Sunday, September 15, 2013

শেষ সময়ের নিদর্শন নিয়ে হাদীসের বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী


Please see this video (double click):

NASA discovers miracle of Kaba | Infinite Radation | Scientist explains


Please see this video (double click):


কুরআন মাজিদে সন্দেহের একটি ছায়া খুঁজে দেখাও?

কুরআন মাজিদে সন্দেহের একটি ছায়া খুঁজে দেখাও?


এই সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুত্তাকিদের (যারা আল্লাহর প্রতি তাদের করণীয়সমূহ সম্পর্কে সচেতন তাদের) জন্য হেদায়াত। (বাকারা, ০২ : ০২) আর আমি আমার বান্দার ওপর (কুরআন মাজিদে) বিভিন্ন সময়ে যা নাজিল করেছি যদি তোমরা সে সম্পকের্ সন্দেহে থাক তবে তোমরা তার মত একটি ‘সুরা’ নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা (তোমাদের সন্দেহের ক্ষেত্রে) সত্যবাদী হও। (বাকারা, ০২ : ২৩) এই কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা (যে ওহি) তার সামনে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলেন রবের পক্ষ থেকে। (ইউনুস, ১০ : ৩৭) এ কিতাব সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এতে কোনো সন্দেহ নাই। (সাজদাহ, ৩২ : ০২) লক্ষণীয় বিষয় হল, এই আয়াতগুলি কাফিরদেরকে কুরআন মাজিদের ভুলত্রুটি, অসঙ্গতি কিংবা অনৈক্য খুঁজে বের করতে বলে না, বরং কুরআন মাজিদে একটি সাধারণ সন্দেহের ছায়া খুঁজে বের করতে বলে। মানব ইতিহাসে এমন কোনো বইয়ের নজির নেই যার লেখক এই দাবি করতে পেরেছেন। কুরআন মাজিদই একমাত্র গ্রন্থ যা এই দাবি করেছে। এখন আমরা সেসব বিবিধ সন্দেহের বিশ্লেষণ করি যা কোনো বই সম্পর্কে একজন মানুষের হতে পারে। তা এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রচিত বা প্রচারিত হতে পারে, যিনি মানব সমাজে অপরিচিত কিংবা তা এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রচিত বা প্রচারিত হতে পারে, যার চরিত্র, আচরণ কিংবা ন্যায়পরায়নতা সন্দেহপূর্ণ।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন ইতিহাসের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, তাঁর জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত সংরক্ষিত, লিখিত এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়ে এসেছে। বস্তুত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই মানব ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যার জীবন বৃত্তান্ত বিগত চৌদ্দশ বছরের প্রত্যেক যুগের মুসলমানরাই লিপিবদ্ধ করেছে। অধিকন্তু এ সকল বিবরণ এতই ব্যাপক যে, তারা কেবল তার জীবন-বৃত্তান্ত লিখেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক, আদান-প্রদান, কথা বলার ধরণ, হাঁটা-চলা, নিদ্রা যাওয়া, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং তাঁর দেহাবয়বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের ওপরও আলোকপাত করেছে। যেমন- তাঁর দাড়িতে শুভ্র চুলের পরিমাণ কত ইত্যাদি। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ ও ন্যায়পরায়নতা সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মক্কায় তাঁর ঘোর শত্রুরাও তাঁকে ‘সিদ্দিক’ (সত্যবাদী) এবং ‘আল-আমিন’ (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জীবন-ইতিহাস, চারিত্রিক ন্যায়পরায়নতা ওআচার- আচরণ সম্পর্কিত বাস্তব ঘটনাবলি এমন নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের পর সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো সংশয় থাকতে পারে না যিনি মানব জাতির কাছে কুরআনের বাণী প্রচার করেছেন। তিনি ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বই নন, বরং একজন প্রখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ সত্যের প্রচারক। অতএব এ থেকে বুঝা যায়, কুরআন মাজিদের উৎসের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের সন্দেহের অবকাশ নেই। দ্বিতীয় প্রকার সন্দেহ, যা একটি গ্রন্থে সৃষ্টি হতে পারে তা, তার অন্তর্নিহিত সঙ্গতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যদি একটি গ্রন্থের কিছু বর্ণনা অন্য বর্ণনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা একটি গ্রন্থের অন্তর্নিহিত সঙ্গতি কিংবা সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। পুরো কুরআন মাজিদে ৬,২৩৬টি আয়াত এবং ৮৬,৪৩২টি শব্দ রয়েছে। তথাপি কুরআন মাজিদের একটি সাধারণ আয়াত, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা কিংবা শব্দ অন্য অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। পক্ষান্তরে প্রত্যেকটি আয়াত ও শব্দ সমগ্র কুরআন মাজিদের টেক্সটের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাঠক এই বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন, যদি বর্তমান বাইবেল সম্পর্কে কেবল দু’টি উদ্ধৃতি দেয়া হয়। প্রটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের বাইবেলের কপিতে বই সংখ্যা ৬৬টি, যার মধ্যে ৩৯টি বই পুরাতন সমাচার থেকে এবং ২৭টি বই নতুন সমাচার থেকে। অপরপক্ষে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের বাইবেলের কপিতে বই সংখ্যা ৭৩টি; ৬৬টি বই প্রটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের কপি থেকে এবং ৬টি অতিরিক্ত বই যেগুলি Apocrypha (অ্যাপোক্রাইফা) নামে পরিচিত। বাইবেলের এই দুই ধরনের ভার্সনের অস্তিত্ব থাকার কারণে পুরো বাইবেলের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর সুস্পষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন জাগে গ্রন্থটির কোন ভার্সনটি গ্রহণ করা যাবে, প্রটেস্টেন্ট ভার্সন না ক্যাথলিক ভার্সন? বাইবেলের একটি বিস্ময়কর অসঙ্গতি হল, এটি যীশু খ্রিস্টের (ঈসা আলাইহিস সালাম-এর) দু’টি ভিন্ন ভিন্ন বংশ তালিকা প্রদান করে। বাইবেল অনুসারে, তার একজন পূর্বপুরুষের নাম হল যোসেফ। মেথিউ ১ : ১-৭ অনুসারে যোসেফের পিতার নাম জ্যাকব। পক্ষান্তরে লূক ৩ : ২৩ অনুসারে যোসেফের পিতার নাম হেলি।

