দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মুসলিম নিদর্শন বাংলাদেশে! সাড়ে তেরো শ বছর আগের মসজিদ। (পাল্টে যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের আগমনের ইতিহাস)
- কাজল রশীদ ও ইফতেখার মাহমুদ
দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। এক পাশে দু-এক ঘর করে ফাঁকা জনবসতি। মোটেই ঘনবসতিপূর্ণ নয় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রাম। অথচ এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছে ৬৯ হিজরিতে নির্মিত মসজিদ। সামনে ফসলের মাঠটি একদা ছিল চকচকার বিল। এলাকার প্রবীণ মানুষের কাছে স্থানটি আজও সাগরের ছড়া নামে পরিচিত, যার অনতিদূরে তিস্তা নদীর অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর একটি। কাজেই এই অববাহিকায় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা বিস্ময় জাগানিয়া হলেও একেবারে অস্বাভাবিক নয়। শৌখিন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিলও তেমনটাই মনে করেন। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলজুড়ে যে প্রাচীন সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে প্রাচীন রোমান ও আরব-সভ্যতার সম্পর্ককে ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখেন টিম স্টিল। সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই আরব বণিকেরা লালমনিরহাটের ওই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন—এমনটাই মনে করেন তিনি।
স্থানীয় অধিবাসী এবং ইতিমধ্যে গঠিত ‘হারানো মসজিদ কমিটি’র সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের দাবি অনুযায়ী এই মসজিদটি নির্মাণ করেছেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবা। যিনি এই অঞ্চল দিয়ে চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এবং চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তাঁর নির্মিত মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। ওই সাহাবির নাম আবু আক্কাছ (রা.)। ৬৯ হিজরিতে তৈরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপরই গড়ে উঠেছে বর্তমানের মসজিদ কমপ্লেক্স।
মোস্তের আড়া বা মজদের আড়া
বর্তমানের হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স যে স্থানে অবস্থিত, সেই স্থানটি একদা পরিচিত ছিল মোস্তের আড়া বা মজদের আড়া নামে। স্থানীয় অধিবাসী দেলওয়ার হোসেন জানান, স্থানটি টিলার মতো ছিল। ওখানে কেউ যেত না। তবে অনেকেই আগরবাতি, মোমবাতি, ফুল, ধুপ ইত্যাদি ওই স্থানে রেখে আসত। এখানে মসজিদ, মন্দির না অন্য কিছু আছে কিছুই জানত না তারা। উল্লেখ্য, স্থানীয় ভাষায় আড়া শব্দের অর্থ হলো জঙ্গলময় স্থান। দীর্ঘদিনের পতিত এই জঙ্গলে স্থানীয় লোকজন হিংস্র জীবজন্তু, সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদির ভয়ে ভেতরে প্রবেশ করত না।
জানা যায়, রামদাস এলাকায় বর্তমানে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁদের পূর্ব পুরুষরা ২০০ বছর আগে এখানে বসতি শুরু করেন। হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স যা আগে আড়া নামে পরিচিত ছিল, তার একদা মালিক ছিলেন পচা দালাল। তাঁর কাছে থেকে কিনে নেন ইয়াকুব আলী। আনুমানিক সময়কাল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ। পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকার সূত্রে জায়গাটির মালিক হন নবাব আলী। হারানো মসজিদ আবিষ্কারের পর তিনি জায়গাটা হারানো মসজিদ কমপ্লেক্সের নামে দিয়ে দেন।
যেভাবে আবিষ্কার
৬৯ হিজরির হারানো মসজিদ তায়ালিমুল কোরআন নূরানি মাদ্রাসার শিক্ষক হাফিজ নূর আলম জানান, মজদের আড়ায় চাষাবাদ করার জন্য খোঁড়া শুরু হয় ১৯৮৩-’৮৪ সালের দিকে। টিলাটি সমতল করার জন্য খোঁড়া শুরু হলে এখানে প্রচুর ইট পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, পুরোনো কোনো জমিদার কিংবা রাজরাজড়ার বাড়ি হয়তো এখানে ছিল। এ কারণে তারা এ নিয়ে কোনো রূপ সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি। যে যার মতো ভাঙা ইটের টুকরো নিয়ে গেছে এবং বেশির ভাগই তারা নিজেদের বাড়িঘরের কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু একটা ঘটনায় পাল্টে যায় পুরো ঘটনাচক্র।
