Tuesday, June 11, 2013

বাবরি মসজিদে প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ : নেপথ্য কথা (ভিডিওসহ)



- মো: শরিফুর রহমান

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জায়গা হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদ । কিন্তু ওই ঘর যদি কেউ ভেঙে দেয় তা হবে খুবই নিকৃষ্ট কাজ। বলছিলাম ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদের কথা। এই মসজিদ ভাঙতে প্রথম আঘাত করেছিলেন যে ব্যক্তি তার নাম বলবির সিং। 
কিন্তু মহান আল্লাহ’র অশেষ রহমতে সেই বলবির সিং আজ নওমুসলিম মুহাম্মদ আমের। যে ব্যক্তি একদিন মসজিদ ভেঙে দিয়েছিলে তিনিই এখন পথে পথে ঘুরে আল্লাহ’র ঘর পুনর্নির্মাণ ও নতুন মসজিদ নির্মাণ করছেন। কিন্তু কিভাবে তার এই বদলে যাওয়া, আসুন জেনে নেই।

মুহাম্মদ আমের : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। 
আহমদ আওয়াহ : ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
প্রশ্ন : প্রথমে আপনার পরিচয় দিন।
উত্তর : জন্মসূত্রে আমার নাম বলবির সিং । ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ জেলার এক রাজপুত পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। যেকোনো ধরণের জুলুম-নিপীড়নের বিরোধী ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের সময় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তিনি দেখেছিলেন। সে সময়কার ব্যপক মুসলিম হত্যাকে দেশের জন্য বড় ধরনের কলঙ্ক মনে করতেন তিনি। অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে পুনর্বাসনের ব্যাপারে তিনি খুবই সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের মুসলমান ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখতেন। 
গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে আমি পানিপথে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। মুম্বাইয়ের পর পানিপথ ছিল শিবসেনার সবচেয়ে মজবুত কেন্দ্র। বিশেষ করে যুবক শ্রেণী ও স্কুলের লোকেরা শিবসেনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। অনেক শিবসেনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং আমিও পানিপথ শাখায় আমার নাম লেখাই। 
পানিপথের ইতিহাস তুলে ধরে সেখানকার যুবকদের মধ্যে মুসলিম সম্রাটদের বিরুদ্ধে বিরাট ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ান হতো। আমার বাবা যখন জানতে পারলেন যে, আমি শিবসেনায় নাম লিখিয়েছি তখন তিনি আমাকে ইতিহাসের সূত্র ধরে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। সম্রাট বাবর বিশেষ করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ন্যায় ও ইনসাফ এবং অমুসলিমদের সঙ্গে করা তার আচরণের কাহিনী তিনি আমাকে শোনান এবং আমাকে বলতে চেষ্টা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়কার জুলুম-নিপীড়ন, হত্যা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলী শুনিয়ে আমাকে শিবসেনার যাবতীয় কর্মকান্ড থেকে ফিরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার বাবার সেসব চেষ্টা বিফলে যায়। আমার উপলব্ধিতে কোনো কিছুই ধরা পড়েনি।
প্রশ্ন : ফুলাত থাকাকালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ক্ষেত্রে আপনার অংশগ্রহণের কথা শুনিয়েছিলেন। এবার একটু বিস্তারিতভাবে সে সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন।
উত্তর : ঘটনাটি এ রকম, ৯০ সালে লালকৃঞ্চ আদভানির রথযাত্রায় আমাকে পানিপথের কর্মসূচী সফল করার ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। রথযাত্রায় দায়িত্বশীল নেতারা আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেন। আমি শিবজীর নামে শপথ গ্রহণ করি যে, যাই কিছু ঘটুক না কেন আর কেউ কিছু করুক আর নাই করুক, আমি একাই গিয়ে রাম মন্দিরের ওপর থেকে জুলুম করে চাপিয়ে দেয়া (মসজিদের রূপে) অবকাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ি দেবই। এ যাত্রায় আমার কর্মতৎপরতার ফলে আমাকে শিবসেনার যুব শাখার সহ-সভাপতিনির্বাচিত করা হয়। আমি আমার যুব টিম নিয়ে ৩০ অক্টোবর অযোধ্যায় গিয়ে পৌঁছি। বহু চেষ্টা করেও আমি বাবরি মসজিদের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। এর ফলে আমার শরীরে ঘৃণা ও বিদ্বষের আগুন আরো জ্বলে ওঠে।
আমি আমার সাথীদেরকে বারবার বলছিলাম এরকম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। রামের জন্মভূমিতে আরবদের কারণে রামভক্তদের ওপর গুলি চলবে, এ কেমন অন্যায় ও জুলুম! আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি রাগে ক্ষোভে ফুসছিলাম।কখনো মনে হচ্ছিল যে, আমি নিজেকেই শেষ করে দেই। আমি আত্মহত্যা করি। সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল। আমি সেদিনের জন্য খুবই অস্থির ছিলাম যেন আমার সুযোগ মিলে যায় আর আমি নিজ হাতে বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেই। এভাবে একদিন দু’দিন করে সেই অপেক্ষার দিনটিও কাছে এসে পড়ল, যে দিনটাকে আমি সে সময় খুশির দিন ভাবতাম। আমি আমার কিছু আবেগ-দীপ্ত সাথীকে নিয়ে ৯২ সালের ১ ডিসেম্বর প্রথমে অযোধ্যায় যাই। আমার সাথীদের মধ্যে যোগীন্দর পাল নামে এক যুবক ছিলেন। তার বাড়ি সোনীপথের নিকটবর্তী জাটদের গ্রামে। সে ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার বাবা ছিলেন একজন বিরাট জমিদার। জমিদার হলেও তিনি মানুষকে খ্বু ভালবাসতেন। তিনি তার একমাত্র ছেলেকে অযোধ্যায় যেতে বাধা দেন। তার বড় চাচাও তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কোনো বাধা মানেনি।
আমরা ৬ ডিসেম্বর আগের রাত্রে বাবরি মসজিদের একবারে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছি এবং মসজিদের সামনে কিছু মুসলমানদের বাড়ির ছাদে রাত কাটাই। আমার বারবার মনে হত, না জানি আমাদেরকে ৩০ অক্টোবরের মত আজও এই ‘শুভ’ কাজ থেকে বঞ্চিত হতে হয়! কয়েকবারই মনে হয়েছে, নেতা না জানি কী করেন, আমাদরে নিজেদের গিয়েই কর সেবা শুরু করা উচিত। কিন্তু আমাদের নেতা আমাদেরকে বাধা দিলেন এবং শৃংখলার সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি তার ভাষণ শুনতে শুনতে ঘরের ছাদ থেকে নেমে এলাম এবং কোদাল হাতে বাবরি মসজিদ ভাঙতে অগ্রসর হলাম। 
আমার মনের বাসনা পূরণের সময় এলো। আমি মাঝের গম্বুজটির ওপর কোদাল দিয়ে আঘাত করলাম এবং ভগবান রামের নামে জোরে জোরে ধ্বনি দিলাম। দেখতে না দেখতেই মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। মসজিদ ভেঙে পড়ার আগেই আমরা নিচে নেমে পড়ি। আমরা খুবই আনন্দিত ছিলাম। রাম লীলা লাগানোর পর তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আমারা আমাদের বাড়ি-ঘরে ফিরে এলাম। সাথে করে নিয়ে এলাম মসজিদের দু’টুকরো করে ইট, যা আমরা খুশিমনে আমাদের পানিপথের সাথীদের দেখালাম। তারা আমাদের পিঠ চাপড়ে আমাদের কৃতিত্বে আনন্দ প্রকাশ করল। শিবসেনার অফিসেও দুটি করে ইট রেখে দেয়া হয়। এরপর এক বিরাট সভা হয় এবং সকলেই তাদের বক্তৃতায় অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। আমি আমার বাড়ি গিয়েও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গ একথা বলে ছিলাম।
আমার বাবা খুব অসন্তুষ্ট হন। এ ব্যাপারে তার গভীর দুঃখের কথা জানিয়ে আমাকে পরিষ্কার বলে দেন, এখন এই ঘরে আমি আর তুমি দু’জনে এক সঙ্গে থাকতে পারি না। তুমি থাকলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, নইলে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। মালিকের ঘর যে ভেঙেছে আমি তার মুখ দেখতে চাই না। আমার মৃত্যু পর্যন্ত তুমি তোমার মুখ কখনো আমাকে দেখাবে না। আমি ধারণাও করতে পারিনি এমনটা ঘটবে। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। তিনি আমাকে এও বলেন যে, এ ধরণের জালিমদের কারণে এদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশেষে রাগে-ক্ষোভে তিনি বাড়ি ছেড়ে যেতে উদ্যত হলেন। আমি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললাম, আপনি বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। আমি নিজেই আর এ বাড়িতে থাকতে চাই না, যেখানে একজন রাম মন্দির ভক্তকে জালিম মনে করা হয়। এরপর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসি এবং পানিপথে থাকতে শুরু করি।
প্রশ্ন : আপনি আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কিছু বলুন?
উত্তর : প্রিয় ভাই আহমদ! আমার আল্লাহ কত মেহেরবান ও দয়ালু। তিনি চাননি আমি জুলুম ও শিরকের অন্ধকারে হাবুডুবু খাই। যিনি আমাকে ইসলামের নূর ও হেদায়েত দ্বারা ধন্য করেছেন। আমার মত জালিম যে কিনা তার পবিত্র ঘরকে ভেঙেছে সে-ই তাকে হেদায়েত দানে ধন্য করেছেন। 