আল হামদুলিল্লাহ। কুরআন মাজিদের কেবল একটি ভার্সনই সদা বিদ্যমান থেকেছে এবং এর টেক্সটও সবধরনের অসঙ্গতিরহিত। সেহেতু সন্দেহের দ্বিতীয় রূপ অর্থাৎ গ্রন্থের আভ্যন্তরীণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য অনুসারেও কুরআন মাজিদে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই। একটি গ্রন্থে তৃতীয় প্রকার যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় তা তার বাহ্যিক সঙ্গতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার অর্থ, গ্রন্থটিতে এমন কোনো বর্ণনা থাকবে না, যা গ্রন্থটির বাইরের জগতের স্বতঃসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। বিগত পৃষ্ঠাগুলি তার কিছু নমুনা প্রদান করে যে, কুরআন মাজিদের বর্ণনা শরীরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভ্রূণবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ব্যবচ্ছেদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়সহ কোনো মানবজ্ঞান জগতের সঙ্গেই অসঙ্গতি রাখে না। অধিকন্তু কুরআন মজিদ মানব জ্ঞানের সকল স্তর থেকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রাখে, চাই তা প্রাচীন, সাম্প্রতিক কিংবা অতি সাম্প্রতিকই হোক না কেন। এভাবে কুরআন মজিদ বাহ্যিক সঙ্গতির পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ। কোনো মানুষই এমন কোনো গ্রন্থ রচনা করতে পারে নি যা চিরকাল বাহ্যিক সঙ্গতির বিষয়টি রক্ষা করতে পেরেছে। প্রত্যেক বই-ই সময়ের সঙ্গে একটি ধাপ পেরিয়ে গেলে সেকেলে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। কুরআন মাজিদই একমাত্র গ্রন্থ যা সফলতার সঙ্গে বিগত চৌদ্দশ বছর যাবৎ বাহ্যিক সঙ্গতির চ্যালেঞ্জ মুকাবেলা করেছে। মহাজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ তাআলাই এমন একটি গ্রন্থ অবতীর্ণ করতে পারেন, যা এমন সর্বব্যাপী জ্ঞান ধারণ করে যা সকল যুগের মানুষের জ্ঞানকে পরিব্যাপ্ত করে এবং সকল জ্ঞান জগতের ওপর নিরংকুশ শ্রেষ্ঠত্ব রাখে।


