Wednesday, July 10, 2013

ইস্তানবুলের পথেঃ মুসলিম স্থাপত্য কলার অপূর্ব নিদর্শন ব্লু মস্ক

ইস্তানবুলের পথেঃ মুসলিম স্থাপত্য কলার অপূর্ব নিদর্শন ব্লু মস্ক

- এম ই জাভেদ

 

ছোট বেলায় খুব বইয়ের পোকা ছিলাম আমি । একেবারে বুক ওয়ার্ম যাকে বলে আর কি। পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি সময় পেলেই কোন না কোন গল্পের বই নিয়ে বসে যেতাম। একবার কোন বই নিয়ে বসলে ওটা শেষ না হওয়া অবধি দুদণ্ড স্বস্তি মিলত না মনে। কর্ম জীবনে এসে ব্যস্ততার অজুহাতে সে অভ্যাসকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি বহু আগে। এখন আমার অবসরের সঙ্গী ইন্টারনেটের গুগল, ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকা আর বাংলা ব্লগ। ছোট বেলার অভ্যাসের সূত্রে ইস্তাম্বুলের গল্প পড়েছি সম্ভবত সৈয়দ মুজতবা আলির কোন এক বইয়ে। সে থেকেই পরবর্তীতে একটু একটু করে জেনেছি মুসলিম সভ্যতার অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ইস্তাম্বুল শহরকে। এ শহরে আছে মুসলিম শৌর্য বীর্যের প্রতীক অটোমান সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদ – তপকাপি প্যালেস। এ প্যালেস এক সময় ছিল বর্তমান হোয়াইট হাউজের মত বিশ্ব শাসনের কেন্দ্র বিন্দু। তাছাড়া এ শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, যার মধ্যে অন্যতম সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মস্ক। ইস্তাম্বুলের বুক চিরে প্রবাহমান রয়েছে বসফরাস প্রণালী যা বিনি সুতোর মালার মত দুই দিক থেকে সংযুক্ত করে রেখেছে মর্মর সাগর আর কৃষ্ণ সাগরকে। বিশ্ব মানচিত্রে ইস্তাম্বুলই এক মাত্র শহর যার এক অংশ পড়েছে এশিয়ায় অন্য অংশ ইউরোপে। এক শহরে অবস্থান করে দুই মহাদেশের টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের আমেজ নেওয়ার সুযোগ যে কোন মনুষ্য সন্তানের জন্য অবশ্যই পরম কাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়। মনে তাই সুপ্ত বাসনা জেগেছিল কোন একদিন সময় সুযোগ হলে এ শহরটি ঘুরে দেখার। সৌভাগ্যক্রমে কিছুদিন পূর্বে আবিদজান থেকে বাংলাদেশে ছুটি গমনের প্রাক্কালে একটা সুযোগ হাতে এসে ধরা দেয়।

আইভরিকোস্ট থেকে বাংলাদেশ ভ্রমনের সব চেয়ে সহজ রুট আবিদজান- দুবাই- ঢাকা। সঙ্গত কারনে এমিরেটস এয়ার লাইন্স ই একমাত্র ভরসা। এমিরেটস আর তার ট্রাভেল এজেন্ট সাতগুরু এ দেশে একচেটিয়া দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল দীর্ঘদিন।কোন ভাল অপশন না থাকায় তাদের নিকট হতে চড়া দামে টিকেট কেনা ছাড়া অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে তাদের এ একচেটিয়া ব্যবসায় ছাই ঢেলে দেয় টার্কিশ এয়ার লাইন্স। তারা সরাসরি আবিদজান থেকে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে এমিরেটস এর চেয়ে অনেক কম রেটে। ব্যাপারটা আমার জন্য হয়ে দাঁড়ায় একেবারে সোনায় সোহাগায়। 

আবিদজানে টার্কিশের এ শুভাগমন আমার মত আরও অনেক ভ্রমণ পিপাসুর কাছে গ্রীষ্মের দীর্ঘ তপ্ত দহনের পর এক পশলা বৃষ্টি রূপেই আবির্ভূত হয়। আগে টার্কিশের ফ্লাইট ধরতে হলে যেতে হত ঘানায়। কাল বিলম্ব না করে ছুটির পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্কিশ এয়ার লাইন্সের টিকেট কেটে ফেললাম । 