ঘটনা ছিল, আমার বন্ধু যোগিন্দর বাবরি মসজিদের কিছু ইট এনে রেখেছিল এবং মাইক দিয়ে ঘোষনা দেয় যে, ইটগুলো রামমন্দিরের ওপর নির্মিত অবকাঠামোর। সৌভাগ্যক্রমে তা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। সমস্ত হিন্দু ভাই যেন এর ওপর পেশাব করে। আর কী! ঘোষণা হতেই ভিড় লেগে গেল। 
এবার মসজিদের যিনি মালিক তার ক্ষমতা প্রদর্শনের পালা। চার-পাঁচ দিন পর যোগিন্দরের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। সে পাগল হয়ে যায়, সম্পূর্ণ উলঙ্গ থাকতে শুরু করে। পরনে আদৌ কাপড় রাখত না। সম্মানিত জমিদার চৌধুরীর একমাত্র ছেলে ছিল সে। তার বাবা এতে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। ছেলের সুচিকিৎসার জন্য সাধু-সন্ন্যাসী ও আলিম-ওলামা দেখান। বার বার মহান মালিকের কাছে মাফ চাইতে থাকেন। দান খয়রাত করতে থাকেন। কিন্তু তার অবস্থার উন্নতি না হয়ে বরং খারাপই হতে থাকে। একদিন তিনি বাইরে যেতেই সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। মা চিৎকার করতে শুরু করলে মহল্লাবাসী ছুটে এসে তাকে রক্ষা করে। এরপর থেকে তাকে শেকলে বেধে রাখা হয়। যোগীন্দরের বাবা ছিলেন খুবই সম্মানিত লোক। তিনি এই ঘটনা শুনে ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এমন সময় কেউ তাকে বলে যে, এখানে সোনিপথে ঈদগাহের পাশে একটি মাদরাসা আছে। ওখানে একজন বড় মাওলানা সাহেব এসে থাকেন। একবার গিয়ে তার সঙ্গে আপনি দেখা করুন। এরপর যদি কিছু না হয় তখন যা হয় করবেন।
তিনি সোনীপথে যান। গিয়ে জানতে পারেন, মাওলানা সাহেব মাসের এক তারিখে আসেন। বিগত পরশু এসে পরদিন চলে গেছেন। 
মাদ্রাসার ইমাম সাহেব তাকে বলেন যে, অবস্থা খারাপ হবার দরুণ ৬ ডিসেম্বরের আগে হরিয়ানার বহু ইমাম এখান থেকে উত্তর প্রদেশে চলে গিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক মাস পর্যন্ত ফিরে আসেননি। এ জন্য মাওলানা সাহেব ১ তারিখে এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন এবং বক্তৃতায় বিরাট জোর দিয়ে একথা বলেন যে, মুসলমানরা এসব অমুসলিম ভাইকে যদি ইসলামের দাওয়াত দিতেন তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্ম হতো না। তিনি বলেন যে, বাবরি মসজিদ ভাঙার জিম্মাদার একদিক থেকে আমারা মুসলমানরাও। আর এখনও যদি আমাদের হুঁশ হয় এবং আমরা যদি দাওয়াতের হক আদায় করতে থাকি তাহলে এই মসজিদ যারা ভেঙেছে, তারা মসজিদ নির্মাতা হতে পারে। হতে পারে তারাই মসজিদের খাদেম।
মাদ্রাসার ইমাম সাহেব যোগীন্দরের বাবাকে বলেন, আমি ঝাড়-ফুঁক করতাম। কিন্তু আমাদের হযরত মাওলানা আমাকে একাজ করা থেকে থামিয়ে দিয়েছেন। কেননা একাজে অনেক সময় মিথ্যা বলতে এবং মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। আর আপনার ছেলের ওপর তো কোনো জাদু কিংবা জিন-ভুতের আছরও নেই বরং এ তো সেই মালিকের আযাবের ফল। আপনার জন্য একটি সুযোগ আছে। মাওলানা সাহেব আগামী পরশু বুধবার দুপুরে এখানে আসছেন। আপনি তখন তার সঙ্গে দেখা করুন এবং আপনার কথা তাকে বলুন। আপনার ছেলে আশা করি ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাকে একটি কাজ করতে হবে আর তা হলো, আপনার ছেলে যদি ভালো হয়ে যায় তবে আপনাকে মুসলমান হতে হবে। চৌধুরী সাহেব বললেন, আমার ছেলে ভালো হয়ে গেলে আমি সবকিছু করার জন্য তৈরি আছি।
বুধবার সকালে যোগীন্দরের বাবা ছেলেকে নিয়ে সেই মাদ্রাসায় গিয়ে মাওলানা সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দুপুর বেলা যোহরের আগেই মাওলানা সাহেবের আগমন ঘটে। শেকলে বাধা যোগিন্দর সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় দাঁড়ানো। চৌধুরী সাহেব কাঁদতে কাঁদতে মাওলানা সাহেবের পায়ে ওপর পড়ে যান এবং বলতে থাকেন, মাওলানা সাহেব! আমি এই আহম্মকটাকে খুবই ঠেকাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে পানিপথের এক কুচক্রীর চক্রান্তে পড়ে। মাওলানা সাহেব! আমার ওপর দয়া করুন। আমাকে মার্জনা করে দিন। আমার ঘর বাঁচান। মাওলানা সাহেব কঠোর ভাষায় তাকা মাথা তুলতে বলেন এবং পুরো ঘটনা শোনেন।
তিনি চৌধুরী সাহেবকে বলেন যে, সমগ্র জগত সংসার নিয়ন্ত্রণকারী সর্বশক্তিমান আল্লাহর ঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে তারা এত বড় পাপ করেছে এবং এত বড় জুলুম করেছে যে, যদি তিনি গোটা বিশ্বচরাচর ধ্বংস করে দেন তাহলে তা যথার্থ হবে। এতো বরং কমই হয়েছে যে, এই পাপের বোঝা কেবল একাকী তার ওপর পড়েছে। আমরাও সেই সর্বশক্তিমান মালিকের বান্দা এবং এক দিক থেকে এই বিরাট পাপের অংশীদার আমরাও। আর তা এই দিক দিয়ে যে, আমরা তাদেরকে বোঝাবার হক আদায় করিনি যারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে। এখন আমাদের আয়ত্বে আর কিছুই নেই। আমরা কেবল এতটুকু করতে পারি যে. আপনি সেই মালিকের সামনে কাঁদেন এবং তার কাছে ক্ষমা চান। আর আমরাও ক্ষমা চাই।
এরপর মাওলানা সাহেব বললেন, মসজিদের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি মালিকের কাছে অন্তর দিয়ে মাফ চান। প্রার্থনা করতে থাকুন যে, মালিক! আমার বিপদ কেবল আপনিই দূর করতে পারেন, আর কেউ দূর করতে পারে না।
মাওলানা সাহেব মসজিদে গেলেন। নামায পড়লেন। অল্প সময়ের জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে বক্তৃতাও দিলেন এবং দোয় করলেন। মাওলানা সাহেব সকলকেই যোগিন্দর ও তার বাবার জন্য দোয়া করতে বললেন। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর মসজিদে নাশতা হল। নাশতা থেকে মুক্ত হবার পর মসজিদ থেকে বরে হতেই আল্লাহর কী মেহেরবানি দেখুন, যোগীন্দর তার বাবার মাথা থেকে পাগড়ি টেনে নিয়ে তার উলঙ্গ শরীর ঢাকল এবং দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো তার বাবার সাথে কথা বলতে লাগল। সকলেই এ দৃশ্য দেখে আনন্দিত হলেন। 
মাদ্রাসার ইমাম সাহেব যোগীন্দরের বাবাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং বললেন, যেই মালিক তাকে ভালো করে দিয়েছেন, আপনি যদি ওয়াদা মাফিক মুসলমান না হও তাহলে সে আবার এর চেয়েও মারাত্মক পাগল হতে পারে। 
এরপর যোগীন্দরের বাবাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হতেই যোগিন্দর জিজ্ঞেস করল, বাবা! আপনি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, মুসলমান হতে। তখন যোগিন্দর বলল, আমাকে তো আপনার আগে মুসলমান হতে হবে এবং আমাকে বাবরি মসজিদ পূর্ণবার অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। তারপর তারা উভয়ে খুশি মনে ওযু করলেন। তাদেরকে কলেমা পড়ানো হল। বাবার নাম মুহাম্মদ উসমান এবং ছেলের নাম মুহাম্মদ ওমর রাখা হল। এরপর তারা খুবই খুশি হয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেলেন। গ্রামে একটি ছোট মসজিদ ছিল। তারা মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ইমাম সাহেব স্থানীয় মুসলমানদেরকে তাদের বাপ বেটার মুসলমান হবার কথা জানিয়ে দিলেন। ফলে একজন দু’জনের কান থেকে গোটা এলাকায় একথা ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দুদের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে এলাকার প্রভাবশালী হিন্দুদের এ নিয়ে মিটিং হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাদের দু’জনকেই রাতের বেলা মেরে ফেলতে হবে। অন্যথায় তাঁরা অনেক লোকের ধর্ম নষ্ট করে দেবে। তাদের এই মিটিংয়ে একজন ধর্মত্যাগী উপস্থিত ছিল। সে ইমাম সাহেবকে গোপনে তাদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দেয়। ফলে আল্লাহর মেহেরবানিতে রাতের অন্ধকারে তাদেরকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা ফুলাত গিয়ে পৌঁছেন। পরে তাদেরকে ৪০ দিনের জন্য তাবলিগ জামায়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর আমীর সাহেবের পরামর্শে যোগীন্দর (ওমর) তিন চিল্লাও দেয়। পরে যোগীন্দরের মা-ও মুসলমান হয়ে যায়।
এরপর মুহাম্মদ ওমরের (যোগিন্দর) বিয়ে হয় দিল্লীর এক ভালো মুসলিম পরিবারে। এখন তারা বেশ আনন্দের সঙ্গেই দিল্লিতে সপরিবারে বসবাস করছেন। গ্রামের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি সব বিক্রি করে তারা দিল্লীতে একটি কারখানা দিয়েছেন।
প্রশ্ন : মাস্টার সাহেব! আমি আপনাকে আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনি কিভাবে মুসলমান হলেন? আপনি যোগীন্দরের ও তার পরিবারের (মুসলমান হবার) কাহিনী শোনালেন। যদিও তা খুবই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর, কিন্তু আমি তো আপনার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাই, কিভাবে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন সে সম্পর্কে।