মূলঃআল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য[পৃষ্ঠাঃ ১৯৬-১৯৯]

ড. মাজহার কাজি
ভাষান্তর: মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ মুজহিরী
সম্পাদনা: এম মুসলেহ উদ্দিন, মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
অন্যথা পাবলিকেশন


আল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য বইটির সম্পূর্ণ পিডিফ ভার্সন পাওয়ার জন্য এই লিংকে ব্রাউজ করুন: আল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য


Same Label's Other Link:


সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী: স্বপ্নযোগে রাছুলুল্লাহ(সাঃ)-এর নির্দেশলাভ ও এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা

সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী: স্বপ্নযোগে রাছুলুল্লাহ(সাঃ)-এর নির্দেশলাভ 
ও এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা

অনেকদিন আগের কথা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী তখন মিশর ও সিরিয়ার শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী একজন শাসক।
একদিন শেষ রাতে
সুলতান এক অভিনব স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নীল বর্ণের চোখবিশিষ্ট দুই লোককে দেখিয়ে বললেন, ‘নুরুদ্দীন! এই দুষ্ট লোকদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাকে রক্ষা কর।'
এই স্বপ্ন দেখে সুলতানের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অজু করে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। বিছানা ছেড়ে অজু করে নামায পড়লেন তিনি। এরপর দরুদ শরীফ পড়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর একই স্বপ্ন দেখলেন সুলতান। এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলেন তিনি। বিছাড়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। উজীর জামালুদ্দীনকে ডেকে পাঠালেন। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে ছুটে এলেন জামালুদ্দীন। ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতানের দিকে।
সুলতান এবার তার স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। সব শুনে উজির বললেন, ‘জাঁহাপনা! মোটেও দেরি করবেন না। আপনার এক্ষুনি মদীনা শরীফ যাওয়া উচিত। নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাই নবীজী আপনাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিন। আর এই স্বপ্নের কথা কাউকে বলবেন না।'
সেই রাতেই সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে নিলেন উজীর জামালুদ্দীন আর কুড়িজন সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী। একটানা ষোল দিন পথ চলার পর তারা মদীনায় পৌছলেন। উজীর জামালুদ্দীন ঘোষণা করে দিলেন যে, সুলতান নুরুদ্দীন রাসূলের রওজা শরীফ জিয়ারত করতে এসেছেন। তিনি মদীনার জনগণের সঙ্গে দেখা করবেন এবং সবাইকে উপহার দেবেন।
দাওয়াত পেয়ে সবাই এল সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে। সুলতান সবার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং উপহার দিলেন। উপহার দেয়ার সময় সুলতান সেই নীল চোখওয়ালা লোক দু'টিকে খুঁজছিলেন। কিন্তু যারা সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাদের মধ্যে সেই নীল চোখের লোক দু'টি নেই!
সুলতান জানতে চাইলেন, ‘এমন কেউ কি বাকি আছে যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি?' লোকেরা বলল, ‘মদীনার সকলেই আপনার কাছে এসেছে, কেউ বাদ পড়েনি। তবে দু'জন বিদেশী দরবেশ আছেন। তারা মসজিদ ছেড়ে কোথায় যান না। কারও কাছ থেকে কোনো দান-খয়রাতও নেন না। বরং তারাই অভাবি মানুষদেরকে মুক্ত হস্তে দান করেন। ওই দুই বুজুর্গ ব্যক্তিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি।'
এ কথা শুনে সুলতান মনে মনে চমকে উঠলেন। তার চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি নির্দেশ দিলেন সেই দুই বিদেশীকেও হাজির করতে। সুলতানের নির্দেশে সেই দুই দরবেশকেও হাজির করা হলো। তাদের দেখেই সুলতান চমকে উঠলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন-এরাই তো স্বপ্নে দেখা নীল চোখের মানুষ। এরাই রাসূলকে কষ্ট দিচ্ছে।
লোক দুটোকে দেখে সুলতান মনে মনে খুব রেগে গেলেন । কিন্তু তা কাউকে বুঝতে দিলেন না। ধীরকণ্ঠে তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তাদের একজন নম্রভাবে জানালো- আমরা পশ্চিম দেশীয় মুসলমান। হজ্ব করতে এসেছিলাম। হজ্বের পর মদীনায় এসেছি হুজুরের রওজা জিয়ারত করতে।
