সৌদি আরব:ইসলামী ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
- সম্প্রসাণের কাজ করতে গিয়ে সুকৌশলে ইসলামী ঐতিহ্যের নিদর্শন সমূহ ধ্বংশ করা হচ্ছে
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লোহিত
সাগর, আরব সাগর ও পারস্যোপসাগরের নীল বারিরাশি বাহু বেষ্টনে অবস্থান করছে
এক বিশাল ভূখন্ড, যাকে বলা হয় জাযীরাতুল আরব বা সৌদি আরব। যেখানে রয়েছে
বিশ্ব মুসলিমের প্রাণ কেন্দ্র মসজিদুল হারাম বেষ্টিত বায়তুল্লাহ শরীফ। এটি
পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর। এ সম্পর্কে মহান
আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর কাবা শরীফ (দুই হাজার বছর আগে
কাবা শরীফের স্থানটি) সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এর ফাউন্ডেশন সাত জমীনের নীচ
পর্যন্ত প্রোথিত রয়েছে। বায়তুল্লাহ শরীফের দরজার পাশে রয়েছে হাজরে আসওয়াদ,
বায়তুল্লাহর দরজার ২ গজ ডানে মেঝেতে গেঁথে রাখা কয়েকটি লাল পাথরের সোজা
নীচে হযরত ইব্রাহীম (আ:) কাবার সংস্কারকালে মসল্লা তৈরী করেছিলেন। কাবার
উত্তর পাশে রয়েছে হাতীমে কাবা। এর সোজাসুজি উপরে মিজাবে রহমত। এর ঠিক নীচে
নীল রঙ্গের একটি পাথর ছিল, আর ঠিক এ স্থানেই হযরত ইসমাঈল (আ:)’র কবর শরীফ
এবং তাঁর পূর্বপার্শ্বে মা হাজেরা (আ:) এর কবর শরীফ রয়েছে। এতে রয়েছে জমজম
কূপ, মিম্বরে রাসুলিল্লাহ (দ:) সহ অসংখ্য ইসলামী নিদর্শন। অনুরূপভাবে
ইসলামী ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নববী
শরীফে। এটি ঐ শহর, যাকে উদ্দেশ্য করে হযরত উমর (রা:) বলেন, হে আল্লাহ!
তুমি আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদাতের মৃত্যু দাও এবং তোমার নবীর শহরে আমাকে
মৃত্যু দান করিও। (বুখারী) এ পূণ্যভূমি কেবল উম্মতে মুহাম্মদীর হৃদয়ে স্থান
করে নিয়েছে, এমনটি নয়, বরং স্বয়ং নবীজি (দ:) অধিক পরিমাণে ভালবাসতেন। আর
মহান আল্লাহর দরবারে দো’আ করতেন, হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরে মদিনা শরীফের
ভালবাসা দান করুন যেমন আমরা ভালবাসি মক্কা শরীফকে অথবা এর চাইতে বেশি।
(জাযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব)
প্রতিবছর বিশ্বের প্রত্যেক প্রান্ত থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ আশেকে রাসুল
(দ:) ছুটে যান মক্কা-মদিনার পানে। দিন দিন হাজিদের সংখ্যা ব্যাপকহারে
বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব হাজিদের স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা করতে সম্প্রসারণ
সময়ের দাবি এটি যেমন সত্য। ঠিক তেমনি ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
সমূহ সংরক্ষণ ও রক্ষা করা ঈমানী দায়িত্ব। পবিত্র কুরআন করিমে মহান আল্লাহ
ইরশাদ করেন- “কেউ আল্লাহর নির্দশনাবলীকে সম্মান করলে এটাতো তার হৃদয়ের
তাকওয়ারই বহি:প্রকাশ।’ (হাজ্জ্ব:৩২) ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে, ওসমানী ও
আব্বাসী খেলাফত আমলে মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে
মহান আল্লাহর এ বাণীর প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ সম্পাদন করেছে, যা অব্যাহত ছিল
তুর্কী খেলাফতকাল পর্যন্ত। কিন্তুু দুভার্গ্য হলেও সত্য যে, ১৪৩৪ হিজরী
মোতাবেক ২০১৩ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুলাহ কর্তৃক গৃহিত সম্প্রসারণ প্রকল্প এর
ব্যতিক্রম নীতি অবলম্বন করেছে। যার কারণে এটি বিজ্ঞমহলের নিকট