উত্তর : প্রিয় ভাইটি আমার! আসলে আমার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এর থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। এজন্য আমি এর প্রথম অংশ শোনালাম। এখন দ্বিতীয় অংশ শুনুন।
১৯৯৩ সালের ৯ মার্চ আমার বাবা হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়া এবং তাতে আমার অংশ গ্রহণ তাকে খুবই আঘাত দিয়েছিল। তিনি প্রায়ই আমার মাকে বলতেন, মালিক আমাকে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম দিলেন না কেন? আমি যদি মুসলমানদের ঘরে জন্ম নিতাম তাহলে অন্তত জুলুম-নিপীড়ন সহ্যকারীদের তালিকায় আমার নাম থাকত। তিনি আমার পরিবারের সদস্যদের বলে গিয়েছিলেন, আমি মারা গেলে আমার লাশের কাছে যেন বলবীর না আসে, প্রথা ও রেওয়াজ মাফিক আগুনে যেন পোড়ানো না হয়। হিন্দুদের শ্মশানে যেন না নেয়া হয়। পরিবারের লোকেরা তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ি সব কিছু করে। আট দিন পর আমি আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পাই। এত আমার মন ভেঙে যায়। তার মৃত্যুর পর বাবরি মসজিদ ভাঙা আমার কাছে জুলুম মনে হতে থাকে এবং গর্বের বদলে আফসোস হতে থাকে। আমার অন্তর যেন হঠাৎ দ্প কের নিভে যায়। আমি বাড়ি গেলে মা আমার বাবার কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকেন এবং বলতে থাকেন এমন একজন ভালো মানুষকে তুই কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললি! তুই কতটা নিচ ও হীন জাতের মানুষ। মায়ের এ ধরনের আচারণের কারণে আমি বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেই।
জুন মাসে মুহাম্মদ ওমর (যোগিন্দর) তাবলিগ জামায়াত থেকে ফিরে এলো। সে পানিপথে আমার সঙ্গে দেখা করল এবং তার পুরো ঘটনা আমাকে বলল। বিগত দু’মাস থেকে আমার মন সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত, না জানি কোনো আসমানি বালা-মুসবিত আমার ওপর এসে পড়ে। বাবার দুঃখ ও মনোকষ্ট এবং বাবরি মসজিদ ভাঙার দরুন আমার মন সব সময় খারাপ থাকত। মুহাম্মদ ওমরের কথা শুনে আমি আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। 
ওমর ভাই আমাকে বললেন, আমি যেন ২৩ জুন সোনিপথে মাওলানা সাহেবের সাথে গিয়ে অবশ্যই দেখা করি। আরো ভালো হয় যদি তার সঙ্গে আমি কিছু দিন থাকি। আমি প্রোগ্রাম বানালাম। কিন্তু পৌঁছতে আমার কিছুটা দেরি হয়। ওমর ভাই আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল এবং মাওলানা সাহেবকে আমার অবস্থা সম্পর্কে সব বলেছিল। আমি সেখানে গেলে মাওলানা সাহেব আমাকে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন, যোগিন্দরের সঙ্গে সর্বময় মালিক যা করেছেন আপনার সঙ্গেও একই রূপ ব্যবহার করা হতে পারে। আর মালিক যদি এই জগতে শাস্তি নাও দেন তাহলে মৃত্যুর পর চিরস্থায়ী জীবনে যেই শাস্তি মিলবে আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না।
এক ঘন্টা মাওলানা সাহেবের সাথে থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আসমানি বালার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে । মাওলানা সাহেব দু’দিনের জন্য বাইরে কোনো সফরে যাচ্ছিলেন। আমি তার সাথে যেতে চাইলাম। তিনি খুব খুশি হয়েই অনুমতি দিলেন। 
একদিন হরিয়ানা, এরপর দিল্লী ও খোর্জার সফর ছিল। দু’দিন পর তিনি ফুলাত ফিরে এলেন। এ দু’দিন আমার মন ইসলাম গ্রহণের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি ওমর ভাইকে আমার ইচ্ছার কথা বললাম। সে খুব খুশি হয়ে মাওলানা সাহেবকে তা জানাল। আলহামদুলিল্লাহ! ২৫ জুন ১৯৯৩ যোহর নামাযের পর আমি ইসলাম কবুল করি। মাওলানা সাহেব আমার নাম রাখেন মুহাম্মদ আমের। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা এবং নামাযের নিয়ম-কানুন ও দরকারি মাসলা-মাসায়েল শেখার জন্য তিনি আমাকে কিছুদিন ফুলাত থাকার পরামর্শ দিলেন। আমি আমার স্ত্রী ও ছোট বাচ্চাদের সমস্যার কথা বললে তিনি বাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি কয়েক মাস ফুলাত এসে থাকলাম এবং আমার স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কাজ করতে থাকি। তিন মাস পর আলহামদুলিল্লাহ! আমার স্ত্রীও মুসলমান হয়ে যায়।
প্রশ্ন : আপনার মা’র কী হলো?
উত্তর : আমি আমার মাকে মুসলমান হবার ব্যাপারে জানালে তিনি খুব খুশি হন এবং বলেন, তোর বাপের আত্মা এতে শান্তি পাবে। আমার মাও ঐ বছরেই মুসলমান হন।
প্রশ্ন : এখন আপনি কি করছেন?
উত্তর : বর্তমানে আমি একটি জুনিয়র হাইস্কুল চালাচ্ছি। স্কুলে ইসলামী শিক্ষার সাথে সাথে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে।
প্রশ্ন : আব্বা বলছিলেন, আপনি হরিয়ানা, পাঞ্জাবসহ বিভিন্না জায়গায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদগুলো পুনরায় চালু করার জন্য চেষ্টা করছেন?
উত্তর : ওমর ভাইয়ের সাথে মিলে আমরা ঠিক করেছি আল্লাহর ঘর ভেঙে আমরা যে বিরাট গুনাহ করেছি তার কাফ্ফারা হিসাবে আমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদগুলো চালু করব এবং নতুন নতুন মসজিদ বানাব। আমরা দু’জনে মিলে আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিব। আমি বন্ধ মসজিদগুলো চালু করব আর ওমর ভাই নতুন নতুন মসজিদ বানাতে চেষ্টা চালাবেন। এ ব্যাপারে মসজিদ বানাবার ও সেগুলো লোকে ভরপুর করাবার কর্মসূচি হাতে নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! এ পর্যন্ত আমি হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি ও মিরাট সেনানিবাস এলাকায় ১৩টি বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদ পুনরায় চালু করেছি। ওমর ভাই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত সে ২০টি মসজিদ তৈরি করেছে এবং একুশতম মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। আমরা উভয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবরি মসজিদ ভাঙার বার্ষিকীতে ৬ ডিসেম্বর তারিখে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদে অবশ্যই নামায শুরু করাতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আজ পর্যন্ত কোন বছরেই এটা করতে ব্যর্থ হইনি। অবশ্য শ’য়ের লক্ষ্য পূরণ এখনও অনেক দূরে। আশা করছি এবছর এর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। আটটি মসজিদ সম্পর্কে কথাবর্তা চলছে। আশা করি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলো চালু হয়ে যাবে। ওমর ভাই অনেক আগেই তো লক্ষ্য অর্জনে আমার চেয়ে এগিয়ে আছে। আর আসলে আমার কাজও তো তারই ভাগে পড়ে। আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার মাধ্যম তো মূলত সেই।
প্রশ্ন : পাঠকদের জন্য আপনি কি কিছু বলবেন?
উত্তর : সকল মুসলমানের কাছে আমার একটিই নিবেদন আর তা হলো, নিজের জীবনের লক্ষ্য কী তা জেনে এবং ইসলামকে মানবতার আমানত মনে করে একে মানুষের কাছে পৌঁছে দিই, পৌঁছে দেবার কথা ভাবি। কেবল ইসলামের প্রতি দুশমনীর কারণে তার থেকে বদলা নেবার প্রতিশোধ গ্রহণে উৎসাহিত না হই। আহমদ ভাই! আমি একথা একেবারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাবরী মসজিদ ভাঙায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক শিবসেনা, বজরং দলের সদস্যসহ সকল হিন্দু যদি এটা জানত যে, ইসলাম কী! মুসলমান কাকে বলে? কুরআনুল করিম কী? মসজিদ আসলে কোনো বস্তুর নাম, তাহলে তাদের সবাই মসজিদ নির্মাণের কথা ভাবতে পারত, মসজিদ ভাঙার প্রশ্নই উঠতো না। আমি আমার প্রবল প্রত্যয় থেকে বলছি, বাল থ্যাকার, উইরে কুঠিয়ার যদি ইসলামের প্রকৃত সত্য ও মর্মবাণী জানতে পারে এবং জানতে পারে যে, ইসলাম (কেবল মুসলমানদের নয়) সবার ধর্ম, এটি আমাদের দরকার তাহলে তাদের প্রত্যেকেই নিজ খরচে বাবরী মসজিদ পূণর্বার নির্মাণ করাকে নিজেদের সৌভাগ্য ভাববে।
আহমদ ভাই! সে যাকগে, কিছু লোক তো এমন আছে যারা মুসলমানদের প্রতি শত্রুতায় বিখ্যাত, কিন্তু এখন এক শ' কোটি হিন্দুর মধ্যে এমন এক লাখও হবে না। সত্য কথা বলতে কী, আমি বোধহয় বাড়িয়ে বলছি, ৯৯ কোটি ৯৯ লাখ লোক তো আমার বাবার মতো, যারা মানবতার বন্ধু এবং ইসলামী রীতিনীতি অন্তর দিয়েই পছন্দ করে। আহমদ ভাই! আমার বাবা (কাঁদতে কাঁদতে) কী স্বভাবগতভাবে মুসলমান ছিলেন না? কিন্তু মুসলমানরা তাকে দাওয়াত না দেবার কারণে তিনি কুফরি অবস্থায় মারা গেছেন। 
মাওলানা সাহেব সত্য বলেছেন, আমরা যারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছি তারা না জানার কারনে এবং মুসলমানদের না চেনার কারণে এমন জুলুম করেছি। আমরা অজানা ও অজ্ঞতার দরুণ ও ধরনের জুলুম করেছি। আমার পিতার কুফরি অবস্থায় মারা যাবার কথা যখন রাত্রে মনে হয় তখন আমার ঘুম পালিয়ে যায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘুম আসে না। ঘুমের জন্য আমাকে ওষুধ খেতে হয়। হায়! মুসলমানদের যদি এই ব্যাথার অনুভূতি হতো! আল্লাহ হাফেজ।
সূত্র : মাসিক আরমুগান পত্রিকা