সুলতান বললেন, শুনলাম তোমরা অনেকদিন থেকেই মদীনা অবস্থান করছো? ভণ্ড দরবেশদের অপরজন বলল- আপনি ঠিকই শুনেছেন। আসলে জিয়ারতে এসে রওজাপাকের মহব্বতে আটকা পড়ে গেছি। তাই প্রিয় নবীর পাশে থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।
এ সময় সুলতান ওদের বাসস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। জানা গেল-রওজা শরীফের কাছেই একটি মুসাফিরখানা। ওখানেই নিরিবিলি একটি কক্ষে বাসা করে ওরা।
সব জানার পর সুলতান হঠাৎ ওদের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সুলতানের কথা শুনে কেমন যেন ভড়কে গেল লোক দুটি। তাদের নীল চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠল। তারা হেসে বলল, জাঁহাপনা কি আমাদের ওপর রাগ করেছেন দাওয়াতে আসিনি বলে? যদি তাই হয় তাহলে আমরা ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এ রকম ভুল আর জীবনে হবে না।
সুলতান ওদের কথায় কান দিলেন না। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সোজা মুসাফিরখানার সেই কক্ষে এসে হাজির হলেন তিনি।
ঘরে ঢুকে সন্দেহ করার মত কিছুই চোখে পড়ল না সুলতানের। দু'একটা সাধারণ আসবাবপত্র ছাড়া আর বই-পুস্তক ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে।
বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন সুলতান। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তার মন বলছে এই ঘরেই কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। মহানবীর দেখানো স্বপ্ন তো আর মিথ্যা হতে পারে না ! এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুলতানের নজর গেল ঘরের এক কোণে যেখানে একটি মাদুরের ওপর সুন্দর করে বিছানো আছে একটি জায়নামাজ। সুলতান সেখানে গিয়ে টান দিয়ে মাদুরটা উঠিয়ে ফেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাদুরের নিচেই একটি মসৃণ পাথর।
পাথরটি সরিয়ে ফেলতেই একটি গভীর সুড়ঙ্গ পথ দেখা গেল। মাটি খুঁড়ে খুব নিপুণভাবে এই সুড়ঙ্গ পথটি তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল-সুড়ঙ্গটিা পবিত্র রওজা শরীফের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছে।
সবার কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেল ভণ্ড দরবেশদের ষড়যন্ত্রের কথা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী ভয়ংকর স্বরে গর্জন দিয়ে বললেন, বল্‌- কেন তোরা এই জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছিস? তোদের পরিচয় কি?
দুই শয়তান কাঁপতে কাঁপতে বলল- আমরা ইউরোপের বাসিন্দা। জাতে খ্রিস্টান। আমাদের রাজা এবং পাদ্রীদের নির্দেশে আমরা এখানে এসেছি।
একটু দম নিয়ে তারা আবার বললে লাগল- "আমাদের এক মহা পরিকল্পনা রয়েছে। চারদিকে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ইসলামী জাগরণ দেখে আমাদের হিংসা হয়। মুসলমানদের কীভাবে অপমান করা যায় সেটাই আমাদের একমাত্র চিন্তা। আমাদের বিশ্বাস মদীনাতে নবীর কবর থাকাতে মুসলমানরা চারদিকেড বিজয় অর্জন করছে। তাই আমরা এসেছি মদীনা থেকে নবীর মরদেহ সরিয়ে ফেলতে অথবা ধ্বংস করে দিতে। এই কাজ করার জন্য আমাদেরকে অনেকদিন ধরে ট্রেনিং দেয়া হয়। এখানে এসে আমরা দরবেশের ছম্মদেব ধারণ করি। প্রচুর দানখয়রাত করে মানুষের মনও জয় করি। তারপর শুরু করি আসল কাজ।"
ওই পাপিষ্ঠদের জবানবন্দিতে আরও জানা গেল, প্রতিদিন গভীর রাতে ওরা খনন কাজ শুরু করত। খনন করা মাটি পানির মশকে ভরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসত। এভাবে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ওরা মহানবীর করবের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
ওই দুই শয়তানের জবানবন্দী শুনে মদীনার লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এভাবে দরবেশের রূপ ধরে তাদেরকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে জানতে পেরে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে গেল। জনগণ দাবি জানাল দুই শয়তানকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হোক। কিন্তু সুলতান তাদেরকে জনগণের হাতে তুলে দিলেন না। তিনি আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। দু'জনের মস্তক বিচ্ছিন্ন করার পর তাদের দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল।
এরপর রওজা শরীফ সুরক্ষার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন সুলতান। কবরের চারপাশে গভীর গর্ত করে সেই গর্তে সীসা, তামা ও লোহা গলিয়ে মজবুত দেয়াল তৈরি করা হল। এভাবে সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা করলেন। 
Source: http://bangla.irib.ir