৬৯ হিজরির হারানো মসজিদ তায়ালিমুল কোরআন নূরানি মাদ্রাসার শিক্ষক হাফিজ নূর আলম জানান, মজদের আড়ায় চাষাবাদ করার জন্য খোঁড়া শুরু হয় ১৯৮৩-’৮৪ সালের দিকে। টিলাটি সমতল করার জন্য খোঁড়া শুরু হলে এখানে প্রচুর ইট পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, পুরোনো কোনো জমিদার কিংবা রাজরাজড়ার বাড়ি হয়তো এখানে ছিল। এ কারণে তারা এ নিয়ে কোনো রূপ সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি। যে যার মতো ভাঙা ইটের টুকরো নিয়ে গেছে এবং বেশির ভাগই তারা নিজেদের বাড়িঘরের কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু একটা ঘটনায় পাল্টে যায় পুরো ঘটনাচক্র।
‘ছটকে পড়া’ ইট
একটা ইটের ছিটকে পড়ার ঘটনা, স্থানীয় ভাষায় ‘ছটকে পড়া’র মধ্য দিয়েই মজদের আড়ায় আবিষ্কৃত হয় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দের হারানো মসজিদ। স্থানীয় অধিবাসী আফছার আলী বলেন, ‘আমরা ঘটনাটিকে অলৌকিক বলেই মনে করি। ঘটনাটা হলো, আইয়ুব আলী নামে রামদাসের একজন বাসিন্দা অন্য অনেকের মতো মজদের আড়া থেকে ইট কুড়িয়ে নিয়ে যান, যা পরিষ্কার করার সময় দেখতে পান, ইটের গাদা থেকে একটা ইট যেন আলাদাভাবে ছিটকে পড়ল। তিনি আশ্চর্য হন এবং কৌতূহল বোধ করেন। ছিটকে পড়া ইটটার ওপর কী যেন লেখা দেখতে পান। টিউবওয়েলের পানিতে ইটটা ভালো করে ধুয়ে নেন। তারপর ইটটা অন্যদের দেখালে সবাই দেখতে পান, ওই ইটটি একটি প্রাচীন শিলালিপি, যার আকার ৬X৬X২, ওপরে স্পষ্টাক্ষরে লেখা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ হিজরি সন ৬৯। এই ঘটনায় স্থানীয় লোকদের মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, এটা কোনো হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।
একটা ইটের ছিটকে পড়ার ঘটনা, স্থানীয় ভাষায় ‘ছটকে পড়া’র মধ্য দিয়েই মজদের আড়ায় আবিষ্কৃত হয় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দের হারানো মসজিদ। স্থানীয় অধিবাসী আফছার আলী বলেন, ‘আমরা ঘটনাটিকে অলৌকিক বলেই মনে করি। ঘটনাটা হলো, আইয়ুব আলী নামে রামদাসের একজন বাসিন্দা অন্য অনেকের মতো মজদের আড়া থেকে ইট কুড়িয়ে নিয়ে যান, যা পরিষ্কার করার সময় দেখতে পান, ইটের গাদা থেকে একটা ইট যেন আলাদাভাবে ছিটকে পড়ল। তিনি আশ্চর্য হন এবং কৌতূহল বোধ করেন। ছিটকে পড়া ইটটার ওপর কী যেন লেখা দেখতে পান। টিউবওয়েলের পানিতে ইটটা ভালো করে ধুয়ে নেন। তারপর ইটটা অন্যদের দেখালে সবাই দেখতে পান, ওই ইটটি একটি প্রাচীন শিলালিপি, যার আকার ৬X৬X২, ওপরে স্পষ্টাক্ষরে লেখা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ হিজরি সন ৬৯। এই ঘটনায় স্থানীয় লোকদের মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, এটা কোনো হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।
অলৌকিক কাহিনি
ওই ঘটনার পর তখনো মজদের আড়ায় নামাজ পড়া শুরু হয়নি। এক রাতে আফছার আলী শুনতে পান একজন বলছেন (কণ্ঠটা ঠিক তাঁর ভায়রা নওয়াব আলীর মতো) চলো, আমরা মজদের আড়ায় নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার জন্য তিনি বেরিয়েও পড়েন। একসময় পৌঁছে যান ভায়রার বাড়িতে। অপেক্ষা করেন, কিন্তু ভায়রা আর ভেতর থেকে বের হন না। পরে ডাকাডাকি শুরু করেন এবং বলেন নামাজ পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে এসে তুমি আর বেরোচ্ছ না কেন? এ কথা শুনে নওয়াব আলী তাজ্জব বনে যান। ঘটনাটা এলাকায় জানাজানি হলে, সবাই মিলে ওই দিন থেকেই নামাজ পড়া শুরু করেন। এলাকাবাসীর মতে, সেটা ’৮৬ সালের ঘটনা, ওই দিন ছিল মহররমের ১০ তারিখ। পরবর্তী সময়ে এখানেই নির্মাণ করা হয় হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স এবং একটি নূরানী মাদ্রাসা।