Monday, June 10, 2013

জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান

জ্যোতির্বিজ্ঞান হচ্ছে পৃথিবীর বাইরের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুসমূহ (Astronomical/ Celestial Objects), যেমন- গ্রহ (Planets), নক্ষত্র (Stars), ধূমকেতু (Comets), নীহারিকা (Nebula), নক্ষত্রপুঞ্জ (Star Clusters), ছায়াপথ (Galaxy), প্রভৃতি এবং বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা (Astronomical Phenomenon) সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
অন্যদিকে জ্যোতিষশাস্ত্র হলো কিছু পদ্ধতি, প্রথা এবং বিশ্বাসের সমষ্টি যাতে মহাকাশে জ্যোতিষ্কসমূহের আপেকি অবস্থান এবং তৎসংশ্লিষ্ট তথ্যাদির মাধ্যমে মানব জীবন, মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং মানবীয় ও বহির্জাগতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় প্রাচীনকালের বিজ্ঞানীদের মাঝে এই দুই শাস্ত্রের সমান্তরাল চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। তবে বিজ্ঞানের অনগ্রসরতা, গোঁড়ামি এবং সাধারণ মানুষের বিজ্ঞানবিমুখিতা গ্রহ-নত্রের পাঠকে ঠিক মতো বৈজ্ঞানিক ধারায় চালিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। মুসলমানদের মাঝেও এই দুই শাস্ত্রের চর্চা প্রথম শুরু হয়। উনারা এই চর্চাকে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের পর্যায়েই উন্নীত করেননি, বরং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্ব ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে একে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, যা এক কথায় অভূতপূর্ব। কেমন করে এটি সম্ভব হলো, তা নিয়ে আলোচনা থাকছে এখন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের আবিষ্কার এবং অর্জন এত ব্যাপক এবং এত বেশি সময় ধরে বিস্তৃত যে, স্বল্প পরিসরে তার বর্ণনা দিতে গেলে অনেক তথ্যই হয়তো বাদ পড়ে যাবে। তারপরেও স্থানাভাবে এখানে কেবলমাত্র একেবারেই বর্ণনা না করলেই নয়, এমন আবিষ্কার নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে। সন্দেহ নেই, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো আরবেও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা সুপ্রাচীনকাল হতেই চলে আসছিল। এছাড়া, পেশাগত জীবনে ব্যবসায়ী এমন আরববাসীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল না। ফলে, স্থল ও জলপথে বাণিজ্য পরিচালনাকালে আকাশের তারকা দেখে পথনির্দেশনা লাভের বিদ্যা নিশ্চয়ই কিছু পরিমাণে ছিল না? কিন্তু, এই জ্ঞান ও এর চর্চা দিয়ে আর যাই হোক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব ছিল। প্রথম যাত্রা শুরু হয়, অত্যন্ত স্বল্প সময়ে একটি বিশাল ভূখণ্ড (প্রায় ১৩,০০০,০০০ বর্গকিলোমিটার) মুসলমানদের অধিকারে এসে যাওয়ার পর। এই বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত মুসলমানদের ইসলামী সব বিষয়ই সরাসরি চন্দ্র-সূর্য এবং দিকের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ সমস্যা সমাধান করতে গিয়েই জ্যোতির্বিদ্যার বৈজ্ঞানিক চর্চার সূত্রপাত এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সকল মুসলমান বিজ্ঞানী আর যে েেত্রই অবদান রাখুন না কেন, চেষ্টা করেছেন এ বিষয়ে অবদান রাখতে। উনারা একের পর এক অনুবাদ করেছেন, গবেষণা চালিয়েছেন, জিজ্ (তল) লিখেছেন। উল্লেখ্য যে, জ্যোতির্বিদ্যার উপর মুসলমানদের লিখিত বইগুলো জিজ্ নামেই বেশি পরিচিত।
স্পষ্টতইঃ নানান অঞ্চলের নানান ভাষার জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থের আরবী অনুবাদ দিয়ে শুরু পথ চলা। এেেত্র প্রথমেই যে নামটি আসে, তা হচ্ছে ইয়াকুব ইবনে তারিক। তিনি এবং আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহিম আল-ফাজারী মিলিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করে ‘আজ জিজ্ আল-মাহ্লুল মিন আস্-সিনহিন্দ্ লি-দারাজাত্ দারাজা’ রচনা করেন। অবশ্য, কাজের শুরুটা করেন পূর্বোক্ত মুহাম্মাদ আল ফাজারীরই পিতা ইব্রাহীম আল ফাজারী। এর সাথে সাথে গ্রীক ‘আল-ম্যাজেস্ট’(ল্যাটিন- Almagest; আরবী, al-kitabul-mijisti) এবং এলিমেন্টস্ (Elements)সহ অন্যান্য গ্রন্থ একের পর এক আরবীতে অনূদিত হতে থাকায় প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ঘুমিয়ে থাকা জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভাণ্ডার একসাথে যেন মুসলমানদের সামনে খুলে যায়। এর পরেই এেেত্র আবির্ভূত হন বিজ্ঞানের জগতের সর্বকালের এক মহান দিকস্রষ্টা আবু আব্দুল্লাহ্ মুহম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজ্মি, গণিতে যাঁর অবদানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানেও এই গণিতবিদের মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। উনার রচিত ‘জিজ্ আল-সিন্দ্হিন্দ্’ (তল Al-Sindhind- Astronomical tables of Sind and Hind) এেেত্র এক অনন্যসাধারণ গ্রন্থ যাতে তিনি প্রায় ৩৭টি অধ্যায় এবং ১১৬টি ছক সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করেছেন। উনার রচনায় ভারতীয় উৎস হতে অবাধে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং ব্যবহার করেছেন। চন্দ্র, সূর্য ও সে আমলে জানা পাঁচটি গ্রহের গতিবিধি, চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, ঋতু পরিবর্তন নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একই সময়ে আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ হাবাশ আল-হাসিব আল মারওয়াজি উনার The Book of Bodies and Distances গ্রন্থে পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের পরিধি, ব্যাস ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হিসেব করেন। আবু আল-আব্বাস আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে কাসীর আল-ফারগানী হচ্ছেন সেসময়ের পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ। তিনি ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে আল-ম্যাজেস্টের সংপ্তি ভাষ্য লিখেন যা দ্বাদশ শতকে Elements of astronomy on the celestial motions শিরোনামে ল্যাটিনে অনূদিত হয় এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমসাময়িককালে আরো যাঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তাঁদের মধ্যে সাবিত ইবন্ েক্বরাহ্, জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আবু মাশার আল-বল্খী এবং বনু মুসা ভ্রাতৃত্রয়ের অগ্রজ আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবন্ েমুসা আল-শাকির নাম নিতেই হয়।
এতণ পর্যন্ত যে সব তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রধানত টীকা-ভাষ্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু, এর পরে যা হলো তা এক কথায় অভূতপূর্ব। সময়ের অতি স্বল্প পরিসরে মুসলমানদের মাঝে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা এত বেশি যে, মাঝে মাঝে রূপকথা কিংবা অতিকথন মনে হয় অনেকের!