আল-কুরআন: রাসূলুল্লাহর জীবন্ত মু‘জিযা

আল-কুরআন: রাসূলুল্লাহর জীবন্ত মু‘জিযা

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের 
প্রকাশনায়: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: আল-কুরআন - রাসূলুল্লাহর জীবন্ত মু‘জিযা : এ নিবন্ধে পবিত্র কুরআন ও যুক্তির কষ্টিপাথরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন্ত মু‘জিযা আল-কুরআনের প্রামাণ্যতা ও অকাট্যতা প্রমাণের প্রয়াস চালানো হয়েছে। এটি যে সুরক্ষিত, অবিকৃত ও অপরিবর্তনীয় তাও সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আরবী মু‘জিযা শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘মিরাকল'। একে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যেমন : তা এমন একটি কাজ যাকে প্রকৃতির নিয়মে সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যা করা যায় না। কিংবা তা এমন একটি বিষয় যা মানুষের ক্ষমতা ও সাধ্যের ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ তা এমন একটি ঘটনা যা মানবিক কার্যকারণ ও যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যাত নয়। সুতরাং মু‘জিযা যেহেতু মানুষের ক্ষমতা ও যোগ্যতার আয়ত্বাধীন নয়, তাই তা অবশ্যই সরাসরি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার কর্ম বলেই বিবেচ্য।
একটি মু‘জিযা – আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যক্ষ কাজ হিসেবে- আল্লাহ তা‘আলার সার্বভৌম ক্ষমতা ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রতিফলন ঘটায়। মু‘জিযা মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি একটি উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ। এটি প্রমাণিত ও অনস্বীকার্য সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ব-জাহানের একমাত্র প্রভু। তাই তিনি তাঁর সকল সৃষ্টিকে তাঁরই আনুগত্যের নির্দেশ দেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সাফল্য ও মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যখন কোনো সম্প্রদায়ের কাছে কোনো নবী প্রেরিত হতেন তখন তারা তাঁর কাছে এই দাবি করত, যেন তিনি তাদেরকে মু‘জিযা দেখান। তারা নবী কিংবা রাসূলের আখলাক ও আচরণের প্রতি আগ্রহী ছিল না; সেই বাণীর প্রতিও নয় যা তিনি তাদের জন্য নিয়ে এসেছেন। বিপরীতে তারা অধিক উদগ্রীব ছিল, যাতে তিনি পারলে তাদেরকে কোনো অতি প্রাকৃতিক ব্যাপার দেখিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেন। আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রাসূলই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।
উম্মতের প্রতি সকল নবী-রাসূলের জবাব ছিল একটিই-

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ (188)
‘বল, আমি আমার নিজের কোনো উপকার বা ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা এমন কওমের জন্য, যারা বিশ্বাস করে।‘[সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত : ১৮৮। ]
অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,

قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آَتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا (30) وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ ‎وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا (31)
‘সে বলল, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আর যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও যাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন।‘[সূরা মারইয়াম, আয়াত : ৩০। ]
আরেক স্থানে ইরশাদ হয়েছে,