প্রশ্নবিদ্ধ।
সম্প্রসাণের কাজ করতে গিয়ে সুকৌশলে ইসলামী ঐতিহ্যের নিদর্শন সমূহ ধ্বংশ
করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মসজিদে হারামে মহানবী (দ:) এর মেরাজ তথা উর্ধ্বগমন
যাত্রার স্থানটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং তাঁর জন্মস্থানটিও নিশ্চিহ্ন হতে
যাচ্ছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ডেইলি দি ইনডিপেনডেন্ট’ গত ১৫ মার্চ ‘দ্য
ফটোস সৌদি আরাবিয়া ডাজন’ট, ওয়াল্ট সিন-অ্যান্ড প্রুফ ইসলাম’স মোষ্ট হলি
বেলিকস আর বিং ডিমলিশড ইন মেক্কা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ইনডিপেনডেন্টের হাতে ছবিতে দেখা গেছে, শ্রমিকরা
ড্রিল মেশিন ও যান্ত্রিক খননযন্ত্র দিয়ে কিভাবে মসজিদুল হারামের পূর্ব
পার্শ্বে ওসমানী ও আব্বাসী খেলাফত আমলে স্থাপিত নিদর্শগুলো ধ্বংসের কাজ
শুরু করেছে। অনেক সংস্কার কাজের পরও মসজিদুল হারামে গত কয়েকশ বছরের পুরনো
কয়েকটি স্তম্ভ থেকে যায়। কাবা শরীফকে ঘিরে মারবেল পাথরের নির্মিত মেঝের ঠিক
পরপরই মসজিদুল হারামের এসব কলামের অবস্থান।
ওসমানী ও আব্বাসী খেলাফত আমলে মক্কা শরীফে মসজিদুর হারামে অনেক কলামে
জটিল কিছু আরবীয় ক্যালিওগ্রাফি খোদাই করা হয়েছিল। যাতে মুহাম্মদ (দ:) এর
সাহাবীদের নাম এবং তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলোর কথা উল্লেখ
রয়েছে। এর মধ্যে এমন একটি স্তম্ভ ইতিমধ্যে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে
বিশ্বনবী (দ:) বোরাকের মাধ্যমে রাতের কিছু অংশে উর্ধ্বগমন করে ফিরে
এসেছিলেন।
সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ এই সম্প্রসারণ কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে মসজিদুল
হারামের ইমাম আবদুর রহমান সুদাইসিকে নিয়োগ দিয়েছি। আর এ সম্প্রসারণ কাজের
দায়িত্বে পেয়েছে দেশটির অন্যতম নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সৌদি বিন লাদেন গ্রুপ।
বিজ্ঞ সমালোচকরা সৌদি শাসকদের ইসলামের পবিত্র শহরদ্বয়ে ইসলামের
প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি অনৈতিকভাবে অসম্মান
প্রদর্শন করার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংস্থা গালফ
ইনষ্টিউড এর প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা দেখা যায়, আধুনিকায়নের পথে মক্কায়
হাজার বছরের ৯৫ শতাংশ ভবন কেবল গত দুই দশকেই ইবনে সওদের বংশধরের হাতে ধবংস
হয়েছে। ইসলামের সূচনাকালের নিদর্শন কয়েক ডজন ঐতিহাসিক স্থান এরই মধ্যে
হারিয়ে গেছে। ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষায় কর্তৃপক্ষকে প্রত্নতাত্ত্বিক ও
পন্ডিতদের অব্যাহত তাগাদার মধ্যেই এই ধবংসযজ্ঞও বেড়েই চলেছে। অনতি বিলম্বে
বাইত আল মাউলিদ বা মুহাম্মদ (দ:) এর জন্মস্থানটি ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ইসলামিক হেরিটেজ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. ইরফান আল আলভি
ছবিগুলো দেখার পর বলেন, মসজিদুল হারামের ওসমানী ও আব্বাসী স্তম্ভগুলো
অপসারনের ঘটনাটি ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ মুসলিম প্রজন্ম অনীহা
প্রদর্শন করতে পারে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। কারণ
মসজিদটির নির্দিষ্ট কিছু এলাকার স্তম্ভের দারুণ তাৎপর্য রয়েছে, বিশেষ করে
যেখানে হুজুর (দ:) বসতেন এবং নামাজ আদায় করতেন। এসব ঐতিহাসিক রেকর্ড মুছে
ফেলা হচ্ছে। একজন নতুন মুসলমান কখনই এমন কোন সূত্র খুজে পাবে না, যাতে এসব