এেেত্র প্রথমেই যিনি আসেন তিনি আবু আব্দুল্লাহ, মুহাম্মাদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল-বাত্তানী। মুসলমানদের বিজ্ঞানের ইতিহাসে উনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদও বলেন কেউ কেউ। কোন প্রকার টেলিস্কোপের সাহায্য ছাড়াই কেবল খালি চোখের পর্যবেণ এবং গণিতের প্রয়োগে তিনি সে সময়েই এক সৌর বছরের (One Solar Year) মান হিসেব করেন, যার সাথে আজকের দিনের আধুনিকতম হিসেবের (৩৬৫দিন ৫ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড) সাথে মাত্র তিন মিনিটের গরমিল পাওয়া গিয়েছে। তিনিই আপন অে পৃথিবীর ঝুঁকে থাকার পরিমাণ হিসেব করেন, যা আধুনিক হিসেবের সাথে মাত্র অর্ধডিগ্রি বেশি! ৫৭টি অধ্যায় সম্বলিত উনার ‘আল-জিজ্ আল-সাবী’ একটি অসাধারণ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সংকলন যা ষোড়শ’ শতকে De Motu Stellarum নামে ল্যাটিনে অনূদিত হয় এবং পাশ্চাত্য জ্যোতির্বিদ্যার উত্তরণে সরাসরি অবদান রাখে। তারপরেও, তিনি সেই তিনি দুর্ভাগা বিজ্ঞানীত্রয়ের একজন কোপার্নিকাসের সৌর মডেলে যাঁদের অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপো করা হয়েছে।
মুসলিম দর্শনের অন্যতম পুরোধা আবু নার্স আল-ফারাবী জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকেও হাত বাড়িয়েছিলেন। তবে, গ্রীকবিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত উনার দার্শনিক পরিচয়ের নিচে সে সব অবদান খুব বেশি মাথা তুলতে পারে নি। আবদুর রহমান আল-সুফী সে সময়ের আরেক প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ। Book of Fixed Stars উনার অমর গ্রন্থ। আমাদের আকাশগঙ্গা (Milky Way) ছায়াপথের সবচেয়ে নিকটবর্তী ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডা (Andromeda) আবিষ্কারের কৃতিত্ব অনেকে উনাকেই দিয়ে করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে একটি অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্র অ্যাস্ট্রোল্যাবের (Astrolabe) অন্ততঃ ১০০০টি ভিন্নধর্মী ব্যবহার তিনি বর্ণনা করেন। আবু মাহমুদ খুজান্দী নিজের মতো করে পৃথিবীর ঝুঁকে থাকার পরিমাণ (Axial Tilt) হিসেব করেন যা ফারাবীর কাছাকাছিই আসে। উনার বিস্তৃত কাজের বিবরণ পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নাসিরউদ্দীন তুসীর লেখায়। তবে, ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে উনার যে আবিষ্কারটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়, তা হচ্ছে সেক্সট্যান্ট (Sextant) যন্ত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আবদুর রহমান ইবন্ েআহ্মদ ইবন্ েইউনুস আরেকটি অবিস্মরণীয় নাম। উনার ‘আল-জিজ্ আল-কবির আল-হাকিমী’ একটি মৌলিক গ্রন্থ যার অর্ধেকই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে বা চুরি হয়ে গেছে। এ গ্রন্থে তিনি ৪০টি গ্রহ সমাপতন (Planetary Conjunction) এবং ৩০টি চন্দ্রগ্রহণ (Lunar Eclipse) সম্পর্কিত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
খ্রিস্টীয় একাদশ শতক মুসলমানদের বিজ্ঞানের জগতে এক রতœগর্ভা শতাব্দী। ইবনেুল হাইছাম, আল-বিরুনী এবং ইবনে সীনার মতো তিন তিনজন শাহানশাহী বিজ্ঞানীর আবির্ভাবে ধন্য এ শতক। আলোকবিজ্ঞানে অসামান্য সংযোজন ‘কিতাবুল মানাজির’-এর ১৫-১৬ অধ্যায়ে ইবনুল হাইছাম (৯৬৫-১০৩৯) জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা রেখেছেন। এছাড়া উনার মিযান আল-হিক্মাহ্ (Balance of Wisdom) এবং মাক্বাল ফি দ্য আল-ক্বামার (On the Light of the Moon)  গ্রন্থদ্বয়ে তিনি সর্বপ্রথম গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা চালান।
আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবন্ েআহ্মাদ আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮) অন্যান্য বিষয়ের সাথে সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান রাখতেও ভোলেননি। সকল বস্তুই ‘পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়’- এ বাক্যের মাধ্যমে তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির (Gravity) ধারণা দেন (কিন্তু পরে এেেত্র এর আবিষ্কারের কৃতিত্ব পায় হিংসাবশত: বিজ্ঞানী নিউটন)। তিনি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের উপর ‘কানুন মাস্উদী’ নামে একটি বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন, যার চতুর্থ খণ্ডটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোচনায় পূর্ণ। এতে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ত্রিকোণমিতিকে তিনি একই সঙ্গে ব্যবহার করে উভয়েরই উন্নতি সাধন করেন। দ্রাঘিমা, অরেখা, সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, দিক নির্ণয় ও গ্রহ-নত্রের অবস্থানজ্ঞাপক সংজ্ঞা নির্ণয়ে এ খণ্ডের অধিকাংশ পৃষ্ঠা ব্যয় হয়েছে। স্থানাংক নির্ণয়ে আংশ (Latitude) এবং দ্রাঘিমাংশের (Longtitude) ব্যবহারের শুরুটা উনার হাত দিয়েই হয়। তিনি সে যুগেই প্রায় নিখুঁতভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করেন যা আজকের দিনের পরিমাপের চেয়ে মাত্র ৩২ কিলোমিটার কম। অ্যারিস্টটলের পৃথিবীকেন্দ্রিক (Geo-centric) বিশ্ব ধারণার তিনি একজন কড়া সমালোচক তথা ভুল প্রমাণ করেন। এভাবে আল-বিরুনীর হাত দিয়েই সুস্পষ্টভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের পথ আলাদা হয়ে যায়। অবশ্য, আল-বিরুনী এখানেই থেমে যাননি, বরং চান্দ্র-সৌর দিনলিপি (Lunisolar Calendar), তারকাদের অবস্থানমাপক যন্ত্র (Planisphere) এবং প্রাথমিক গতিমাপক যন্ত্র (Odometer) উনার হাতেই আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাব এবং সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের উন্নতিসাধন করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অমর সাধক ইবন্ েসীনা (৯৮০-১০৩৭) শুক্র (Venus) গ্রহের উপর প্রচুর কাজ করেছেন। সূর্য থেকে দূরত্বের দিক থেকে শুক্র গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে কাছে- এটি উনার আবিষ্কার। তিনিও জ্যোতির্বিদ্যাকে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে আলাদা করে দেখতেন। তিনিও আল-ম্যাজেস্টের একটি ভাষ্য রচনা করেন। গ্রহসমূহের আবর্তনকালে টলেমী প্রস্তাবিত মডেলে যে সমস্যাটি অ্যাকোয়েন্ট সমস্যা (equant problem) নামে পরিচিত, ইবনে সীনা তার একটি সমাধান বের করেন বলে জানা যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানরা কতদূর আবিষ্কার রেখেছেন তা উপরের লেখা থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায়। কিন্তু, এগুলো পুরো অবদানের প্রথম অংশ মাত্র! ইবনে সীনার পরে আরো চার শতক ধরে এেেত্র মুসলমানরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে ছিলেন। সূত্র : waytojannah