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ
‘বল, ‘আমি নিজের ক্ষতি বা উপকারের অধিকার রাখি না, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন।‘ [সূরা ইউনুস, আয়াত : ৪৯। ]
যা হোক, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অপরিসীম দয়ায় প্রত্যেক নবী-রাসূলকে বহু মু‘জিযা দান করেন। এভাবে তিনি সব ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের উর্ধ্বে তাঁর নবী-রাসূলগণের বিশ্বাসযোগ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। একদল লোক এসব মু‘জিযাকে জাদু ও ভেলকিবাজি বলে একেবারে উড়িয়ে দিত, আরেকদল লোক যারা তাদের বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি ও সাধারণ বোধের যোগ্যতা কাজে লাগাতেন, তারা নবী-রাসূলের এই অতিপ্রাকৃতিক কর্মসমূহকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মু‘জিযা হিসেবে গ্রহণ করতেন। তারা অনুসরণ করতেন নিজেদের সম্মানিত নবী-রাসূলের বাণীর।
ইতিহাসও আমাদের এ কথা বলে, প্রত্যেক নবী-রাসূল যে সম্প্রদায় বা যে স্থানে প্রেরিত হয়েছিলেন সে সম্প্রদায় ও স্থানের জন্যে তাদেরকে বহু মু‘জিযা প্রদান করা হয়েছিল। একইভাবে এ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রেও সত্য। তিনি অগণিত মু‘জিযা দেখান, যা তার সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রত্যক্ষ করেছিল এবং ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থে তা যথাযথভাবে লিখিত রয়েছে। তাছাড়া তিনি বহু ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যার সবকটিই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত নবী-রাসূলদের মধ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্য নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন কোনো বিশেষ স্থান ও সময়ের জন্য। আর আল্লাহ তা‘আলা এসব নবী-রাসূলকে কিছু বিশেষ মু‘জিযা দান করেছিলেন একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত স্বজাতিকে তা দেখানোর জন্য। এসব মু‘জিযা সময় ও স্থানের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল। মানব ইতিহাসের অংশ হিসেবে আজ কেবল এসব মু‘জিযার গল্প বিদ্যমান। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন সর্বশেষ রাসূল হিসেবে। পুরো মানব জাতির জন্যে এবং আগত পুরো সময়ের জন্যে। যার দাবি, তাঁর থাকবে এমন একটি সার্বজনীন মু‘জিযা যা স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে। মানব ইতিহাসের প্রতিটি যুগের প্রত্যেক ব্যক্তি চাই সে পৃথিবীর যে অংশেই বসবাস করুক না কেন যথার্থই বলতে পারে, যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমানে আমার নবী হন, তাহলে আমি একথা পছন্দ করি যে, আমার জন্য বর্তমানে একটি মু‘জিযা থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির সর্বশেষ রাসূল হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে তাকে যে সার্বজনীন মু‘জিযা দান করেছেন তা-ই আল-কুরআন। পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা আল-কুরআনের বিস্ময়কর প্রকৃতির বিবরণ দিয়ে অসংখ্য পৃষ্ঠা রচনা করেছেন। বস্তুত বিগত চৌদ্দশ বছর ধরে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক প্রজন্মই আল-কুরআনের নতুন নতুন বিস্ময় ও মু‘জিযা আবিষ্কার করেছে। এই অশেষ মু‘জিযা এ কথার শাশ্বত ও স্থায়ী প্রমাণ যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার রাসূল এবং আল-কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরো মানবজাতির জন্যে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত গ্রন্থ।