যাক, আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক কিভাবে দেশটিকে গড়ে তুলেছেন ইউরোপের আদলে তা স্বচক্ষে দেখা যাবে এবার। আমার পরিকল্পনা ছিল ঢাকা যাওয়ার পথে ইস্তানবুলে যাত্রা বিরতি করবো কিছুদিনের জন্য। একে একে দেখে নিব এখানকার সকল দর্শনীয় স্থান। কিন্তু বাধ সাধে আমার অদৃষ্ট। জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা যেতে হয় আমাকে এক অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে। আর সে সময় সহযাত্রী হিসাবে যাদের পেয়েছি তাদের কেউই ইস্তানবুলে অবস্থানে ইচ্ছুক ছিল না। তারা সরাসরি বাংলাদেশ যেতে চায়। এতে কিছুটা হতাশায় পড়ে গেলাম। অবশ্য ইচ্ছে করলে দলছুট হয়ে আমি দুই একদিন থেকে যেতে পারতাম ইস্তানবুলে। কিন্তু একা একা ভ্রমনে আমি ঠিক স্বস্তি পাইনা। আর আমার দেশে ফেরার তাড়াও ছিল। অগত্যা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত ৮ ঘণ্টার ট্রানজিট টাইম কাজে লাগানোর সিদ্বান্ত নিলাম। শুনেছি টার্কিশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য সিটি টুরের ব্যবস্থা রয়েছে। 

নির্ধারিত দিনে আবিদজান থেকে রাতের ফ্লাইটে চড়ে বসলাম ইস্তানবুলের উদ্দেশ্যে। বিমানে এক ঝাঁক ডানা কাটা টার্কিশ পরীদের আতিথেয়তায় বেশ মুগ্ধ হলাম। শুনেছি টার্কিশ এয়ার লাইন্স তাদের দুর্দান্ত সার্ভিস দিয়ে ২০১২ সালে ইউরোপের সেরা এয়ার লাইন্সের খেতাব জিতে নিয়েছে। আমার ও মনে হল – দে ডিজার্ব দিস। সব কিছু মিলিয়ে তাদের সেবার মান যথেষ্ট ভাল।
সকাল আটটায় আমাদের বিমান ইস্তানবুলের মাটি স্পর্শ করল। 


ইমিগ্রেশানে আমাদের গ্রুপের একজনের পাসপোর্টে কোন এক সমস্যা ধরা পড়ে। ইমিগ্রেশান পুলিশকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে কনভিন্স করে বের হতে একটু দেরি হয়ে যায় আমাদের। ফলশ্রুতিতে টার্কিশ এয়ার লাইন্সের সিটি ট্যুর প্যাকেজটা মিস করে ফেলি। কি আর করা, অভাগা যে দিকে চায় …..সাগর শুকিয়ে যায়! সিদ্বান্ত নিলাম নিজেরাই ঘুরব। এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রো ট্রামের টিকেট কেটে চড়ে বসলাম তাতে। গাড়ি গুলো দেখতে খুবই সুন্দর। ইউরোপের আমেজ টের পেয়ে গেলাম এয়ারপোর্টেই। আমার হাতে ইস্তানবুল শহরের ছোট একটা ম্যাপ। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো, কিভাবে কোথায় যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মেট্রোট্রাম পরের স্টপেজে থামলে দেখি টার্কিশ এয়ার লাইন্সেরই এক এয়ার হোস্টেস( না ডানা কাটা পরী! এরা এত সুন্দর হয় কেন? ) আমার পাশে এসে বসল। মনে মনে ভাবলাম একে জিজ্ঞেস করলে কিছুটা গাইডলাইন পাওয়া যেতে পারে। আমি হায় হ্যালো বলে বেশ জমিয়ে ফেললাম তার সাথে। মেয়েটা বেশ আন্তরিক ভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিল কিভাবে যেতে হবে দর্শনীয় স্থান গুলোতে। আমি মুসলিম শুনে বেশ খুশি হল সে। তার সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে খেয়াল করলাম সহযাত্রীরা কেমন যেন ঈর্ষার চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু তাদেরকে ঈর্ষার আগুনে বেশিক্ষণ আর পোড়ার চান্স না দিয়ে মেয়েটি পরের স্টেশনে নেমে গেল। আমাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল- বা…ই , হ্যাভ এ নাইস ট্যুর। আমরা এগিয়ে চললাম ব্লু মস্ক এর উদ্দেশ্যে। মেয়েটির নির্দেশনা মোতাবেক একবার ট্রাম চেঞ্জ করতে হল এক স্টেশনে এসে। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।  
                                        