Saturday, June 8, 2013

পাখিদের উড্ডয়ন: রহস্য ও প্রজ্ঞার V

পাখিদের উড্ডয়ন: রহস্য ও প্রজ্ঞার V

- ম্যাভেরিক

 


শীতের হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা অতিথি রাজহংস কিংবা সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা সরালীর ঝাঁকে যদি কখনো তাকান, দেখতে পাবেন V আকারে এগিয়ে চলছে পাখির দল।

কেন এই V আকারে ভেসে চলা? কারণটি কি এই, পাখিরা E বা G কিংবা অন্য কোনো বর্ণ ফুটিয়ে তুলতে পারে না আকাশে!

অধিকাংশ পাখি-বিশেষজ্ঞ (ornithologist) বিশ্বাস করেন, বিন্যাসটি সুদক্ষ উড্ডয়নের প্রয়োজনে গঠিত হয়, যদিও তারা এ ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি বহুদিন। এই শতাব্দীর একেবারে শুরুতে বিজ্ঞানীদের একটি দল ছোট বিমানের পেছন পেছন উড্ডয়নের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক ঝাঁক পেলিক্যানের উপর গবেষণা করে দেখতে পান, V বিন্যাসে উড়ার সময় পাখির হৃদস্পন্দন, একা একা উড়ার সময়কার হৃদস্পন্দনের চেয়ে কম থাকে। ধীরে ধীরে প্রমাণ মেলে পাখির বায়ুগতিবিদ্যা (aerodynamics) সংক্রান্ত নানা বিস্ময়কর তথ্যের:

উড্ডয়নের জন্য ঝাঁকের একটি পাখি যখন ডানা ঝাপটায়, এর ঠিক পেছনের পাখিটির উপর বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী ঘূর্ণাবর্ত (vortex) সৃষ্টি হয়। ঊর্ধ্বচাপের সুবিধা কাজে লাগিয়ে পেছনের পাখিটি সামনেরটির চেয়ে একটু উপরে অবস্থান করে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম শক্তি ব্যয় করেও ভেসে থাকে। এভাবে পাখির ঝাঁকটি একা একা উড্ডয়নে অতিক্রান্ত দূরত্বের চেয়ে ন্যূনতম ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে!

যদি কোনো পাখি বিন্যাসের বাইরে চলে যায়, সাথে সাথে এটি বাতাসের অতিরিক্ত টান (drag) ও বাধা অনুভব করে। পরিবর্তনটি বুঝতে পেরে পাখিটি দ্রুত বিন্যাসে চলে আসে এবং সামনের পাখিটির কাছ থেকে সৃষ্ট উড্ডয়ন সুবিধা লাভ করে।

সামনের দলনেতা পাখিটি বাতাসের সবচেয়ে বেশি বাধা অনুভব করে, এবং ক্লান্ত হয়ে গেলে পাখা ঝাপটানোর বেগ কমিয়ে দিয়ে এটি ঝাঁকের পেছন দিকে সরে আসতে থাকে। পেছনের আরেকটি পাখি তখন নেতার স্থানটি গ্রহণ করে। মজার ব্যাপার হলো, V-এর দুই ডানার সবচেয়ে পেছনের পাখি দুটি আবার মাঝের পাখিগুলির চেয়ে বেশি টান অনুভব করে, ফলে ক্লান্তি লাঘবের জন্য এদেরও নিয়মিত স্থান পরিবর্তিত হতে থাকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব পাখি ঝাঁকের মাঝখানে থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করে এবং অগ্রভাগে নেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাধার মুখোমুখি হয়।

V-বিন্যাস পাখিদের যোগাযোগ রক্ষার কাজটি সহজতর করে। এ বিন্যাসে পাখিরা পরস্পরের সাথে খুব চমৎকার ঐক্ষিক যোগযোগ (visual contact) বজায় রাখতে পারে, যা ঝাঁকটি সুসংহত, ঐক্যবদ্ধ রাখে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমার সময় এতে ঝাঁক থেকে পাখি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কমে যায়। এ ছাড়া পেছনের পাখি চিৎকার করে সামনের পাখিকে নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে যায়, যাতে সামনের পাখি তার গতিবেগ বজায় রাখে।

কোনো পাখি অসুস্থ, শিকারীর গুলিতে আহত, কিংবা খুব ক্লান্ত হয়ে বিন্যাসের বাইরে চলে গেলে, তার সাথে আরো পাখি নেমে আসে সাহায্য ও নিরাপত্তার জন্য। এরা অসহায় পাখিটির সাথে থেকে যায় যতক্ষণ না সে সুস্থ হয় বা মারা যায়। তারপর তারা উড়ে মূল দলের কাছে পৌঁছে যায়, নতুবা অন্য কোনো দলের সাথে জুড়ে যায়, কিংবা নিজেরাই নতুন বিন্যাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।


কত অপার রহস্য ছড়িয়ে রেখেছেন স্রষ্টা! চারপাশে বিরাজমান সহমর্মিতার কত না নিদর্শন! পাখির কাছে বিজ্ঞান ও মানবতার কী গভীর প্রজ্ঞা!

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০০৯ 

মন্তব্য ও মন্তব্যের জবাব:

লেখাজোকা শামীম বলেছেন: দারুণ লাগল। দেখেছি অনেক, কিন্তু ভাবি নি কখনও। দ্যা ক্রেনস আর ফ্লাইং সিনেমার প্রথম ও শেষ দৃশ্যে সারস পাখি ওড়ার এ রকম একটি দৃশ্য আছে। লেখক বলেছেন: হ্যাঁ, বেশ মজার। বায়ুগতিবিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন কিভাবে পাখির ঝাঁকের মতো এক ঝাঁক উড়োজাহাজের উড্ডয়নকে দক্ষ করা যায়। কিন্তু পাখি যত দ্রুত বায়ুর সূক্ষ্ম পরিবর্তনের সাথে উড্ডয়ন অ্যাডজাস্ট করতে পারে, তার এখনও বহু পেছনে অ্যারোডাইনামিক্স।
বিবেক সত্যি বলেছেন: কী যে ভালো লাগলো !! +++++  পাখির উড়ার কৌশল কে আল্লাহ একটি নিদর্শন আর জ্ঞাণীদের জন্য চিন্তার খোরাক হিসেবে বলে দিয়েছেন ।
 
রুবাইয়াত ইসলাম সাদাত বলেছেন: খুব খুব ভালো লাগলো পোস্ট টা পড়ে। অনেক কিছু জানলাম যা জানা ছিলোনা। আরো চাই এ ধরনের পোস্ট।
পাখিদের এই ওড়ার ব্যাপারে আরো একটি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার জানি যেটা সেটা হল পাখির ঝাঁক ওড়বার সময় ফিবোনাক্কি সিরিজ মেনে চলে। মানে প্রথমে একটি পাখি, তারপরেও একটি, এরপর দু'টি, এরপর তিনটি- এভাবে ওড়ে। "পাখির কাছে বিজ্ঞান ও মানবতার কী গভীর প্রজ্ঞা! " খুব ভালো লেগেছে কথাটা। লেখক বলেছেন: শুভেচ্ছা। খুব ভালো লাগল আপনাকে দেখে। পাখিদের ফিবোনাচি সিরিজ মেনে চলার ব্যাপারটি আসলেই খুব চমকপ্রদ। নিশ্চয়ই খুব সচেতনভাবে কাজটি করে পাখিরা।
জানজাবিদ বলেছেন: কোরআনের একটা আয়াত আছে পাখীদের ওড়ার ব্যাপারে। কেউ যদি বলতে পারেন খুশী হবো।