আল-কুরআনের বিস্ময়কর প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে হলে আমাদেরকে সে স্থান ও কালের দিকে ফিরে দেখতে হবে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৫৭১ ঈসায়ী সনে। তৎকালে মানবিক জ্ঞানের স্তর এতই অধপতিত ছিল যে, ঐতিহাসিকরা একে মানবেতিহাসের ‘আইয়ামে জাহিলিয়া বা বর্বরতার যুগ‘বলে আখ্যায়িত করেন। সেসময় মানুষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ন্যূনতম জ্ঞানও ছিল না। সাধারণ মানুষ জানত না লেখা-পড়া। না আবিষ্কৃত হয়েছিল মুদ্রণের কলা-কৌশল। ফলে যদি কোনো ব্যক্তি একটি নিশ্চিত মানের জ্ঞান অর্জন করত তবে সে একটি মনোনীত দলের লোক বলে গণ্য হত। সেই জ্ঞান প্রচারের কোনো উপায় বা মাধ্যম ছিল না তৎকালে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের মক্কা নামক একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় আরব উপদ্বীপের জীবন ব্যবস্থা ছিল খুব সেকেলে। দেশটি ছিল কান্তার মরু আর অথৈ বালিয়াড়িময়। ছিল না কোনো রাস্তা-ঘাট। না ছিল কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা কৃষিব্যবস্থা। আরব উপদ্বীপের আবহাওয়া এমনকি বর্তমানেও এত উষ্ণ যে, ছায়ার মধ্যেও তাপমাত্রা প্রায়ই ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে। এমন রূঢ় আবহাওয়া এবং দারিদ্রের কারণে আরব উপদ্বীপ বিদেশি বণিক কিংবা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে নি। দেশটি ছিল গোটা বিশ্ব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। ফলে প্রতিবেশি দেশ সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও রোমে যে সামান্য জ্ঞানের চর্চা ছিল তাও আরব উপদ্বীপ অবধি পৌঁছাতে পারে নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাতে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, লোকেরা সেখানে যাযাবরের মত বসবাস করত। তারা তাদের গবাদিপশু ও পরিবারের জন্য বৃষ্টি ও চারণভূমির তালাশে নিয়মিত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হত। সেখানে ছিল না কোনো সরকার কাঠামো। না ছিল কোনো নাগরিক সুবিধা। কোনো সুসংহত নগর-আইনও ছিল না। লোকেরা গোত্রে গোত্রে বসবাস করত। গোত্রের শক্তি ও প্রতিপত্তিই একজন ব্যক্তির ক্ষমতা ও অধিকার হিসেবে বিবেচিত হত। ‘জোর যার মুল্লুক তার‘কেবল এ নীতিই সে ভূখণ্ডে কার্যকর ছিল। অপেক্ষাকৃত শক্তিধর গোত্রগুলি দুর্বল গোত্রদের ওপর প্রায় লুটতরাজ ও লুণ্ঠন চালাত। এটিই ছিল তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। পরন্তু গোত্রের শক্তি-সামর্থ্য নির্ভর করত পুরুষদের সংখ্যার ওপর। আপদ ও বোঝা জ্ঞান করা হত নারীদের। প্রায় অভিভাবই চাইত না এ বোঝা বহন করতে। সেহেতু তারা আত্মজ কন্যাকে হত্যা করত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মকালীন পরিবেশ-প্রতিবেশ ও তৎকালীন অবস্থার উল্লেখ করার পর তাঁর শৈশবকালীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও উল্লেখ করা সমীচীন ভাবছি। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা মারা যান। মাকেও হারান ছয় বছর বয়সে। তারপর তাঁর দেখাশুনার ভার নেন দাদা। কিন্তু তিনিও পরপারে পাড়ি জমান যখন তাঁর বয়স আট হয়। তিনি তখন আপন চাচার ঘরে স্থানান্তরিত হন। এই চাচা কেবল তাঁকে আশ্রয় দান করেছিলেন। তিনি তাঁর জ্ঞান অর্জনে সাহায্য কিংবা জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণে সক্ষম ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাই গবাদি পশু চরিয়ে চাচাকে সহযোগিতা করতেন। যে কেউ দেখতে পাবেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাল্য-জীবন আর দশ জনের মতো ছিল না। পিতা, মাতা কিংবা পিতৃব্যের ভালোবাসা ও আদর-যত্ন বলতে যা বুঝায়, তিনি তা পান নি। ছিল না তাঁর কোনো স্থায়ী কোনো নিবাস। এক অভিভাবক থেকে আরেক অভিভাবকের কাছে হাত বদল হন। এই বিরূপ ও রূঢ় পরিস্থিতির কারণে ন্যূনতম জ্ঞান কিংবা শিক্ষা যা তখন মক্কায় প্রচলিত ছিল- তাও অর্জন করার সুযোগ তাঁর ছিল না।
ঐতিহাসিকরা লিখেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না লিখতে জানতেন, না পড়তে। এমন কি তিনি নিজের নামটি পর্যন্ত স্বাক্ষর করতে জানতেন না। পরন্তু তাঁর জীবনের এমনতরো রূঢ় ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তাঁকে সেসব হাতে গোনা গুটিকয়েক শিক্ষিত লোকদের সাহচর্যে বসারও সুযোগ দেয় নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে মাত্র দু‘বার দীর্ঘ সফর করেছেন। প্রথম সফর ছিল তাঁর আট বছর বয়সে। দ্বিতীয়বার সফর করেন যখন তাঁর বয়স পঁচিশ বছর। উভয়টি ছিল সিরিয়ায় এবং খুব সংক্ষিপ্ত। তাও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। কখনো কোনো ঐতিহাসিক একথা লিখেন নি যে, এই সফরগুলি তাঁকে এমন কিছু জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছিল যা তিনি পরবর্তীতে আল-কুরআনে সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি একজন সাধারণ আরব বেদুঈনের মত খুব সহজ সরল ও সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। একজন জনসমাবেশের বক্তা হিসেবে তিনি না পরিচিত ছিলেন, না একজন কাব্য রচয়িতা হিসেবে। আর না অন্য এমন কোনো কাজ করেছিলেন যা তাঁর প্রতি অন্যান্যদের দৃষ্টি কাড়ে।