জায়গা আবার খুজে বের করা যায়। তিনি আরো বলেন, “মক্কা ও মদিনা সম্প্রসারণ
করতে আপনার কাছে তো অনেক উপায় আছে, যাতে ঐতিহাসিক স্থানও রক্ষা পায়।”
লন্ডন সৌদি দূতাবাসের কাছে যখন ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, মক্কা ও মদিনা
সম্প্রসারণের কাজের ব্যাপারে এবং ঐতিহাসিক স্থানসমূহ কেন সংরক্ষণ করা হচ্ছে
না? ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, কল করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তুু
কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
অথচ নবীদের কর্মকান্ড স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ সংরক্ষণের রীতি নীতি
শিক্ষা দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামীন। যেমন “মকামে ইব্রাহীম” যার উপর
দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ:) কাবাঘর পূর্ণনির্মাণ করেছিলেন। কাবাঘর নির্মাণ
কাজ এসে ইব্রাহীম (আ:) পাথরটি বর্তমানে অবস্থিত জায়গায় স্থাপন করেছিলেন।
পবিত্র কোরআনে একে মকামে ইব্রাহীম বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং নামাজের জায়গা
হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আদেশ করা হয়েছে। আর তাই প্রত্যেক হাজীকে কাবা
শরীফের তাওয়াফ শেষে মকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে
হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা সুষ্পষ্ট হয় যে, হজ্জ্বের প্রত্যেকটি
আহকাম কোন নবী কিংবা কোন পূণ্যবানমনিষীর স্মৃতিচারণ।
আর বিংশ শতাব্দীতে এসে ইসলামী ঐতিহ্য ও নিদর্শন মুছে ফেলা
সুপরিকল্পিতভাবে- এটা নবীবিদ্বেষ ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর মহান আল্লাহ নবী
বিদ্বেষীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে বারণ করে ইরশাদ করেন, [ওহে রাসূল (দ:)]
আপনি আল্লাহ এবং আখেরাতের বিশ্বাসী মুমিন সম্প্রদায়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল
(দ:) এর বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্বস্থাপনকারী রূপে দেখতে পাবেন না।
(মুজাদালাহ:২২)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মালেকী মজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাজ্বী আয়াজ মালেকী
(রা:) তাঁর রচিত শেফা শরীফে বর্ণনা করেন- আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (দ:) এর
প্রতি ভালবাসার অন্যতম নিদর্শন হলো- আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (দ:) এর প্রতি
বিদ্বেষভাব পোষণকারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা এবং তাদের শত্রুদের প্রতি
শত্রুতা পোষণ করা। (শেফা শরীফ, ২য় খন্ড)
পরিপূর্ণ ঈমানদারের পরিচয় দিতে গিয়ে নবী করিম (দ:) ইরশাদ করেন- তোমাদের
মধ্যে কেউ পরিপূর্ণ মুমিনরূপে গণ্য হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নবী তার নিকট
নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুুতি এবং অন্যান্য সকল লোকের চেয়ে অধিকতর
প্রিয়ভাজন হবো না। (ছহীহ বুখারী শরীফ)
অতএব, ওআইসি এবং জাতিসংঘের উচিত বিশ্বের মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র
মক্কা-মদীনা শরীফে ইসলামী ঐতিহ্য ও নিদর্শন বিশেষত রাসূল (দ:) এর স্মৃতি
বিজড়িত স্থান সমূহ সংরক্ষনে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায় বিশ্ব
মুসলিম এর যথার্থ জবাব দিতে প্রস্তুত।