্চ ডোম, মিনার ইত্যাদি। 


মসজিদের খোলা চত্বরে মূল মসজিদের একটা রেপ্লিকা ও দেখা গেল। 



দলে দলে মুসুল্লিরা অজু করে জুতা খুলে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করছে।

 

কিছু সাদা চামড়ার তরুণ তরুণীকে দেখলাম মসজিদের খোলা চত্বর এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলছে। সবার পরনে আঁটসাঁট টিশার্ট, হাফ প্যান্ট অথবা শর্টস। মসজিদের এ পবিত্র পরিবেশে বিষয়টা বেশ দৃষ্টি কটু লাগল। বুঝতে পারলাম এটা হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের ইউরোপীয়করনের ফল। কাক হয়ে ময়ূর পুচ্ছ ধারণের চেষ্টা করলেও ই ইউ তে তুরস্কের ঠাই হয়নি এখনো।


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ 

Thursday, May 9, 2013

তুরস্কে ইসলামী নিদর্শন: সাহাবী আবু আয়ুব আনসারী (রাঃ)-'র সমাধিস্থল

হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাদি)
- অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের ইতিহাসে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হুর শুভ নাম অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে এসে তাঁর বাড়িতেই আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। মদীনার প্রত্যেক বাসিন্দা চাচ্ছিলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করুন। তাঁদের এই আন্তরিকতা দেখে তিনি বললেন : তোমরা আমার উষ্ট্র্রী কাসওয়ার পথ ছেড়ে দাও। সে আমার অবস্থানস্থল খুঁজে বের করুক। তাই করা হলো। উষ্ট্রী কাসওয়া ধীরগতিতে হাঁটতে হাঁটতে হযরত আইয়ূব আনসারীর দোতলা বাড়ির সামনে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম সেই বাড়িতে উঠলেন এবং মসজিদে নববী ও তাঁর জন্য হুজরা নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়িতেই অবস্থান করেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর পূর্ণ নাম হচ্ছে খালিদ ইবনে যায়েদ ইবনে কুলায়েব আল-খাযরাজী আন্-নাজ্জারী। আবূ আইয়ূব আনসারী নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। মদীনার বনূ নাজ্জার বা নাজ্জার বংশের খাযরাজ গোত্রে তিনি ৫৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এই নাজ্জার বংশের এক কন্যাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের পরদাদা বা প্রপিতামহ হাশিম শাদি করেছিলেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন। কবিতা লেখার ঝোঁকও তাঁর ছিল। তিনি ২৯ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। হজ্জের মৌসুমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে আকাবা নামক স্থানে রাত্রি বেলায় গোপনে মিলিত হন এবং তাঁদের নিকট ইসলামের বাণী তুলে ধরেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনা যাবার জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সালামকে দাওয়াত দিয়ে যান। সেই দলে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুও ছিলেন এবং মদীনায় তাঁর নিজগৃহে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে মেহমান হিসেবে পাবার খোশনসীব তিনি লাভ করেছিলেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে পরিচালিত সকল সশস্ত্র যুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিদায় হজ্জে অংশগ্রহণ করেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পরিচালিত সকল অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত উমর ইব্ন খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর খিলাফতকালে মিসরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। হযরত আমর ইব্নুল আস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর সেনাপতিত্বে মিসর জয়ে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর বিশেষ অবদান ছিল।
৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান ইব্নে আফফান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর বাসভবন বিদ্রোহীরা অবরুদ্ধ করলে মদীনায় নেমে আসে অরাজক অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু খলীফার নির্দেশে মসজিদুন নববীতে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু মদীনা মনওয়ারা থেকে রাজধানী কূফা স্থানান্তরিত করেন এবং হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহ তা’আলা আন্হুকে মদীনার গবর্নর নিযুক্ত করেন। গবর্নর হিসেবে তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন।
হযরত উসমান ইব্নে আফফান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন তাঁর বাসভবনে বিদ্রোহীদের অস্ত্রাঘাতে শহীদ হলে হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু জনগণের বিশেষ করে বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের অনুরোধে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ওদিকে দামেস্কের গবর্নর হযরত আমীর মুআবিয়া রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু খলীফা উসমান হত্যার বিচার চেয়ে জোরদার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটালেন। এর ফলে হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু ও হযরত মু’আবিয়া রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। সংঘটিত হয় সিফফিনের যুদ্ধ। এই সুযোগে একটা চরমপন্থী বাতিল র্ফিকা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তারা আল্লাহ্র আইন ছাড়া কোন আইন মানি না সেøাগান তোলে এবং হযরত আলী, হযরত মু’আবিয়াকে কাফির বলে এঁদের হত্যা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এরাই খারেজী। এই খারেজীদের দমন করবার জন্য হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু ইরাকের নাহারওয়ান অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন। খারেজীদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। নাহারওয়ান খালের তীরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ খারেজীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তাদের চার হাজার সৈন্য নিহত হয়। হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহুর বাহিনীতে হযরত আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন এবং বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু মুসলিম নৌবাহিনী ৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত মু’আবিয়া রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর আমলে কনস্টান্টিনোপল অভিযানে গমন করেন। এই অভিযানে অশীতিপর বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু অংশগ্রহণ করেন। এই অবস্থায় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বেশ কিছুদিন রোগ ভোগের পর সেখানেই ইন্তিকাল করেন। তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে অসিয়ত করে যান তাঁকে কনস্টান্টিনোপলেই যেন দাফন করা হয়। তাঁর সেই অসিয়ত অনুযায়ী তাঁকে কনস্টান্টিনোপলের নগর প্রাচীরের পাশে কবরস্থ করা হয়।
  কালক্রমে এই মাযার শরীফ সব ধর্মের মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। তাঁর মাযার শরীফ থেকে আকাশ সমান আলোকিত করে একটা জ্যোতি উত্থিত হয় বলে জানা যায়। উসমানী সুলতানগণ তাঁদের অভিষেক অনুষ্ঠান এই মাযার শরীফে এসে সম্পন্ন করতেন।
হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রাদি) উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং কুরআন মজীদের হাফিজ ছিলেন। হাদীস শরীফ প্রসারে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২১০। ইলমে ফিক্হেও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। খলীফা আবূ বকর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু, খলীফা উমর (রাদি.) ও খলীফা উসমান (রাদি)-এর আমলে বায়তুল মাল হতে মাসিক চার হাজার দিরহাম ভাতা দেয়া হতো, হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু এই মাসিক ভাতা ২০ হাজার দিরহামে উন্নীত করেন।
ঐতিহাসিক হিট্টি হিস্ট্রি অব আরব্স গ্রন্থে লিখেছেন: In course of the siege Abu ayub died of dysentery and buried before the walls of Constantinople. His tomb soon became a shrine even for Christian Greeks, who made pilgrimages to it in time of draught to pray for rains... Thus the medina’s gentleman became a saint for three nations.
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সাঃ), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ


ইতিহাসের এক স্বর্ণালী বিস্ময়।

হলদে ডানা

.............................................আবু আইয়ুব আনসারী রা. পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন অনেক দিন। আল্লাহর জমীনে তারই মনোনিত জীবন ব্যাবস্থাকে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ৮৬ বছরের এক বৃদ্ধের শেষ জীবনের কাহিনী পৃথিবীর সব বিপ্লবীর জন্য এক নির্বাক করা নমুনা। তখন মুয়াবিয়া রা. এর শাসনকাল।  কন্সানটিনোপল তথা তুরস্কের ইস্তাম্বুল অভিযানে শরীক হলেন ৮৬ বছরের 'তরুণ' মুজাহিদ আবু আইয়ুব আনসারী রা. । শেষ নিশ্বাস ফেলব আল্লাহর দীনের পথে এই ছিল কামনা। রাসুল স. কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়ের যে ভবিষ্যতবানী করে যান, সেই বিজয় অভিযানের একজন সঙ্গী হওয়ার সে এক প্রবল আকাঙ্খা! সৈন্যরা ঘেরাও করলো কন্সট্যান্টিনোপল। দীর্ঘ এক বছর অবরোধ চললো।এ সময় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন বৃদ্ধ আবু আইয়ুব আনসারী। শায়ীত হলেন মৃত্যু শয্যায়। ছুটে এলেন সেনাপতি। পরম শ্রদ্ধাভরে শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলেন। আবু আইয়ুব আনসারী রা. বললেন- বলে লাভ কি, তোমরা কি তা পূরণ করবে? সেনাপতি  নাছোড়বান্দা। বললেন, কেন নয় চাচাজান- আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো। মুমূর্ষু মুজাহিদ বুজুর্গ সাহাবী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমি চাই আমার মৃত্যুর পর আগামীকাল কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রবেশ পথের ওপর আমাকে কবর দিয়ে আসবে। শেষ ইচ্ছা শুনে হতবাক সেনাপতিজানতে চাইলেন, তাঁর এই শেষ ইচ্ছার কারণ কি। আবু আইয়ুব আনসারী রা. জানালেন, আমি জানি কন্সট্যানটিনোপলে একদিন কুরআনের শাসন কায়েম হবেই, উড়বে কালেমার পতাকা, কিন্তু আমি তো তখন থাকবোনা। আমি চাই বিজয়ের দিনে বিজয়ী মুসলিম সৈনিকেরা যেন আমার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রোমান রাজধানীতে প্রবেশ করে।
এই সম্মানিত সাহাবীকে ইস্তাম্বুলে প্রবেশকারী সড়কের ওপর দাফন করা হয়। আল্লাহ তায়ালা তার এই আকাঙ্খা কবুল করে নেন। এই ঘটনার সাড়ে সাতশ বছর পর এই সড়কের উপর দিয়েই ওসমানী খলিফা দ্বিতীয় মুহাম্মদের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছিল। সালটি ছিল ১৪৫৪ খৃষ্টাব্দ।
বর্তমান ইস্তাম্বুলের আইয়ুপ সুলতান মসজিদ টি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. এর মাজারকে ঘিরেই। তুরস্কবাসী তাকে স্মরণ করে আইয়ুপ সুলতান নামে।

ভিডিওটি দেখুন প্লীজ:

এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য