নাজনীন১ বলেছেন: @ জানজাবিদ,সূরা নাহ্‌ল, আয়াত ৭৯ঃ
"Do they not see the birds held (flying) in the midst of the sky? None holds them but Allah [none gave them the ability to fly but Allah]. Verily, in this are clear proofs and signs for people who believe (in the Oneness of Allah)."
 েমাহাম্মদ িমজানুর রহমান বলেছেন: এই জগতে 'স্রষ্টা' কত অপার রহস্য ছড়িয়ে রেখেছেন তার সবটুকু আবিস্কার করা আসলেই মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কি বিজ্ঞানময় আর সুনিপূন সেই স্রষ্টা!
পাখী নিয়ে গবেষণা করেই মানুষ বিমান আবিস্কার করেছিল। পাখী নিয়ে গবেষণা করলে হয়তো আরও অবেক রহস্য রেরিয়ে আসবে। কুরআনুল কারীম পাখী নিয়ে গবেষণা করতে বলেছে: ‍''তারা কি লক্ষ্য করে না (গবেষণা করে না) তাদের উর্ধ্বদেশে পাখীদের প্রতি, যা পাখা বিস্তার করে ও সংকুচিত করে? দয়াময় আল্লাহই তাদেরকে আকাশে স্থির রাখেন (পড়ে যায় না)। তিনি সর্ব বিষয়ে দ্রষ্টা''(সূরা মূলক: আয়াত- ১৯) লেখক বলেছেন: শুভেচ্ছা। আমার ব্লগে আপনার বিচরণ আনন্দময় হোক।প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা আমাদের শ্রদ্ধাশীল জ্ঞান দান করুন, যাতে সৃষ্টিজগতের প্রতি আমাদের মমতা নিরন্তর বাড়ে। আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। সুখ শান্তিতে কাটুক জীবন।

নুভান বলেছেন: সত্যিই অসাধারন। পাখিদের এই উড্ডয়নকে পর্যাবেক্ষন করে গণিতের এক নতুন শাখার উৎপত্তি হয়েছে যার নাম PSO (Particle Swarm Optimization). ক্ল্যাসিক্যাল গানিতিক সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতির চেয়ে এটা অনেক বেশী কার্যকর, এমন কি নিউরাল নেটওয়ার্ক এর চেয়েও, কারন এর প্রয়োগ খুব সহজ। রিসার্চ পেপারের কিছু লাইন তুলে দিলামঃ
"The birds may fly in different ways to search in the area. In the asynchronous scheme, the first bird flies a certain distance and in a certain direction based on his own experience and the known location of the best position found so far. When he is done flying, if his location is closer to the bread than the previous globally optimal position, he communicates this information to the second bird. (Otherwise, the global optimal location remains the same.) The second bird then uses this information to update his speed and position, and so on. Since in this method of searching an area the birds all update their speeds and directions at different times, it will be called asynchronous....A different method is obtained if all birds stop after flying in the same time interval, and communicate each other to get the current global best position. Once this communication is completed, the birds can update their directions and speeds based on their own history and the globally best information available, and fly again. This scheme will be called synchronous, as all of the birds update their information at the same time." রেফঃ Application of a Novel Parallel Particle Swarm Optimization tothe Design of Electromagnetic Absorbers Suomin Cui* and Daniel S. Weile     লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ, নুভান ভাই, চমৎকার তথ্য দিলেন। 

Source: http://www.somewhereinblog.net 


Watch this Video

Geese Fly in V Formation Why? 
Comments: ksaALWAFi:  There is God made that

মুসলিম রোগী দেখতে দেখতে ইসলাম গ্রহণ


সম্প্রতি মার্কিন শিশু ও নারী বিশেষজ্ঞ ডা. ইউএস অরিভিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নিজের ইসলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে ডা. অরিভিয়া বলেন, আমি আমেরিকার একটি হাসপাতালে নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করি। একদিন হাসপাতালে এক আরব মুসলিম নারী এলেন বাচ্চা প্রসবের জন্য। প্রসবের পূর্বমুহূর্তে তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। প্রসব মুহূর্ত ঘনিয়ে এলে তাকে জানালাম, আমি বাসায় যাচ্ছি, আর আপনার বাচ্চা প্রসবের দায়িত্ব অর্পণ করে যাচ্ছি অন্য এক ডাক্তারের হাতে। মহিলা হঠাত্ কাঁদতে লাগলেন, দ্বিধা ও শঙ্কায় চিত্কার জুড়ে দিলেন, ‘না না, আমি কোনো পুরুষ ডাক্তারের সাহায্য চাই না। আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। এ অবস্থায় তার স্বামী আমাকে জানালেন, সে চাইছে তার কাছে যেন কোনো পুরুষের আগমন না ঘটে। কারণ সে সাবালক হওয়া থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তার আপন বাপ, ভাই ও মামা প্রভৃতি মাহরাম পুরুষ ছাড়া অন্য কেউ তার চেহারা দেখেনি। আমি হেসে উঠলাম, তারপর চরম বিস্ময় নিয়ে তাকে বললাম, অথচ আমি কিনা এমন এক নারী আমেরিকান হেন কোনো পুরুষ নেই, যা তার চেহারা দেখিনি। অতঃপর আমি তার আবেদনে সাড়া দিলাম।

বাচ্চা প্রসবের পরদিন আমি তাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিতে এলাম। পাশে বসে তাকে জানালাম, প্রসব-উত্তর সময়ে দাম্পত্যমিলন অব্যাহত রাখার দরুন আমেরিকায় অনেক মহিলা অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ এবং সন্তান প্রসবঘটিত জ্বরে ভোগেন। অতএব আপনি এ সম্পর্ক স্থাপন থেকে কমপক্ষে ৪০ দিন বিরত রাখবেন। এ ৪০ দিন পুষ্টকর খাদ্য গ্রহণ ও শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকার গুরুত্বও তুলে ধরলাম তার সামনে। এটা করলাম আমি সর্বশেষ ডাক্তারি গবেষণার ফলাফলের নিরিখে।
অথচ আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি জানালেন, ইসলাম এ কথা বলে দিয়েছে। প্রসব-উত্তর ৪০ দিন পবিত্র হওয়া অবধি ইসলাম স্ত্রী মিলন নিষিদ্ধ করেছে। তেমনি এ সময় তাকে নামাজ ও রোজা থেকেও অব্যাহতি দিয়েছে।
এ কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে বিমূঢ় হলাম। তাহলে আমাদের এত গবেষণা আর এত পরিশ্রমের পর কেবল আমরা ইসলামের শিক্ষা পর্যন্ত পৌঁঁছলাম! আরেকদিন এক শিশু বিশেষজ্ঞ এলেন নবজাতককে দেখতে। তিনি শিশুর মায়ের উদ্দেশে বললেন, বাচ্চাকে যদি ডান কাতে শোয়ান তবে তা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এতে করে তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে। শিশুর বাবা তখন বলে উঠলেন, আমরা সবাই সর্বদাই ডান পাশ হয়ে ঘুমাই। এটা আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। এ কথা শুনে আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম! এই জ্ঞান লাভ করতে আমাদের জীবনটাই পার করলাম আর সে কি-না তার ধর্ম থেকেই এ শিক্ষা পেয়ে এসেছে! ফলে আমি এ ধর্ম সম্পর্কে জানার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনার জন্য আমি এক মাসের ছুটি নিলাম এবং আমেরিকার অন্য শহরে চলে গেলাম, যেখানে একটি ইসলামিক সেন্টার আছে। সেখানে আমি অধিকাংশ সময় নানা জিজ্ঞাসা আর প্রশ্নোত্তরের মধ্যে কাটালাম। আরব ও আমেরিকার অনেক মুসলমানের সঙ্গে ওঠাবসা করলাম। আলহামদুলিল্লাহ এর কয়েক মাসের মাথায় আমি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলাম।

Friday, June 7, 2013

ফরাসি নও মুসলিম লায়লা হোসাইন (ভিডিওসহ)