ব্লু মস্কের আসল নাম সুলতান আহমেদ মস্ক। মুসলিম স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন এ ব্লু মস্ক। মসজিদের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে নীল টাইলসের আধিক্যের ( প্রায় ২০,০০০) কারনেই মসজিদের এমন নামকরণ। সুলতান আহমেদ -১ এর শাসনকালে ১৬০৯- ১৬১৬ সালের মধ্যে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এ মসজিদের আর্কিটেক্ট ছিলেন মেহমেত আগা। তিনি অটোমান মস্ক এবং বাইজান টাইন চার্চের কম্বিনেশনে এ মসজিদের সম্পূর্ণ ডিজাইন তৈরি করেন। 





সুলতানের ইচ্ছা ছিল এ মসজিদ হবে নিকটবর্তী আয়াসোফিয়ার ( কেউ কেউ বলেন হাগিয়া সোফিয়া) চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুন্দর। মসজিদ নির্মাণ নিয়ে সুলতান এত বেশি উদগ্রীব ছিলেন যে মাঝে মধ্যে তিনি নিজেও এসে মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত লাগাতেন। দুঃখ জনক ভাবে মসজিদ নির্মাণের এক বছর পরই মেহমেত আগা ২৭ বছর বয়সে অকাল মৃত্যু বরণ করেন। তাকে সপরিবারে মসজিদের বাইরের কম্পাউন্ডে সমাহিত করা হয়েছে। তার মৃত্যু আমার কাছে কেন জানি একটু রহস্য জনক মনে হল। আমাদের মসলিন শাড়ির ইতিহাস মনে পড়ে গেল হঠ ৎ করে।
                                   
এ মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ১০,০০; মসজিদের উচ্চতা ৭২ মিটার, ডোমের সংখ্যা ৮ ( মুল ডোমের উচ্চতা ৪৩ মিটার) , মিনার আছে ৬ টা( উচ্চতা ৬৪ মিটার); ধারণা করা হয় এ মসজিদের মিনার সংখ্যা বায়তুল হারামের মিনার সংখ্যার সমান হয়ে গেলে সুলতান লোক পাঠিয়ে বায়তুল হারামে আরেকটা নতুন মিনার তৈরি করে দেন।

                                 
আমরা মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করলাম। গাছ গাছালীর আধিক্যের কারণে দূর থেকে মসজিদটা ভাল মত দেখা যাচ্ছিলো না।

                                   

উত্তর পাশের গেট দিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রচুর নারী ও পুরুষ পর্যটকের ভিড় এখানে। ভেতরে ঢুকে দেখলাম মূল মসজিদের বাইরে আছে বেশ বড় সড় খোলা মেলা চত্বর                                                                                                                                          
পশ্চিম পার্শ্বের গেট দিয়ে সুলতান ঘোড়ায় চড়ে টগবগিয়ে সরাসরি চলে আসতেন এ চত্বরে। গেটের প্রবেশ মুখে একটা লোহার চেইন ঝোলানো থাকত যাতে ভেতরে প্রবেশের সময় সুলতানকে মস্তক অবনত করে ঢুকতে হতো। মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে পরাক্রমশালী সুলতান ও গোলামের মত- বিষয়টা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতেই এ লোহার চেইন রাখা। আমরা ঘুরে ঘুরে বিমুগ্ধ নয়নে দেখলাম মসজিদটির স্থাপত্য নকশা, ক্যালিগ্রাফি, সুউচ্চ ডোম, মিনার ইত্যাদি। 


মসজিদের খোলা চত্বরে মূল মসজিদের একটা রেপ্লিকা ও দেখা গেল। 



দলে দলে মুসুল্লিরা অজু করে জুতা খুলে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করছে।

 

কিছু সাদা চামড়ার তরুণ তরুণীকে দেখলাম মসজিদের খোলা চত্বর এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলছে। সবার পরনে আঁটসাঁট টিশার্ট, হাফ প্যান্ট অথবা শর্টস। মসজিদের এ পবিত্র পরিবেশে বিষয়টা বেশ দৃষ্টি কটু লাগল। বুঝতে পারলাম এটা হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের ইউরোপীয়করনের ফল। কাক হয়ে ময়ূর পুচ্ছ ধারণের চেষ্টা করলেও ই ইউ তে তুরস্কের ঠাই হয়নি এখনো।


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ 

No comments:

Post a Comment

https://isignbd.blogspot.com/2013/10/blog-post.html

এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য