তিনি কোনো ধরনের বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ কিংবা যুদ্ধে জড়াতেন না। বলাবাহুল্য, মক্কার লোকেরা মূর্তিপূজা করত এবং যখন তারা কা‘বায় প্রবেশ করত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই বস্ত্র ত্যাগ করত। এ ছিল তাদের প্রার্থনা-রীতির অংশ। এ রকম পরিস্থিতিতে তিনি বেড়ে উঠেন। একটি মাত্র বিষয় যা ঐতিহাসিকরা তার বাল্য জীবন সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছেন তা হল, তিনি তাঁর সততা এবং সদাচারের জন্য সুপরিচিত এবং সবার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার পাত্র ছিলেন। এ জন্যই মক্কার লোকেরা তাঁকে ‘আল-আমীন‘ বা বিশ্বাসী এবং ‘আস-সাদিক‘ বা সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করেন, আল্লাহ তাঁকে পুরো মানব জাতির জন্য সর্বশেষ রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব তখন সহসাই পাল্টে যায়। অচিরেই তাঁকে দেখা যায় নানা সফল ভূমিকায়। ধর্মপ্রচারক, রাষ্ট্রনায়ক, বক্তা, সৈনিক, সেনানায়ক, নেতা, আইন প্রণেতা, বিচারক, চুক্তিসম্পাদনকারী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, স্বামী, পিতা- হেন কোনো ভূমিকা নেই যাতে তিনি ব্যর্থ। সফলতার এমন বহুমুখিতা দেখেই একজন ইয়াহূদী ঐতিহাসিক মাইকেল এইচ হার্ট তার বিখ্যাত ‘দি হান্ড্রেড’ নামক মানবজাতির একশ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনীতে তাঁকে সবার শীর্ষে উল্লেখ করেন।
এই আল-কুরআনই মানবতার প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। মানব জাতির ইতিহাসে যার কোনো তুলনা নেই। অন্যান্য নবী-রাসূলের মু‘জিযা তাদের জীবনকাল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কুরআন মাজিদ কিয়ামত পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন্ত মু‘জিযা হিসেবে অক্ষত থাকবে। আল-কুরআন এমন অসংখ্য তথ্যধারণ করে যা তা অবতীর্ণ হওয়ার সময় মানুষের জানা ছিল না। এসব তথ্যসূত্রের অনেকগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বর্তমানে নিশ্চিত সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বস্তুত প্রত্যেক যুগে মানুষ আল-কুরআনে নতুন নতুন ‘মিরাকল‘বা মু‘জিযা আবিষ্কার করেছে। মানুষের জ্ঞানের পরিধি যতই প্রসারিত হচ্ছে, ততই তা আল-কুরআনের মু‘জিযার তালিকাকে দীর্ঘ করছে।

وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلَا تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ إِذًا لَارْتَابَ الْمُبْطِلُونَ (48)
‘আর তুমি তো এর পূর্বে কোন কিতাব তিলাওয়াত করনি এবং তোমার নিজের হাতে তা লিখনি যে, বাতিলপন্থীরা এতে সন্দেহ পোষণ করবে।‘[সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত : ৮৮। ]

وَمَا كَانَ هَذَا الْقُرْآَنُ أَنْ يُفْتَرَى مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لَا رَيْبَ فِيهِ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (37) أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (38)
‘এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোন সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে। নাকি তারা বলে, ‘সে তা বানিয়েছে’? বল, ‘তবে তোমরা তার মত একটি সূরা (বানিয়ে) নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’[ সূরা ইউনুস, আয়াত : ৩৭-৩৮।]
.......................................................................................................


আল কোরআনের মোজেজা সংক্রান্ত এ ব্লগের আরো ৯টি পোষ্টের জন্য এ লিংকে ব্রাউজ করুন: কোরআনের নিদর্শন (Sign of Quran)


 

এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য