উল্লেখ্য, এর আগে এলাকাবাসী নামাজ পড়ত তিন কিলোমিটার দূরের সুবেদার মুনছুর খাঁ নিদাঁড়িয়া মসজিদে, যা একই ইউনিয়নের নয়ারহাট পাড়ায় অবস্থিত। এই মসজিদটি মোগল আমলের স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য এটিও দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। স্থানীয় লোকজন গরু খুঁজতে গিয়ে এই মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর খুঁজে পায়। অবশ্য এলাকাবাসী তারও আগে ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরের রতিপুরের কেরামতিয়া বড় মসজিদে নামাজ পড়তে যেত।
ওই ঘটনার পর তখনো মজদের আড়ায় নামাজ পড়া শুরু হয়নি। এক রাতে আফছার আলী শুনতে পান একজন বলছেন (কণ্ঠটা ঠিক তাঁর ভায়রা নওয়াব আলীর মতো) চলো, আমরা মজদের আড়ায় নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার জন্য তিনি বেরিয়েও পড়েন। একসময় পৌঁছে যান ভায়রার বাড়িতে। অপেক্ষা করেন, কিন্তু ভায়রা আর ভেতর থেকে বের হন না। পরে ডাকাডাকি শুরু করেন এবং বলেন নামাজ পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে এসে তুমি আর বেরোচ্ছ না কেন? এ কথা শুনে নওয়াব আলী তাজ্জব বনে যান। ঘটনাটা এলাকায় জানাজানি হলে, সবাই মিলে ওই দিন থেকেই নামাজ পড়া শুরু করেন। এলাকাবাসীর মতে, সেটা ’৮৬ সালের ঘটনা, ওই দিন ছিল মহররমের ১০ তারিখ। পরবর্তী সময়ে এখানেই নির্মাণ করা হয় হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স এবং একটি নূরানী মাদ্রাসা।
উল্লেখ্য, এর আগে এলাকাবাসী নামাজ পড়ত তিন কিলোমিটার দূরের সুবেদার মুনছুর খাঁ নিদাঁড়িয়া মসজিদে, যা একই ইউনিয়নের নয়ারহাট পাড়ায় অবস্থিত। এই মসজিদটি মোগল আমলের স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য এটিও দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। স্থানীয় লোকজন গরু খুঁজতে গিয়ে এই মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর খুঁজে পায়। অবশ্য এলাকাবাসী তারও আগে ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরের রতিপুরের কেরামতিয়া বড় মসজিদে নামাজ পড়তে যেত।
সাক্ষী শিলালিপি
যে শিলালিপির আলোকে হারানো মসজিদকে ৬৯ হিজরির বলা হচ্ছে, সেই শিলালিপি এখন নানা হাত ঘুরে রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ির জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। শিলালিপিটি রামদাসবাসীর কাছ থেকে নিয়ে যান কুড়িগ্রামের একজন সাংবাদিক। তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে সংগ্রহ করে সংরক্ষণের জন্য রাখা হয় তাজহাট জমিদারবাড়ি জাদুঘরে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে রংপুুরের টাউন হলে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। যার বিষয় ছিল ‘হিজরি প্রথম শতাব্দীতে ইসলাম ও বাংলাদেশ’। এতে সভাপতিত্ব করেন কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কুদ্দুস বিশ্বাস। প্রবন্ধকার ও সব আলোচক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, ৬৯ হিজরি অর্থাৎ ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সাহাবায়ে কেরামগণ কর্তৃক এই হারানো মসজিদ নির্মাণ করা মোটেই অসম্ভব নয়।
একজন টিম স্টিল
কর্মসূত্রে টিম স্টিল তখন বাংলাদেশের টাইগার ট্যুরিজম নামের একটি পর্যটন উন্নয়নবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা। সাউথ ওয়েলসে স্ত্রী ক্রিস্টিন ও দুই মেয়ের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে বাংলাদেশে ফিরলেন তিনি। ছুটে গেলেন লালমনিরহাটে। খুঁজে বের করলেন প্রাচীন মসজিদটি। তিনি বাংলা ও উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন। ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে কে কেন লালমনিরহাট এলাকায় ওই মসজিদ নির্মাণ করল তা খুঁজতে নেমে গেলেন তিনি। যোগাযোগ করলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সঙ্গে। তারা আগ্রহ দেখাল না। বেশির ভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ বললেন এত আগে ওই অঞ্চলে মসজিদ নির্মিত হওয়ার কথা না। বাংলার ইসলাম বিস্তারের ইতিহাসের প্রভাবশালী ধারা বলে ১০০০ শতকে চট্টগ্রামে সুফিদের প্রথম আগমন ঘটে। ১১০০ থেকে ১২০০ শতকে সুফিদের হাত ধরে পূর্ববাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু। তাঁদের হাতেই এই অঞ্চলে প্রথম মসজিদ নির্মাণ হয়। পরে সুলতান ও মোগলদের হাত ধরে তার আরও প্রসার ঘটে।
মসজিদের ইট হাতে টিম স্টিল
লালমনিরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ রয়েছে, এটা প্রমাণের জন্য টিম স্টিল সহায়তা নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজিস্টের। সেখানকার ইসলামের ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেন এমন সব গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁরা বললেন হ্যাঁ, হতে পারে। কেননা, রোমান ও জার্মান অনেক ইতিহাসবিদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নৌ-বাণিজ্যের সূত্রে আসা-যাওয়ার কথা লিপিবদ্ধ আছে। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজি টিম স্টিলকে জানায়, তাদের বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
টিম জানতে পারলেন, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পাড় ধরে সিকিম হয়ে চীনের ভেতর দিয়ে আরব বণিকদের বাণিজ্যবহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণও টিমের হাতে আসে। টিমের গবেষণায় আরও প্রমাণ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষ থেকে রোমান ও আরবরা পণ্য নিয়ে যেত। রোমানদের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগের আরও প্রমাণ তিনি পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফুির রহমানের ওয়ারি-বটেশ্বর সভ্যতা নিয়ে গবেষণায়। নরসংদী থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রাচীন নগর-সভ্যতার যে নিদর্শন মোস্তাফিজুর রহমান পেয়েছেন, তাতে এটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে পড়ছে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল। পঞ্চগড়ের ভিটাগড়ে প্রাচীন নগরের নিদর্শন পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক শাহনেওয়াজের গবেষণা থেকেও সহায়তা পান টিম। বগুড়ার মহাস্থানগড় বা নওগাঁর প্রাচীন মসজিদ এই সবকিছুকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা প্রাচীন-সভ্যতার ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখতে চান টিম স্টিল।
এই শৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। লালমনিরহাটে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন মসজিদের খোঁজ পেয়ে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার যে নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছে তা থেকে মুক্ত হতে চান না তিনি। তাই তো নিজ উদ্যোগে ও খরচে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর শখের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা।
বাংলাদেশের ওই হারানো মসজিদের ওপর আরও গবেষণা হওয়া উচিত এই আকুতি রেখে টিম বলেন, ওই মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস খুঁজে পেলে হয়তো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্ব সভ্যতার সম্পর্কের আরেক ইতিহাস জানার পথ খুলে যাবে। রোমান, চৈনিক, আরব আর বাংলা—এই চার অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক জানা গেলে হয়তো পৃথিবীর ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হবে। টিম স্টিলের গবেষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে, এটি এক হাজার তিন শ চৌষট্টি বছর আগের মসজিদ! যার সূত্র ধরে পাল্টে যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের আগমনের ইতিহাস।