ফরাসি নও-মুসলিম লায়লা হোসাইনের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরব। পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্মইসলামের আলোকিত বিধি-বিধান, বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং নানা প্রথা যুগ যুগ ধরে সত্য-সন্ধানী বহু অমুসলিম চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। যেমন, জ্ঞান-চর্চার ওপর ইসলামের ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ অনেক অমুসলিম গবেষককে অভিভূত করেছে। ইসলামী হিজাব বা শালীন পোশাক তথা পর্দার বিধানও আকৃষ্ট করে আসছে অমুসলিম নারী সমাজকে। ফরাসি নারী লায়লা হোসাইনও তাদের মধ্যে অন্যতম।
পাশ্চাত্যের বঞ্চিত ও প্রতারিত নারী সমাজ ইসলামী শালীন পোশাকের মধ্যে প্রশান্তি, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা খুঁজে পাচ্ছেন। পাশ্চাত্যের অনেক নারীই সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, তারা এই পশ্চিমা ভূবনে মুসলিম মহিলাদের হিজাব দেখেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তারা বলেছেন, আমরা হিজাবের মধ্যে সত্যিকারের সুখ, প্রশান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করছি। ইসলামী হিজাবের এই প্রভাবের কারণে পশ্চিমা সরকারগুলো নানা অজুহাতে হিজাব পরিহিতা নারীদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করছে। এ ছাড়াও এসব সরকার পর্দানশীন নারীদেরকে একঘরে করার ও দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে
ফরাসি নও-মুসলিম লায়লা হোসাইন ছিলেন একজন ইহুদি। ” আহলুল বাইত” টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হিজাবের সৌন্দর্য দেখেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং বেছে নিয়েছেন পরিপূর্ণ হিজাব। লায়লা হোসাইন বলেছেন, ” মুসলমানদের সম্পর্কে সব সময়ই এক ধরণের বীতশ্রদ্ধা ছিল আমার মধ্যে। আমি এভাবেই বড় হয়েছি। কিন্তু আমি সব সময়ই হিজাব পরা মুসলিম নারীদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। তাদের পবিত্রতা ও বিনম্রতা আমাকে মুগ্ধ করত। আমার দৃষ্টিতে তাদের রয়েছে এক ধরণের নিজস্ব সৌন্দর্য। আমি ইহুদি সমাজের সদস্য হওয়ায় ইসলামী হিজাব রপ্ত বা আয়ত্ত্ব করা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু ঈমান বা বিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তারা (অর্থাৎ ইহুদিরা) মুসলিম মহিলাদের চেয়ে ইহুদি মহিলাদেরকেই বেশি শ্রদ্ধা করত।”
ইসলামের অন্য অনেক সৌন্দর্য গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় লায়লা হোসাইনের কাছে। পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধিতে তাকে সহায়তা করেছে। তিনি বলেছেন, ” কোরআন ছিল আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আমি পেয়েছি তা থেকে বুঝতে পেরেছি যে, ইসলাম সত্য ও খাঁটি ধর্ম। কারণ, এ ধর্ম সব নবী-রাসূলকেই শ্রদ্ধা করে। আর আমার দৃষ্টিতেও এটা খুবই যৌক্তিক। ধীরে ধীরে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে ইসলামের শুধু বাহ্যিক দিক নয়, আছে অভ্যন্তরীণ দিকও। তাই ভেতর থেকেও ইসলামকে রক্ষা করতে হবে।”
ইসলামে মানুষের আত্মা ও দেহ- উভয়ই গুরুত্ব পেয়েছে। প্রকৃত মুসলমান হওয়ার জন্য ইসলামী বিশ্বাসের শুধু মৌখিক স্বীকৃতি ও বাহ্যিক আচার-আচরণ বা ইবাদতই যথেষ্ট নয়। মন বা হৃদয়ের গভীরে ইসলাম কতটা স্থান করে নিয়েছে-লায়লা হোসাইনের মতে তাও গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমা সরকারগুলো ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চিত্র তুলে না ধরায় নও-মুসলিমরা অনেক সমস্যার শিকার হন। কিন্তু ইসলামের সৌন্দর্য ও বাস্তবতা নওমুসলিমদের কাছে এতই হৃদয়গ্রাহী যে সব ধরনের কঠোরতা, ক্লেশ ও বাধা-বিঘ্ন সহ্য করা তাদের জন্য সহজ হয়ে পড়ে।
লায়লা হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ” হিজাব পরার মাধ্যমে আমি নিজেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছি-এই ভেবে আমার পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কারণ, ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধ। স্কার্ফ বা ওড়না মাথায় দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যাওয়া এ দেশে নিষিদ্ধ, ফলে হিজাবধারীকে সামাজিক অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। শুধু বিশেষ পোশাক পরার কারণে আমি আমার সামাজিক জীবনকে বিপদাপন্ন করেছি বলে আমার পরিবার মনে করত। এ অবস্থা মেনে নেয়া তাদের জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। তারা মনে করত আমি আমার মুসলমান হওয়ার বিষয়টি হিজাবের মাধ্যমে প্রকাশ না করলেই ভাল হত। ইসলামের প্রতি আমার বিশ্বাস কেবল মনের মধ্যে লালন করলেই তা যথেষ্ট হত বলে তারা মনে করত। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পবিত্র কোরআনে ও রাসূল (সা.)’র অনেক হাদিসে বা সুন্নাতে হিজাবের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের জন্যেও যে তা জরুরি তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছ কোরআন-হাদিসে। তাই হিজাব পরিত্যাগ করতে রাজি হইনি আমি। আমার কাছে হিজাব শুধু হাত ও মাথা ঢাকার বিষয় নয়, বরং এর চেয়েও বড় কিছু।”
ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে অনেক ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। এ ধরনের ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু বর্তমান যুগে প্রচলিত ইহুদি ধর্ম (যা আসলে আদি বা অকৃত্রিম ইহুদি ধর্ম নয়) অনুযায়ী এ ধর্ম ত্যাগ করা যায় না। ফলে নও-মুসলিম ইহুদিরা অনেক সমস্যার শিকার হচ্ছেন। তাসুয়ি ইহুদা লাভ নামের একজন ইহুদি পুরোহিত বলেছেন, ইহুদির মেয়েরা অন্য ধর্ম গ্রহণেরও পরও ইহুদি থেকে যায়। কারণ, ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী, ইহুদি মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া ইহুদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করার পরও ইহুদি থেকে যায়।
এ ছাড়াও বিশ্বের ইহুদিদের অভিভাবক হওয়ার দাবিদার দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনের বাইরে ইহুদিদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ঠেকানোর জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিয়েছে। তা সত্ত্বেও ইসরাইলি দৈনিক মারিভ সম্প্রতি লিখেছে, “ইসরাইলের ভেতরেই প্রতি বছর শত শত ইহুদি নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনের ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য ইসরাইলি বিচার-বিভাগের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। ইসরাইলি ইহুদিদের মধ্যে এ ধরনের আবেদনের সংখ্যা ২০০৮ সালে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।”আবার অনেক ইহুদি ধর্ম পরিবর্তন সংক্রান্ত এ ধরনের আবেদন করছেন না, কিংবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে গেলে যেসব সীমাবদ্ধতা ও হয়রানির শিকার হতে হবে তা এড়ানোর জন্য এ পবিত্র ধর্ম গ্রহণের কথা প্রকাশ করছেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা এবং ইহুদিবাদীদের হাতে তাদের সম্পদ দখল ও লুণ্ঠনের ঘটনাগুলো অধিকৃত ফিলিস্তিনে আসা ইহুদিদেরকে বিকৃত হয়ে পড়া ইহুদি ধর্ম ত্যাগের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
ইহুদিদের মধ্যে অন্য ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকায়, বিশেষ করে ইসলামের আকর্ষণ তাদের মাঝে বাড়তে থাকায় ইহুদিবাদী ইসরাইল অ-ইহুদি বিয়ে করাকে ইহুদি যুব সমাজের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবেনিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।অ-ইহুদি স্বামী বা স্ত্রীর প্রভাবে ইহুদি যুব সমাজ নিজ ধর্ম ত্যাগ করছে বলেইইসরাইল তা ঠেকাতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইহুদিবাদী রাজনৈতিক নেতা আভরি আভরবাখ বলেছেন, প্রত্যেক ইহুদির নিজ ধর্ম ত্যাগের ঘটনা ইহুদি গ্রুপগুলোর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ক্ষতি বয়ে আনছে। কিন্তু লায়লা হোসাইনের মতে, সত্য ধর্ম তার স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট নানা শিক্ষার কারণেই মানুষের অন্তর জয় করছে এবং জীবন, ভালবাসা ও বিশ্বাসের প্রকৃত অর্থ তুলে ধরছে। পবিত্র কোরআনেআল্লাহ বলেছেন, “তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।”
ভিডিও দেখুন এখানে:

এক অসাধারণ #না’তসহ দরূদ - বালাগাল উলা বি-কামালিহি: ইতিহাস, অনুবাদ ও তাৎপর্য